লেখালেখি

ব্যালেন্স অব করাপশন |||| এডভোকেট অমলেন্দু ধর

ব্যালেন্স অব করাপশন

 ব্যালেন্স অব করাপশন |||| এডভোকেট অমলেন্দু ধর

বাংলাদেশে এখন চলছে ভেজাল বিরোধী অভিযান। কয়েকটি মোবাইল কোর্ট প্রতিদিন বিভিন্ন শহরে অভিযান চালাচ্ছেন। এতে বের হয়ে আসছে আক্কেল গুড়ুম হওয়ার মত ভেজালের নানা কাহিনী। ভেজালের এসব বিবরণ শুনে এত দিন যা খেয়েছি তা ওয়াক করে বমি করতে ইচ্ছে হচ্ছে। পশুর চর্বিতে আলু সিদ্ধ মিশিয়ে বোতল জাত করে তৈরী হচ্ছে খাঁটি গাওয়া ঘি। এক বছর যাবত পানিতে ডুবিয়ে রাখা আম, তেঁতুল, বরই ইত্যাদিতে কীড়া কিল বিল করছে। সেগুলো দিয়ে তৈরী হচ্ছে আচার, চাটনী ইত্যাদি শিশু ভুলানো খাদ্য। ভূট্টার গুড়ো দিয়ে তৈরী হচ্ছে পটেটু ক্রেকার্স। গরু মহিষের পঁচা নাড়ীভুড়ি ব্যবহৃত হচ্চে লাচ্চা সেমাই তৈরীতে। পঁচা গাজর আর মিষ্টি কুমড়ো দিয়ে তৈরী হয় হালুয়া।মেয়াদোত্তীর্ণ সিজলিং দিয়ে তৈরী হচ্ছে চিজবল, ক্রেকার্স ইত্যাদি। গোখাদ্য হিসেবে পরিচিত রাব(চিটা) দিয়ে তৈরী হচ্ছে তথাকথিত শক্তিবর্ধক ঔষধ ও সালসা। ভেজাল খাদ্যকে দেখতে আকর্ষণীয় করার জন্যে ব্যবহার করা হয় বিষাক্ত রঙ। মেশানো হচ্ছে নানারূপ ক্ষতিকর এসেন্স ও ফ্লেভার। পঁচা মাছ মাংসকে তাজা দেখানোর জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছে মানব দেহের জন্যে প্রচণ্ড ক্ষতিকর ফরমালিন। জনপ্রিয় ব্রাণ্ডের লেভেল লাগিয়ে বিক্রয় করা হচ্ছে নকল বিস্কুট। বিস্কুট, ব্রেড ইত্যাদিকে তাজা মচমচে দেখানোর জন্যে ব্যবহার হচ্ছে  বিষাক্ত এমোনিয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত হারে এমোনিয়াম বাইকার্বোনেট। নকল হচ্ছে জীবন রক্ষাকারি ওরস্যালাইন। নামকরা সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ফাস্টফুডের দোকানে বিক্রী হচ্ছে পঁচা, বাসি ক্ষতিকর রঙ ও ফ্লেভার মিশ্রিত মিষ্টি, রুটি ইত্যাদি হরেক রকম খাবার। ওয়াসার টেপের পানি বোতলে ভরে নাম  দেয়া হচ্ছে মিনারেল ওয়াটার। কচি কলা, আম, পেপে, কাঁঠাল ইত্যাদি পাকানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যালস দিয়ে। প্রকৃতি প্রদত্ত ফল বিষাক্ত হচ্ছে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে। মোবাইল কোর্ট যেখানেই যাচ্ছেন মুখোমুখি হচ্ছেনপঁচা, বাসি ও মেয়াদহীন খাদ্য আর নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় হচ্ছে, কিন্তু ভেজাল পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে না।প্রতিদিনের সংবাদপত্রে  ভেজালের নতুন নতুন টেকনিকের সংবাদ বের হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি আজ ওপেন সিক্রেট। টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না, মামলা রজু হয় না, বিল আটকে যায়, দলিল রেজিষ্ট্রী হয় না। সারা জীবন একই অফিসে চাকরি করার পর অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী তার পেনশনের ফাইলটি নড়াতে পারেন না তার এককালীন সহকর্মীর ব্যাক পকেটে কিছু না ঢুকিয়ে।  বলতে পারেন দেশ দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত।

আমাদের গোয়ালারা দুধে পানি মিশিয়ে দুধের ক্রেতাদের ঠকাচ্ছে। প্রতারণালব্ধ টাকা দিয়ে সে মুদির দোকান থেকে তেল কিনছে। খাঁটি সরিষার তেল বলে কথিত এই তেলে সরিষার নাম গন্ধ নেই।  আছে সরিষার ফ্লেভার। কৃষক কাঁকড় মিশ্রিত চাল বিক্রি করে শ্রমিককে ঠকাচ্ছে, শ্রমিক কাজ না করেই ওভার টাইম ডিউটির বিল আদায় করে মালিককে ঠকাচ্ছে। মালিক উতপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে ও ভেজাল মিশিয়ে কৃষকদের মাথা থেকেই তার ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষ নিয়ে জনসাধারণকে হয়রানি করছেন ঠিকই, কিন্তু ঘুষের টাকা দিয়ে তারাও কিনছেন পানি মিশ্রিত দুধ, ভেজাল মিশ্রিত তেল আর কাঁকর মিশ্রিত চাল।সমাজ শিক্ষকদের ঠকাচ্ছে তাদের শ্রম মাফিক পারিশ্রমিক না  দিয়ে। শিক্ষকরা প্রতিশোধ নিচ্ছেন টিউশনি ছাড়া ছাত্রদের পরীক্ষা পাশের উপায় না রেখে। এমনিভাবে
 ২.   
আমাদের দেশের প্রতিটি লোক প্রতিটি কাজে তার প্রতিপক্ষকে ঠকাচ্ছে। কৃষকরা ঠকাচ্ছে শ্রমিকদের, শ্রমিকরা ঠকাচ্ছে মালিকদের, মালিকরা ঠকাচ্ছে ভোক্তাদের, সরকারি কর্মকর্তা তথা সরকার ঠকাচ্ছে জনগণকে আর জনগণ ঠকাচ্ছে একে অন্যকে। গ্রাম্য প্রবাদ আছে, বিষে বিষ কাটে। আবার বীজগণিতের সূত্র অনুযায়ী মাইনাসে মাইনাসে প্লাস। সুতরাং আমরা সবাই যেহেতু একে অন্যকে ঠকাচ্ছি, তাই ধরে নিতে হবে আমরা কেউ কাকেও ঠকাচ্ছি না। অর্থাৎ আমরা দূর্ণীতির একটা ভারসাম্য (ব্যালেন্স অব করাপশন) প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি।

এখন এই ব্যালেন্স অব করাপশনের ফাঁদ থেকে কিভাবে বের হওয়া যায় সে নিয়ে খানিকটা   আলোচনা করা যাক। এই আত্মঘাতি ফাঁদ থেকে বের হতে হলে প্রথমেই এর উৎসের সন্ধান করতে হবে। মাছের পঁচন শুরু হয় মাথা থেকে। সমাজের বা জাতির পঁচন শুরু হয় নেতৃত্ব থেকে। যখন থেকে রাজনীতিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পরিবর্তে কোটিপতিদের আনাগোনা শুরু হয়েছে, তখন থেকেই দুর্নীতি ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করেছে। প্রকৃত রাজনীতিকরা আজ কোনঠাসা। কালো টাকার মালিকরা মোটা অংকের ডোনেশন দিয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর নমিনেশন বাগিয়ে নিচ্ছে। তারা ভোটারদের নানা মিথ্যা প্রলোভন এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে গোষ্ঠিপতি, দলপতি ও মাতব্বরদের নগদে ক্রয় করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হচ্ছেন। আমাদের ভোটাররা ঐসব ধাপ্পাবাজ, চাপাবাজ কালো টাকাওয়ালা ও ধর্মব্যবসায়ীদের ছেলে ভুলানো হিপনোটিজমে ভুলে গিয়ে তাদের পক্ষে ভোট দিচ্ছেন বা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ ভোট বিক্রি করছেন এক কাপ চায়ের বিনিময়ে, আবার কেউ বিক্রি হচ্ছেন একটি প্রতারণাপূর্ণ সালামের বিনিময়ে। আঞ্চলিকতার প্রভাবে ভোট দেন অনেকে, আবার কেউ দেন সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। নির্বাচনে এখন কোন প্রার্থী তার নিজের যোগ্যতার পরিচয় দেন না। তিনি অমুক মরহুম নেতার অনুসারী,তার বাবা তমুক মরহুম নেতার সহযোগী ছিলেন। তিনি অমুক পার্টি করেন, তার বাড়ী নদীর উত্তর পাশে, তিনি অমুক সম্প্রদায়ের লোক, তিনি ক্লাবে এত টাকা চাঁদা দিয়েছেন, ঐ স্কুলে এত টাকা ডোনেট করেছেন, তিনি নিজ খরচে অমুক ছড়ার উপর একটি সাঁকো তৈরী করে দিয়েছেন, সাতবার লণ্ডন, পাঁচবার আমেরিকা, তিন বার জাপান ভ্রমণসহ চল্লিশটি দেশ সফর করেছেন,  অমুক মরহুম নেতার সাথে তার একটি ফটো আছে ইত্যাদি গুণাগুণের ফর্দ দিয়ে লিফলেট ছাড়েন। আমাদের ভোটাররা এসব দেখেই ভোট দেন। তারা প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, আন্তরিকতা, সততা, চারিত্রিক গুণাগুণ ইত্যাদি বিবেচনা করেন না। রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য জানে না, সংসদের কাজ কি, সাংসদেরই বা দায়ীত্ব কি ইত্যাদি বিষয়ে সম্যক ধারণাহীন ব্যক্তিদের আমরা ভোট দেই অবলীলায়। যাকে  ভোট দিচ্ছি সাংসদ হবার মত তার নুন্যতম যোগ্যতা আছে কি না সে বিচার আমরা করি না। আমরা তার  অতীত ক্রিয়া কলাপ নিয়ে ভাবি না। আমরা দেখি প্রার্থীটি কোন মরহুম নেতার সৈনিক এবং তার মার্কা কি,। ব্যক্তি সম্পর্কে বিচার না করে মার্কা, টাকার থলি, ধর্মীয় পরিচয়, আঞ্চলিকতা ইত্যাদি বিবাচনায় ভোট দেয়ার কারণে দুর্নীতিবাজরা নেতৃত্বে চলে আসে। প্রকৃত যোগ্যতা সম্পন্ন ত্যাগী রাজনীতিবিদরা মার খাচ্ছেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এখন কোন সৎ, চরিত্রবান, সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত, ন্যায়পরায়ন ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোক রাজনীতিতে আসছেন না বা নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান না। এরূপ সৎ ও যোগ্যতা সম্পন্ন প্রাথীকে ভোটাররা ভোটও দেন না। সুতরাং নেতৃত্ব চলে গেছে মিথ্যাবাদী, প্রতারক, ধাপ্পাবাজ, মাসলম্যান তথা কালো টাকার মালিকদের হাতে। এতে ফল যা হবার তাই হয়েছে। আমরা  দুর্নীতিতে অনেকবার চ্যাম্পিয়ান হয়েছি।

