ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্তে উত্তেজনা প্রসঙ্গ |||| বিদ্যুৎ ভৌমিক
বেশ কিছুদিন যাবত ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্তে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। একাধিক কারণে চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল, সংক্ষেপে এলএসি) পাশে সেনা জমায়েত করছে। সেই একাধিক কারণের মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হলো তিব্বতকে পুরোপুরি চীনের কবজায় নিয়ে আসা এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ঘেঁষে ভারতের স্থাপনা গড়ে তোলাকে ঠেকিয়ে দেওয়া। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর থেকে এই প্রথম গোটা গালওয়ান ভ্যালির উপরে প্রথম নিজেদের আধিপত্য দাবি করে বসেছে চীন ৷ ফলস্বরূপ ৪৫ বছর পর এই প্রথম দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় পড়ল লাশের স্তূপ । পূর্ব লাদাখে ওই উপত্যকায় ভারতীয় ভূখণ্ড রক্ষা করতে গিয়ে গত ১৫ জুন চীনা বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন ২০ জন ভারতীয় সেনা সদস্য। তারপর থেকেই লাগাতার আলোচনা চলছে দু’দেশের মধ্যে। তবে বিবাদ কিছুতেই মিটছে না। এখনও গালওয়ানে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে চীনের সেনারা। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় আরও সংঘাত এড়াতে বুধবার ভারত ও চীনের মধ্যে মেজর জেনারেল স্তরে বৈঠক হয়। তবে চীনা বাহিনীর চরম একগুঁয়ে মনোভাবের জন্য ভেস্তে যায় সেই আলোচনা। এরপর সোমবার ১৫ জুন রাতে গালওয়ান উপত্যকায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই যে মধ্যযুগীয় কায়দায় সংঘাত হয়েছে, তাতে ভারতের অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে । চীন তাদের সেনারা নিহত হয়েছে স্বীকার করলেও এখনো সংখ্যাটা বলেনি । যে এলাকায় সংঘাত হয়েছে, সেটিকে চীন কখনোই তাদের এলাকা বলে দাবি করেনি । গত সোমবার ১৫ জুন সংঘাতের কয়েক ঘণ্টা আগে দুই পক্ষের কর্মকর্তাদের যে বৈঠক হয়েছিল সেখানেও তারা তেমনটা দাবি করেনি এবং সেখান থেকে তারা নিজেদের তাঁবু গুটিয়ে নেবে বলেও কথা দিয়েছিল । কিন্তু সংঘাতের পর মঙ্গলবার চীনের লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড হঠাৎ একটি বিবৃতিতে বলেছে, ‘গালওয়ান উপত্যকার সার্বভৌমত্ব সব সময়ই আমাদের অর্থাৎ চীনের’।
চীনের এই অনধিকার চর্চা নতুন কিছু নয় । এরা কোনো বিতর্কিত জায়গায় প্রথমে সামরিক উপস্থিতি ঘটায়, তারপর গোটা এলাকার মালিকানা দাবি করে বসে । স্বাধীন তাইওয়ানকে চীন নিজের অংশ বলে দাবী করছে । হংকং এ চীন কঠোরতম National Security Law পাস করে হংকং এর মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করছে । লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশের প্রকৃত সীমান্তরেখা ঘেঁষে কয়েক বছর ধরে দ্রুতগতিতে ভারত রাস্তাঘাটসহ নানা ধরনের অবকাঠামো গড়ে তুলছে। বিষয়টি চীনকে মহা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে । বিশেষ করে এখানে বেশ কিছু সেতু নির্মাণ এবং ভারতের দারবুক-শাইয়োক-দৌলত বেগ ওল্ডি রোড (ডিএসডিবিও) বানানো নিয়ে আপত্তি আছে চীনের । চীনের এই আগ্রাসন দেখেই ভারতকে সতর্ক করলেন সেন্ট্রাল তিব্বত অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রেসিডেন্ট লবসাং সাংগে ৷ লবসাং সাংগের কথায়, ‘যখন চীন তিব্বত দখল করল, তখন মাও সে তুং-সহ অন্যান্য চীনের নেতারা বলেছিলেন, তিব্বত হল হাতের তালু, যা আমাদের দখল করতেই হত ৷ এরপর আমরা বাকি পাঁচ আঙুল বাড়াবো৷ প্রথম আঙুলটি হল লাদাখ৷ বাকি ৪টি আঙুল হল নেপাল, ভুটান, সিকিম ও অরুণাচলপ্রদেশ ৷’এর বাইরেও ভারতের ওপর চীনের ক্রুদ্ধ হওয়ার আরও কিছু কারণ আছে । তার মধ্যে অন্যতম হলো তিব্বত এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বৌদ্ধদের ধর্মীয় গুরু দালাই লামা । চীনের কর্মকর্তারা মাঝে মধ্যেই বলে থাকেন, বৌদ্ধদের পরবর্তী দালাই লামা কে হবেন, তা নিয়ে ভারতের মাথা ঘামানো উচিত নয় । বর্তমান দালাই লামা ভারতভিত্তিক । অগনতান্ত্রিক, মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা লংঘনকারী চীন বৌদ্ধদের ধর্মীয় গুরু দালাই লামাকে স্বীকার না করলেও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বৌদ্ধদের ধর্মীয় গুরু দালাই লামা বিশ্বব্যাপীই শ্রদ্ধা ও ভালবাসার আসনে প্রতিষ্ঠিত । উইঘুরের মুসলিম জনগণ তাদের বাক স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালন করতে পারছেনা ।
