বেড়ানো: গ্রিসের আয়োনিয়ান দ্বীপে ।।
তুমি আবার গ্রিসের ফুড দেখছ? বাবাই রুমে ঢুকে জানতে চাইল। একই জিনিস কতবার দেখো?
আরে যাচ্ছি তো না! এমনিতেই দেখতে ভালো লাগে তাই দেখছি। বললাম আমি।
এবার কিন্তু নো যাওয়া–যাওয়ি! বাবাই বলল। মনে আছে না?
পরদিনই আবার বাবাই ডাক দিয়ে বলল, দেখে যাও কী সুন্দর! আমি দৌড়ে এলাম। টিভির বিশাল স্ক্রিন সমুদ্রের নীলে ভরে উঠেছে। এত নীলও কী হতে পারে পানির রং! আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে মোটামুটি স্বপ্নও দেখা শুরু করে দিলাম কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই। দেখছি আমি সমুদ্রের নীলের পাশে বাবাই আর লিওনেলের সঙ্গে বসে আছি। হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ।
এমনিই দেখতে ডেকেছি। বাবাই বলে উঠল। এবার কিন্তু আমরা যাব না।
অবশ্যই যাব না। এত ঘুরে বেড়ালে হবে! আমি বললাম।
এটা ছিল সে সময় আমাদের প্রতিদিনের কমন আলোচনা। কেন? কারণ, আমরা ঠিক করেছিলাম, কয়েক দিন বা মাস পরপরই আমরা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে পড়ি—এটা বন্ধ করতে হবে। তাই আমাদের দুজনের ভেতরে যারই মনটা দুর্বল হবে, অন্যজনকে তখন জোর গলায় বলতে হবে, আমরা মোটেও যাব না এবার। মাত্র দুই মাস আগে বেড়িয়ে এলাম।
কিন্তু কিসের কী, সারা দিন বাসায় ট্রাভেল চ্যানেল চলে! হয় আমি দেখি, না হয় তিনি দেখেন! হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমরা ইতিমধ্যেই প্লেনের টিকিটও কেটে ফেলেছি। বুঝতেই পারছেন, আমরা দুজন বেড়ানোর বেলায় অতিমাত্রায় ‘সংযমী’!
মাত্র তিন দিনের ভেতরেই সিদ্ধান্ত নিয়েই এবারের যাত্রা আমরা। অন্যবার কোথাও যাওয়ার আগে বাবাই, আমাদের টিম লিডার, অনেক গবেষণা করেন। এবার অল্প গবেষণাতেই দৌড়। কোথায়? গ্রিসের অসম্ভব সুন্দর দ্বীপ করফুতে। একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে নিলাম রিভিউ দেখে। মনে তো হচ্ছে ভালোই হবে।
যাওয়ার আগের দিন মেইল এল, সঙ্গে যেন ক্যাশ টাকা রাখি আমরা। যাওয়ার তুমুল উত্তেজনায় আমাদের ছেলে ঘুমাতেই পারছে না। অবশেষে প্লেনের জানালা দিয়ে দ্বীপ দেখা গেল। দিনটা মেঘলা হওয়ায় তখনো বুঝে উঠতে পারিনি। তবে প্লেন ল্যান্ড করছে যেখানে, সেই রানওয়ে দেখে ভালোই ভয় পেয়েছিলাম। কী সরু রে বাবা! বের হয়ে ট্যাক্সি নিলাম। যেতে যেতে মনটাই খারাপ হলো, কী জায়গা রে বাবা। ভাঙা বাড়িঘর, রংচটা দেয়াল।
হঠাৎই যেন অন্য এক ভুবনের ভেতর দিয়ে চলতে শুরু করলাম। ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে রাস্তা চলছে আর হঠাৎ হঠাৎ সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। ১৬২৩ সালে, ভেনিশিয়ানরা কর্ফিয়টসকে জলপাইগাছ লাগানোর জন্য এবং বন্যদের পরিবর্তে চাষের জায়গায় প্রতিদান দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ১০০ বছরের মধ্যে ২০ মিলিয়নেরও বেশি গাছ ছিল এবং এই সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। যাতে আজ করফু হলো একটি বিশাল জলপাই গ্রোভ।
তারপর যেই ওপরের রাস্তায় উঠে গেলাম, মাথা পুরাই নষ্ট আমার! এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ছুটে চলেছি। সঙ্গে সমুদ্রকে নিয়ে। ঠিক কিছুক্ষণ পরেই সূর্যাস্ত হবে। গোধূলির মায়াবী লালচে আলোয় সমুদ্রের নীলে মিশে একাকার অবস্থা! পুরা ঘোরের ভেতরেই অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছলাম।
সেখানে গিয়ে আরও মাথা নষ্ট! এর আগেও স্পেনের হোটেলে বসেই সমুদ্র দেখেছি। কিন্তু এবারের দৃশ্য যেন একদমই আলাদা। এবার বিশাল বড় পাহাড়ের পা ঘেঁষে নীল সমুদ্র! মনে হচ্ছে বিশাল সবুজ যেন নীলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! গ্রিসের দ্বীপগুলোর মধ্যে আয়তনের বিচারে সপ্তম স্থানে রয়েছে করফু। গাছপালা দিয়ে ঢাকা করফুকে সবুজ দ্বীপও বলা হয়।
ইউরোপের রাজপরিবারগুলো বহুকাল আগেই করফু দ্বীপের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। যেমন অস্ট্রিয়ার সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ ঊনবিংশ শতাব্দীতে সেখানে নিজের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন।
আমাদের অ্যাপার্টমেন্টটা একদম পাহাড়ের ওপরে। রাতে আমি আর বাবাই বসে রাতের করফু দেখছি। মনে হচ্ছিল, পওরো পাহাড়জুড়ে যেন হাজার হাজার বাতি জ্বলছে আর অন্যদিকে গভীর অন্ধকারে ঢাকা শান্ত সমুদ্র! বাবাই বলল, কোনো এক দম্পতি এখানে এসে বাড়ি তৈরি করে। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এই জনবসতি! আমার তো শুনেই মনটা কেমন করে উঠল।
পরদিন করফু শহরে যাওয়া ঠিক করলাম। আবার সেই আঁকাবাঁকা পথ ধরে চললাম। শুধু ভালো লাগাই ছিল বললে ভুল হবে। আমার কিন্তু বেশ ভয়ও লাগাও ছিল। ড্রাইভার দক্ষ না হলেই নিচে পড়ব আরকি।
তবে এই রুটে দক্ষ চালককেই পাঠানো হয় পর্যটকদের শহরে নিয়ে আসার জন্য। আমরা নামলাম। নেমেই ছেলে আবদার করল, সে আইসক্রিম খাবে। পাশেই দোকান। দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই মনে হলো, বাবাইয়ের কাছে কী যেন একটা নেই। আরে সর্বনাশ!
তোমার ব্যাকপ্যাক কোথায় বাবাই, বলে আমি ভয়ে চিৎকার করেই উঠলাম।
হায়, হায়! বাসে তো ব্যাগপ্যাক ফেলে এসেছি! বলে সেও খানিকটা উদ্ভ্রান্ত হলো কিছুক্ষণের জন্য। যেখানে বাস থেকে নেমেছিলাম, সেখানেই ছুটে গেলাম। জানা গেল শহরের মেইন বাসস্টেশনের ইনফরমেশনে গিয়ে বললেই ব্যাগ ফেরত পাওয়া যাবে। তো অগত্যা ব্যাগের সন্ধানে বাবাই আমাদের সেখানে রেখেই রওনা দিল। যাক অবশেষে যখন ব্যাগ পেলাম, তখন প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছে। আমরা ঠিক করেছি, প্রথমে ওল্ড ফোর্ট দেখতে যাব। তো গুগল ম্যাপ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। সমুদ্র আর পোর্ট ধরে আমরা এগিয়ে চললাম।
করফু শহরের পুরোনো দুর্গ আটলান্টিক উপদ্বীপে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে, যা আয়োনিয়ান সাগরে প্রবেশ করে। ভেনেসীয়রা পঞ্চদশ শতাব্দীতে ওল্ড দুর্গ নির্মাণ করে এবং এটি ভিনসিয়ান শাসনের ৪০০ বছরের একটি প্রতিমাসংক্রান্ত প্রতীক। ১৫৭৭-১৫৮৮ সালের মধ্যে পুরোনো পোর্টের কাছাকাছি একটি নতুন দুর্গও তৈরি করা হয়েছে। সামনে থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো, কারণ ছেলেসমেত এত ওপরে ওঠার মতো সাহস আমাদের ছিল না।
দেখলাম যে ওপর পর্যন্ত কম মানুষই উঠতে পারছে। হেঁটে চললাম ওল্ড সিটির দিকে। ২০০৭ সালে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে মনোনীত ওল্ড টাউন হলো সরু আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলোর এক গোলকধাঁধা। এই আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো কান্টুনিয়া নামে পরিচিত। গারিতসা উপসাগরের দিকে সমুদ্র উপকূলে গড়া ওঠা শহর ও পুরোনো ভিনিশিয়ান দুর্গের মাঝখানে বানানো হয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় স্কয়ার মাঠ, স্প্যানিয়াডা নামে পরিচিত।