 ৩.     
দুর্নীতিবাজ নেতৃত্বের অন্যায় সব আদেশ নির্দেশ পালন করতে ও তাদের অন্যায় আবদার মিটাতে গিয়ে প্রশাসন হয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত। ব্রিটিশরা তদানীন্তন ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থায় চালু করেছিল Downwards  Filteration Theory . বিষয়টি এরকম ছিল যে সমাজের উপর তলার কিছু লোককে শিক্ষিত করা হবে। তারপর পানি যেভাবে নীচের দিকে গড়ায়, শিক্ষাও আস্তে আস্তে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রচলিত এই ধারণাটি আমাদের দুর্নীতির ক্ষেত্রে যথাযথভাবেই প্রয়োগ হয়েছে। নেতৃত্ব থেকে শুরু হওয়া দুর্নীতি সমাজের প্রতিটি স্তরে বিস্তৃত হয়ে সৃষ্টি করেছে ‘ব্যালেন্স অব করাপশন’। এই ব্যালেন্স অব করাপশনের গোলক ধাঁধা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভোট দানে সতর্কতা। জনগণকে অবশ্যই ব্যক্তি দেখে ভোট দিতে হবে, মার্কা দেখে নয়। সন্ত্রাসী নিয়ে ঘুরেন, বস্তা ভরা টাকা আছে, আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি পুঁজি করে এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে ভোট চান এসব প্রার্থীদের বর্জন করে চরিত্রবান, প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত; রাষ্ট্র রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান আছে এমন প্রার্থীদের ভোট দিতে হবে। দুর্নীতির কালো থাবা থেকে মুক্তি পেতে হলে দুর্নীতিমুক্ত যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করতে শিখতে হবে। অতীতে ক্ষমতায় গিয়ে কোন দল কেমন কাজ করেছে তা স্মরণ রেখে ভবিষ্যতের প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে।

ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখে অপরাধীদের কারাদণ্ড দিতে হবে। শুধুমাত্র জরিমানা আদায়ই যথেষ্ট নয়। ভেজালের মাধ্যমে কোটি টাকা কামাই করে লক্ষ টাকা জরিমানা দেয়া  কোন শাস্তিই নয়। শ্রমিকদের পরিবর্তে মালিকদের শাস্তি দিতে হবে। একদিকে ভেজাল বিরোধী অভিযান চলছে, অপর দিকে জাতীয় প্রচার মাধ্যমে ভেজাল পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ হচ্ছেন বিভ্রান্ত। তাই বিএসটিআই এর অনুমোদন ছাড়া কোন পণ্যের বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমে প্রচার করা যাবে না মর্মে আইন করতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মত ভেজাল পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করা যেতে পারে। একের দুর্নীতি অপরকে দুর্নীতি করতে প্রলুব্ধ করে, উতসাহ যোগায়। তাই সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রেও ব্রিটিশ প্রবর্তিত ডাউন ওয়ার্ডস ফিলটারেশন থিওরি কাজে লাগবে। নির্বাচিত মন্ত্রি/এমপিরা সৎ হলে সচিবরাও সৎ হতে বাধ্য হবেন। সচিবরা সৎ হলে তাদের অধঃস্তনরা ব্যাপক হারে দুর্নীতি করতে পারবে না। অতএব মাথা থেকেই চিকিতসা শুরু করতে হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। এবার বিজয় দিবসে আমরা প্রতিজ্ঞা করি যোগ্যতা না দেখে কাকেও ভোট দিব না, ভেজাল দ্রব্য কিনবো না, মেয়াদোত্তীর্ণ রঙ মেশানো ও একটা কিনলে দু’টো ফ্রি জাতীয় জিনিষ বর্জন করবো এবং  ভেজাল দ্রব্য কোথাও বিক্রী হতে দেখলে পুলিশে সংবাদ দিব। এভাবে জনগণ সজাগ হলে দুর্নীতি ও ভেজাল সম্পূর্ণ দূর না হলেও অনেকটা ইমব্যালেন্সড হয়ে যাবে।

লেখক—আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী ও কলাম লেখক, সিবিএনএ২৪ডটকমের উপদেষ্টা । বর্তমানে কানাডার ব্রাম্পটন প্রবাসী।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন