ব্যাংক-মানি চেঞ্জার ঘুরেও মিলছে না ডলার, ভোগান্তি
পল্টনে ডলার ক্রয় করতে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী খলিল আকন্দ। চিকিৎসার জন্য মা’কে নিয়ে যাবেন ভারত। বেশ কয়েকটি ব্যাংকে গিয়েও প্রয়োজনীয় ডলার পাননি তিনি। বাধ্য হয়ে কার্ব মার্কেটে (খোলাবাজার) যান। দিলকুশা আর মতিঝিল ঘুরে ডলার না পেয়ে পল্টনে আসেন। এখানেও কিনতে পারেননি। কোনো মানি এক্সচেঞ্জই ডলার দিতে রাজি হয়নি। এদিকে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধারাবাহিকভাবে অভিযান পরিচালনা করছে। এরপরেও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ১০৯ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হলেও খোলাবাজারে হচ্ছে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকায়।
ব্যাংকগুলো নগদ ডলার বিক্রি করার অনুমতি রয়েছে সর্বোচ্চ ১১১ টাকায়। এতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দরের ব্যবধান প্রায় ৭ টাকার বেশি দাঁড়িয়েছে। সাধারণত এসব প্রতিষ্ঠান বিদেশফেরত ব্যক্তি ও পর্যটকদের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করে। গত সপ্তাহে তারা প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকায়। মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে অভিযান চলায় হাতে ডলার থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি কেনাবেচা করছে না এসব প্রতিষ্ঠান।
এদিকে মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৭৫ পয়সা দরে কেনা এবং সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রির সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিন্তু নগদ ডলার এ দামে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে মানি চেঞ্জারগুলো নির্ধারিত দামে ডলার বিক্রিও করতে পারছে না। এতে মানি চেঞ্জারগুলোয়ও ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
ওদিকে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সরকারের নেয়া বিদেশি ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধে আগের চেয়ে এখন বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। বিদেশি ঋণের অর্থছাড় কমছে। রেমিট্যান্সেও গতি ফেরেনি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও চাপে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ ক্রমেই কমে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী এখন ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এক বছরে কমেছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।
রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকায় অবস্থিত মানি চেঞ্জারগুলোয় গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগই বন্ধ। কিছু খোলা থাকলেও লোকজন নেই। ক্রেতারা এলে বলে দেয়া হচ্ছে ডলার নেই। তবে অভিযোগ রয়েছে, মানি চেঞ্জারস ব্যবসায়ীদের অনেকে গোপনে ডলার কেনাবেচা করছেন।
মতিঝিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোয় তীব্র ডলার সংকট। সাধারণ মানুষ ব্যাংকে প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই এখন তারা খোলাবাজারে যাচ্ছেন। সেখানেও প্রয়োজনীয় ডলার মিলছে না। মাঝে কিছুদিন ডলারের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও বর্তমানে আবারো সংকটের মুখোমুখি ডলারের বাজার। ফলে একদিকে ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছেন না, অন্যদিকে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে দেশের বাইরে যাওয়া সাধারণ মানুষও চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুললেও এ শ্রেণির মানুষ মূলত খোলাবাজার থেকেই প্রয়োজনীয় ডলার সংগ্রহ করেন।
পল্টনের মেক্সিকো মানি চেঞ্জারের বিক্রেতা জানান, প্রতি ডলারের দাম ১১৯ টাকায় উঠেছিল। এখন তাদের হাতে কোনো ডলার নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
পল্টনে ডলার ক্রয় করতে আসা মুক্তার বলেন, বেশ কয়েকটি ব্যাংকে ডলার ক্রয়ের জন্য গিয়েছিলাম। তবে সেখানে ডলার না পেয়ে খুচরা বাজারে এসেছি। এখানে ডলারের দাম অনেক বেশি। কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে নিতে হচ্ছে।
ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্য গত কয়েক মাস স্বাভাবিক থাকার পর বর্তমানে তা আবারো বাড়ছে। দাম নির্ধারণ ও বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে যাওয়াকে কারণ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। খোলাবাজারে ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ও খোলাবাজারে ডলার কেনাবেচা বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। প্রবাসীদের দেশে আসা কমেছে। বিদেশি পর্যটকরাও কম আসছেন। এ কারণে ডলারের সরবরাহ কম। এ ছাড়া খোলাবাজার থেকে সবাই ডলার কিনতে পারেন। ব্যাংক থেকে কিনতে পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট করতে হয়। ফলে অনেকেই খোলাবাজার থেকে ডলার নেন। ফলে চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে।
এদিকে, খোলাবাজারে কয়েকদিন ধরেই বেশি দর নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অভিযানে বেশ কয়েকজনকে আটক করে থানায় নেয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ ব্যাংক সাতটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে এবং ১০টি মানি চেঞ্জারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। বেআইনিভাবে মাত্রাতিরিক্ত নগদ ডলার রাখায় ৮টি মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হয়। এতে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
জানা গেছে, দেশে নগদ ডলার নিয়ে আসেন সাধারণত প্রবাসী ও বিদেশ থেকে ফিরে আসা যাত্রীরা। নিয়মানুযায়ী তাদের কাছে যেসব ডলার থাকবে, ফেরার সময় বিমানবন্দরে কাস্টমসে ঘোষণা দিতে হবে। এর মধ্যে ১০ হাজার ডলারের বেশি থাকলে তা ফেরত দিতে হবে ব্যাংক বা মানি চেঞ্জারসে। পরে ব্যবহারের জন্য গ্রাহক নিজের কাছে ১০ হাজার ডলার রাখতে পারবেন। কিন্তু অনেকে দেশে ফেরার পর এর চেয়ে অনেক বেশি ডলার নিজের কাছে রেখে দিচ্ছেন। তারা সেটি বাজারেও বিক্রি করছেন না। ব্যবহারও করছেন না। এতে নগদ ডলারের সংকট বাড়ছে। এ ছাড়া অনেকে ভবিষ্যতে বিশেষ প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে টাকা দিয়ে নগদ ডলার কিনে রাখছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মানি এক্সচেঞ্জ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল শিকদার বলেন, ডলারের সরবরাহ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। যতটুকু আসছে দাম বাড়তে পারে-এমন আশায় তা-ও ধরে রাখছেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংক খোলাবাজারে ডলারের দর বেঁধে দেয়ায় সংকট বেশি হয়েছে। কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরে তারা ডলার কিনতে পারছেন না, আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরে বিক্রিও করতে পারছেন না। এ অবস্থায় আগের মতো ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাহলেই বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকে ডলারের সংকট নেই। বর্তমানে ক্রেডিট কার্ড এবং ডুয়েল কারেন্সি ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করার অবকাশ রয়েছে। ফলে নগদ ডলারের সংকট হলেও সাধারণ মানুষ খোলাবাজারে না গিয়ে যদি এ ধরনের সেবাগুলো ব্যবহার করেন, তাহলে তাদের কোনো ভোগান্তি হবে না।
এদিকে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ডলার নিয়ে সুখবর দিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই ডলারের বাজার পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। রিজার্ভও বাড়বে। তবে ডলারের দাম এতদিনেও স্বাভাবিক হয়নি। রিজার্ভ বাড়ার পরিবর্তে আরও কমেছে। এরফলে দেশের বাজারে ডলারের ব্যাপক অস্থিরতা চলছে।
ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে গতি বাড়েনি। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৭৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার। সে হিসেবে দৈনিক এসেছে ৪ কোটি ৯৩ লাখ ৩২ হাজার ডলার। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪৮ কোটি ডলার। এমন হলে তা আগের মাসের চেয়ে প্রায় ১১ কোটি ডলার কম হবে। আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স ২১ শতাংশ কমেছিল।
-সূত্রঃ মানবজমিন