কাছেই রয়েছে সেন্ট মাইকেল ও সেন্ট জর্জ প্রাসাদ, যাকে রয়্যাল প্রাসাদ বলা হয়। ল্যানটন থেকেস স্পিয়ানাডার বিপরীত দিকে এটি। এই ইতিহাসে প্রাসাদে অনেক ভূমিকা রয়েছে। এটি একবার গ্রিক রাজপরিবার জন্য একটি সরকারি ভবন ও একটি গ্রীষ্মকালীন বাড়ি ছিল। তবে এখন এটি এশিয়ান আর্টের মিউজিয়াম।
এরপর দিনের বাকি সময় আমরা ওল্ড সিটির অলিগলি ঘুরে বেড়ালাম। কেমন যেন আজ থেকে শত শত বছর পিছিয়ে গেলাম আমি। মেন হচ্ছিল, শত বছর আগে আজকের দিনেই কেউ হয়তো হেঁটেছে এই রাস্তা দিয়ে। নয়তো ওই বাড়িটায় দুপুরের খাবার খেয়ে ছোট্ট বাবুকে নিয়ে একটু বসেছে ব্যালকনিতে রোদ পোহাতে! কে জানে, কেমন ছিল সেই সময়টা! পাঁচটায় ফেরার শেষ বাস। এরপর অন্ধকারে আর বাস যায় না। তাই আবার ফিরে এলাম সমুদ্রের কাছে।
আমাদের এবারের যাত্রার সবচেয়ে সুন্দর দিনটি ছিল আয়োনিয়ান সমুদ্রের ক্রুজ। হঠাৎ করেই বাবাই বলল, যাবে নাকি ক্রুজে? মনে উত্তেজনা আর খুশি চেপে রেখে বললাম, যাওয়া যায়, মানে ভাবটা এমন আর কী, গেলেও যা না গেলেও তা! তবে মেঘলা হলে যাওয়া যাবে না। কিন্তু ভাগ্য ভালো ছিল আমাদের।
আমরা সারা দিনের জন্য রওনা দিলাম। সঙ্গে চারটি ভাষায় বর্ণনা দিয়ে চলেছেন দক্ষ গাইডেরা। ওল্ড সিটি সমুদ্র থেকে দেখতে যেন অন্য রকম লাগল। কী জানি ভেসে বেড়িয়ে দেখা কিছুও মনে হয় অদেখা রহস্যময় হয়ে যায়! চলতে চলতে মাউস আইল্যান্ডটিও দেখতে পেলাম। এখানেই পানিয়াজিয়া ভ্লেচারনার চার্চটি রয়েছে। একদিকে আলবেনিয়া উপকূল দেখা যায়! এরপর প্যাক্সোস, অ্যান্টিপ্যাক্সোস, নিকোলাস আইল্যান্ড, ব্লু কেইভ ঘুরে দেখলাম।
পাহাড়ের ওপরটা যেন গাছে ছেয়ে থাকে সব সময়। লাখ লাখ গাছ! সব গাছের বয়সই নাকি প্রায় পাঁচ শ থেকে এক হাজার পর্যন্ত! পানির রং ক্ষণে ক্ষণে বদল হচ্ছে! যখন পাহাড় ঘেঁষে যাচ্ছি, তখন পানির রং নীলে-সবুজে মিলে অসাধারণ এক রং তৈরি করে ফেলে মুহূর্তেই। আবার আশপাশে যখন শুধুই পানি, তখন যেন আকাশের নীল আর সাগরের নীলে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ব্লু কেইভে ঢুকে তো এমন ভয় পেলাম। প্রকৃতি নিজ হাতে কী অসাধারণ সৌন্দর্য বানিয়ে রেখেছে না দেখলে বিশ্বাস হবে কেন?
দুপুরবেলায় যখন প্যাক্সোসের শহরে খেতে নামলাম, তখনো এতটুকুও ক্লান্ত হইনি কেউ। করফুর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এটা পুরোই বিড়ালের শহর। ছোট, বড়, মাঝারি, বিশাল বড়—কোন সাইজের বিড়াল নেই এখানে! এমনকি রেস্টুরেন্টেও ঘুরে বেড়ায়। কেউ কিছু বলে না!
আর যদি খাবারের প্রসঙ্গে আসি, অসম্ভব স্বাদের সব খাবার, ফ্রেশ মাছের প্ল্যাটার! ইউরোপের অনেক দেশের খাবারই খেয়েছি। কিন্তু গ্রিসের খাবারের স্বাদ যেন অন্য রকম। পরিবেশও আসলে বিষয়। সমুদ্রের পাড়ে যেন সবকিছুই বেশি বেশি ভালো লাগে।
এত ভালো লাগার মুহূর্তগুলো কিছুতেই যেন পুরোটা বোঝানো যায় না। রাতের সৌন্দর্য আর দিনের সৌন্দর্য যেন কোনোভাবেই মেলে না! রাতে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে যখন ব্যালকনিতে বসে থাকতাম, চাঁদের আলোয় ভরে যেত জায়গাটা। সমুদ্র থেকে ভেসে আসা শীতল বাতাসে যেন থাকত কেমন মাদকতা আর সামনের পাহাড়গুলোয় জ্বলতে থাকা হাজার হাজার তারা যেন ফিসফিসিয়ে বলতে থাকত অনেক গল্প! ঘুমন্ত শহরের চাঁদের আলোয় ভরে ওঠা ব্যালকনিতে আমরা দুজন বসে আছি পাশাপাশি। এর চেয়ে আশীর্বাদের আর সৌভাগ্যের কোনো কিছুই জীবনে হতে পারে কি?
ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল: পিএইচডি গবেষক, নৃবিজ্ঞানী ও অনলাইন লেখক, জার্মানি।