ভারতের ওপর হঠাৎ চীনের চটে যাওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হল বৈশ্বিক মহামারী কোভিড–১৯ সংক্রান্ত । করোনাভাইরাস চীন থেকে ছড়ানো এবং এই ভাইরাস মোকাবিলায় চীনের তৎপরতা নিয়ে চীনের ভেতরে ও বাইরে আন্তর্জাতিকভাবে চীনের সমালোচনা হচ্ছে । ভাইরাসটি কীভাবে উদ্ভূত হয়েছে তা অনুসন্ধানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে যে দেশগুলো চাপ দিয়ে আসছে, তার মধ্যে ভারতও আছে । সীমান্তের উত্তেজনার সঙ্গে মহামারি মোকাবিলার যোগসূত্র খোঁজাকে অনেকে অমূলক ভাবতে পারেন । কিন্তু এটি নিশ্চিত যে প্রেসিডেন্ট সি জিন পিংয়ের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ইস্যুতে চীনের ভেতরে ও বাইরে আন্তর্জাতিকভাবে যে সমালোচনার ঝড় বইছে, তা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে এ ঘটনা অর্থাৎ সীমান্তে উত্তেজনা সহায়ক হবে বলে অনেক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। চীনের চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াঙ্গের মৃত্যুর পর থেকে, যিনি চীন সরকারকে আগেই এই ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্ক করেছিল। কিন্তু চীনের সরকার তাতে একদম কান দেয়নি। বরং তার বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল। অবশেষে তার কথা সত্যে পরিণত হয় এবং তাকেও প্রাণ দিতে হয় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে । ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াঙ্গের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় বইয়ে যায় বিশ্বব্যাপী । চীনে সংবাদপএে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই । জানা গেছে, যিনিই চীনের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলছেন তাকেই গ্রেফতার করা হয়েছে । সেদেশের মিডিয়ায় এই বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের খবর সহজে আসতে না দিয়ে, চীন বড়সড় ক্ষতি করেছে গোটা বিশ্বের । চীনের অগনতান্ত্রিক কমিউনিষ্ট সরকার তথ্য চেপে রাখার ক্ষেত্রে বড়সড় ভূমিকা পালন করেছে । এতএব নিজ অঞ্চলে চীন যে নিজের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম, তা যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা. জাপান, দক্ষিন কোরিয়া সহ পশ্চিমা দেশগুলোকে দেখানোও চীনের একটি বড় উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে ।
দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ ভারত ও চীন সীমান্ত সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে পূর্ব লাদাখের এই গলওয়ান উপত্যকা। বিগত ৪৫ বছরের ইতিহাসে প্রাণহানির কুৎসিততম নজির গড়েছে গালওয়ান। ভারত-চীন দুটি দেশে বর্তমানে ২৭৫ কোটি মানুষের বাস । বিশ্ব জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যেকোনো বৈরিতায় লিপ্ত থাকা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য খুবই খারাপ নজির হবে । । বিপুল আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ রয়েছে এই দুই দেশে । আবার উভয় দেশের হাতে রয়েছে অন্তত ৪০০ পারমাণবিক অস্ত্রের বিশাল মজুত । একবার সংঘাত শুরু হলে তা নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতেও পারে । চীন-ভারত সামরিক সংঘর্ষ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ রকম উওেজনাকর পরিস্হিতিতে আলোচনাই একমাত্র সহনীয় পথ । আমরা আশা করি, এ অঞ্চলের অগ্রগতি ও শান্তির বৃহওর স্বার্থে দুপক্ষই উসকানিমূলক কিছু করা থেকে বিরত থাকবেন এবং গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যার সমাধান করতে সচেষ্ঠ হবেন।
সূত্র : বাংলাদেশ ও ভারতের সংবাদপত্র
ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্তে উত্তেজনা প্রসঙ্গ |||| বিদ্যুৎ ভৌমিক || কলামিষ্ট, লেখক ও সিবিএনএ’এর উপদেষ্টা
মন্ট্রিয়ল, ক্যানাডা ২২ জুন ২০২০
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন