হাসান হাফিজুর রহমান শুধু লিফলেট প্রকাশেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। অকৃত্রিম বন্ধু ও রাজনৈতিক কর্মী মোহাম্মদ সুলতানকে নিয়ে তিনি নানা পরিকল্পনা করছিলেন। তাদের যৌথ চিন্তাতে পরের বছর ১৯৫৩ সালে একটি সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নেন তারা। মোহাম্মদ সুলতান ও তাদের আরেক বন্ধু এম আর আখতার মুকুল মিলে পুঁথিপত্র নামে একটি বইয়ের দোকান চালাতেন। সেই পুঁথিপত্রের ব্যানারেই সংকলনটি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হলেও কারোরই হাতে টাকা ছিল না। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদক হিসেবে তখন বিভিন্ন লেখককে তাগাদা দিয়ে লেখা সংগ্রহ করছেন। টাকার অভাবে তিনি তার গ্রামে বাড়ি গিয়ে কম দামে একখণ্ড জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসেন।
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে প্রকাশিত এই সংকলনটিতে যারা লিখেছিলেন, তখন তারা তরুণ হলেও পরবর্তী সময়ে তাদের অধিকাংশই জাতীয়ভাবে পরিচিতি লাভ করেন। সম্পাদকীয় লিখেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’ নামে প্রবন্ধ লেখেন আলী আশরাফ। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিখ্যাত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি এই সংকলনে প্রথম প্রকাশিত হয়। আরেকটি গান লেখেন তোফাজ্জল হোসেন। কবিতা লিখেছিলেন শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালউদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও হাসান হাফিজুর রহমান। একুশের গল্প লেখেন শওকত ওসমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম এবং আতোয়ার রহমান। একুশের ঘটনাপঞ্জি লেখেন কবিরউদ্দিন আহমদ। আরো লিখেছেন সালেহ আহমদ ও তোফাজ্জল হোসেন। একুশের নকশা অংশে লেখেন মর্তুজা বশীর। তিনি বেশ কয়েকটি স্কেচ করেন। বিজন চৌধুরীর আঁকা ইলাস্ট্রেশনও ব্যবহার করা হয়। প্রচ্ছদ শিল্পী আমিনুল ইসলাম। সম্পাদকের সঙ্গে সংকলনটির প্রুফ দেখেন আনিসুজ্জামান। সংকলনটির উৎসর্গপত্রে আনিসুজ্জামানের হাতের লেখাতেই ছাপা হয়, ‘যে অমর দেশবাসীর মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছেন একুশের শহীদেরা, যে অমর দেশবাসীর মধ্যে অটুট হয়ে রয়েছে একুশের প্রতিজ্ঞা- তাদের উদ্দেশ্যে।’
বই আকারে প্রকাশিত সংকলনটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৮৩, প্রথম প্রকাশ হয় মার্চ ১৯৫৩ সালে। পাইওনিয়ার প্রেসের পক্ষে এম এ মুকিত ছিলেন মুদ্রাকর এবং সংকলনটির ব্লক তৈরি করে এইচম্যান কোম্পানি। দাম রাখা হয় আড়াই টাকা। সংকলনটি প্রকাশের পরপরই তা পকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করে এবং প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। প্রেসসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৫৬ সালে সংকলনটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। ভাষা আন্দোলনের সংকলন প্রকাশে সম্পাদককে জমি বিক্রি করতে হয়েছিল যা ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। -সারাক্ষণ