ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

মন নিয়ে ||| মধুবন চক্রবর্তী

মন নিয়ে ||| মধুবন চক্রবর্তী
প্রায় তিন মাস হয়ে গেল আজ পর্যন্ত দেখা হয়নি দুজনের। অর্ণব আর মানালির। তিন মাস ধরে কথা হয় ওদের। তিনশো রকম ভাল লাগার কথা জানিয়েছেন অর্ণব। কথা বলতে বলতে কথার মধ্যে অর্ণবের উপস্থিতি টের পায় মানালি। ফোন না আসলেই উচাটন করে মন। একদিন তো সারাদিন ফোন করে না পেয়ে মানসিক ভাবে খুব অসুস্থ লাগছিল। পরে শুনল, অর্ণবের বাড়িতে নাকি গেস্ট এসেছিল। ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা দেখে জানতে পারল।
কিন্তু এ রকম হওয়ার কারণ? উত্তর খোঁজে মানালি। প্রেম কি তবে নিরবে আসছে? না, ঠিক প্রেম নয়। তবে কি অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে মনালির? সেটাও ঠিক নয় মনে হয়? অর্ণব বাবু অবশ্য বলেছেন ভাললাগার বড় কারণ মানালির সৌন্দর্য। ওর কন্ঠ। যদিও কখনওই সামনাসামনি আসতে চাননি।
ছবিতে দেখেছে মানালি। সুন্দর না হলেও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। বড় সাহিত্যিকদের রোমান্টিকতা তো থাকবেই। তবে কি মানালির মধ্যে ওর গল্পের কোনও নায়িকাকে দেখেন?
যত বারই দেখা করার কথা উঠেছে এড়িয়ে গেছেন। অনেক সন্দেহ, আশঙ্কা এবং বাকিটা অবিশ্বাস, সব মিলিয়ে খানিকটা বিভ্রান্ত মানালি। কেন সামনে আসতে চাইছেন না অর্ণব বাবু? অবশেষে খুব জোরাজুরিতে একদিন রাজি হলেন আসতে।
হাজরা মোরের সামনে গাড়ি থেকে যখন নামলেন, দূর থেকে মানালি দেখলেন আগে এগিয়ে এল দুটো ক্রাচ। তার পর দুটো পা। ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন অর্ণব বাবু। বেশ শ্যামলা রং। চোখে কালো মোটা পুরু ফ্রেমের চশমা। ফেসবুকের ছবির থেকে কম ইম্প্রেসিভ।
গাড়ি থেকে নেমে বেশ খানিকক্ষণ এ দিক ও দিক তাকিয়ে দেখলেন ভদ্রলোক। পকেটে হাত দিয়ে ফোনটা নেওয়ার আগেই রাস্তা ক্রস করে সামনে এগিয়ে এল মানালি— নমস্কার আমি মানালি। আমি আপনারই অপেক্ষায় ছিলাম।
হাসি মুখে নমস্কার করলেন অর্ণব, ‘আজ আপনার তারণায় আসতে হল। আমি এখন খুব একটা বেরোতে পারি না। এক্সিডেন্টের পর থেকে বেরোনো কম করে দিয়েছি। এ বার বুঝলেন তো আসতে চাইছিলাম না কেনো?
এ রকম একজন প্রতিবন্ধীকে একবার দেখে দ্বিতীয়বার আর কেউ দেখতে চায় না। আপনি নিশ্চয়ই চমকে গেছেন। এখন ভদ্রতা করবেন জানি। পরে আর পাত্তা দেবেন না। তাই তো? এটাই হয়। তা ছাড়া আমি দেখতে ততটা সুন্দর নই। সুন্দরী মেয়েরা আমাকে ঠিক পছন্দ করে না। সব মিলিয়ে একটু ভীত ছিলাম আপনার সামনে আসতে।
— আচ্ছা সব কথা কি এখানেই বলবেন? রাস্তার মাঝখানে নয়, চলুন বসে কথা বলা যাক।
— আমাকে নিয়ে এখন একটু মুশকিল হবে আপনার। অর্নব বললেন।
— না না, ঠিক আছে, আমি ধরছি। আপনি চলুন। দুজনে ঢুকলেন বসন্ত কেবিনে। কফি আর কাটলেটের অর্ডার দিলেন অর্ণব। গরম কফির ধোঁয়ায় মানালির বুকের বিভাজিকা, আবেদনময়ী কন্ঠ, চোখের মায়াঞ্জন কেমন যেন ধোঁয়াশা তৈরি করছিল অর্ণবের সামনে। হঠাৎ যেন স্বর্গের অপ্সরীকে দেখছেন। ক্রমশ ঘোর লেগে যাচ্ছিল।
জোর ধাক্কায় থতমত খেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলেন, সাদা উর্দি পরা একটা লোক জিজ্ঞাসা করছেন, আর কি নেবেন? কফি?
একটু অস্বস্তিতে মানালির দিকে তাকালেন। মুচকি হেসে মানালি বললেন, ‘একই রকম আচরণ করতেন ফোনের ওপারে। হঠাৎ চুপ হয়ে যেতেন। কিছু বলতেন না মাঝে মাঝে। ফোন কেটেও দিতেন। আমি কল করলে আবার ধরতেন না। খুব অদ্ভুত আপনি! সামনে দেখলাম সে রকমই।
— আসলে এত সুন্দরীর সামনে কথা কি আসে? মানালি হেসে বললেন,  ‘সুন্দরী? আমি আবার সুন্দরী নাকি? কী যে বলেন।’
— সত্যি বলছি, জীবনে চার জন সুন্দরীর প্রেমে পড়েছিলাম। বেশির ভাগই কুৎসিত বলে সরে গেছে। একজনকে সাহস করে বলেছিলাম। ভাল লাগার কথা।  সে কিছুদিন সম্পর্ক রাখল বটে। তার পর আবার আরেক জনের সঙ্গে হারিয়ে গেল। তবে যে ক’টা দিন ছিল সেটুকুই সুগন্ধ দিয়ে গেছে। যাই হোক এটাই আমার জীবন বা কপাল বলতে পারেন। কিছুদিন মানসিক সংশোধনাগারেও থাকতে হয়েছে। আসলে ওই আর কি!
মানালি বলল, ‘আপনার দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ।’
— কেন আপনাকে বিধছে ?
— জানি না…
কথা বলতে বলতে রেস্তোরাঁর বাইরে সূর্য একেবারেই ডুবে গেল। বাতাসে কফির গন্ধ। গন্ধে চুমুক দিতে দিতে দুজন উঠে পড়লেন। গাড়িতে উঠিয়ে দিলেন মানালি। তার পর টাটা করলেন। প্রথম দেখাতেই কথাগুলো শরীর তৈরি করল। মনের।  হ্যাঁ, মন নামক এক অদৃশ্য দেয়াল। কোথায় থাকে এই মন। মস্তিষ্কে? মননে? না হৃদয়ে? কথা দিয়েই একজনের মন ছুঁয়ে ফেলে যায়? কুতসিৎ মানুষও মন ছুঁয়ে দিতে পারে মন দিয়ে? ছোঁয়া যায়!
শুধু কথা দিয়ে সত্য বস্তুকে অভিজ্ঞতায় ধরে রাখতে গেলে শিল্পীর সঙ্গে প্রথম প্রয়োজন বিভিন্ন তথ্যের অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা। কিন্তু সত্যটা কি! অর্ণব বাবুকে ভাল লাগছে এটা সত্য। সে মনকে কি ছুঁয়ে ফেলছে? এটাও সত্য। কিন্তু এর কোনও তথ্য নেই। মন ছুঁয়ে ফেললে কোনও তথ্য লাগে না। মনস্তত্ত্ব বুঝতে হয় কি? কোনও কারণ লাগে নাকি অকারণ এই ছুঁয়ে যাওয়া।
এ সব ভাবতে ভাবতেই মানালি পৌঁছে গেল বাড়িতে। ফ্রেশ হয়ে লেখালেখি নিয়ে বসল। কালকে আবার অফিসে যাওয়া। অনেক কাজ জমে আছে। কাজটা যেভাবেই হোক শেষ করে ফেলতে হবে। কিন্তু জানে রাতের খাওয়ার পর ফোনটা আবার আসবে। কথা না বললে কেমন একটা অস্বস্তি। ভেবে ঠিক কুল কিনারা পেল না মানালি। একটু মুচকি  হেসে লেখায় ডুব দিল। ‘সাহিত্য দিগন্ত’ পত্রিকায় গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের
ওপর একটা লেখা দিতে হবে। এভাবেই চলছিল ওদের।
কথা আর ভাল লাগার অনুভূতি দিয়ে নরম বসন্ত ডিঙিয়ে মনটা হেমন্তের কাছাকাছি প্রায়। এখন আর বসন্ত কেবিন নয়। হেমন্তেও মনটা বসন্তের ঘরে ঢুকে পড়েছে। সামনে ক্রিসমাস। বড়দিন। ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান  করল মানালি।
চব্বিশে ডিসেম্বর। সকল থেকেই মন প্রফুল্ল। পরের দিন বেরোবে দুজনে। অনেক কসরত করে রাজি করিয়েছে অর্ণবকে। একটু না, বেশ ভালই ঘরকুনো। আজ পর্যন্ত নিজের বাড়িতে আসতে বলেনি অর্ণব। বলেছে খুব অগোছালো ঘর। আমার নাকি পছন্দ হবে না।
যাই হোক রাত এগারোটা বেজে তিরিশ মিনিট। বেশ কয়েকবার ফোন বেজে গেল অর্নবের। ব্যাস্ত হয়তো। সকাল দশটায় ট্রেন। কথা তো বলতেই হবে একবার। হাতের কাজগুলো আর একটু গুছিয়ে নিল মানালি। আর ভাবতে লাগল দিঘার সৈকতে আর একটু চিনে নেওয়া একে অপরকে, কি চায় মনটা। সেটা জানাটাও জরুরি। এ কি প্রেম? নাকি নিখাদ বন্ধুত্ব। বিশেষ বন্ধুত্ব যা ভালবাসায় মাখা। ভালবাসার মধ্যেও তো প্রেম ভরপুর থাকে। হাজার প্রশ্নের উত্তর পেতে চায় মানালি দীঘার সৈকতে। একটু নির্জনে।                             ক্রিসমাস আর বড়দিনের ঠিক সন্ধিক্ষণে উৎসবের আতিশয্যে নির্জনতা কতটা খুঁজে পাবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবু নির্জনতা ঠিকই ধরা দেবে ওদের মাঝে। তা ছাড়া স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে সেভাবে কোথাও বেরোতে পারেনি মানালি। একাকীত্ব আর নিজের জীবিকা নির্বাহের খোঁজ করতে করতেই সময় কখন দু’আঙুলের ফাঁক দিয়ে পেরিয়ে গেছে বোঝেনি। অনেক দিন পর একটু হলেও একা মনে হচ্ছে না। অর্ণব যেন এক উজ্জ্বল উপস্থিতি। মনকে ভিজিয়ে দেয় উত্তপ্ত হলে। মনকে চাঙ্গাও করে।
রাত বারোটা বেজে গেল, সাড়ে বারোটাতেও ফোন ধরছে না কেন অর্ণব! এ বার একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে মানালির। এ রকম তো আগে হয়নি। অন্তত কলব্যাক তো করবে। শরীর খারাপ হল না তো! টেনশনে সেভাবে খেতেও পারল না মানালি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
বিছানায় শরীর তো এলিয়ে দিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরও পায়নি। ঘুম ভাঙতেই দেখে সকাল। ঘড়িতে সাতটা। সর্বনাশ! সময় তো বেশি নেই। আবার ফোন করল মানালি। ওপার থেকে কেউ ধরল না। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল কী যে করবে বুঝতে পারছিল না। দ্বিতীয় কোনও নাম্বার নেই যাকে কল করবে।
হঠাৎ মনে পড়ল, ভাইয়ের নাম্বার দিয়েছিল একবার। নাম্বারটা সেভ করেও ছিল। ভাই ওর সঙ্গেই থাকে বলেছিলেন অর্ণব। তবে ব্যবসার কারণে অনেক সময় বাইরে যেতে হয় ওকে। শৌণক। ওর ভাইয়ের নাম। ইসসসসসস্ খুব ভুল হয়ে গেছে। কাল রাতে যদি একবার মনে পড়ত! ওই নাম্বারে ফোন করল এ বার।  কিছুক্ষণ বেজে যাওয়ার পর বেশ গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে এল— হ্যালো। কে বলছেন?
— আমি মানালি, অর্ণবের বন্ধু।
— হ্যাঁ, বলুন।
— আচ্ছা, ওকে কালকে রাত থেকে ফোনে পাচ্ছি না। উনি কোথায় আছেন একটু বলতে পারবেন? আসলে আমাদের আজকে বেরোনোর কথা। অনেক দেরি হয়ে গেছে। দশটায় ট্রেন। কিন্তু ওকে পাচ্ছি না ফোনে। একটু দেবেন প্লিজ। ওর ফোনে কি চার্জ নেই? ঠিক আছেন তো?
— দাদা তো কাল সকালে বেরিয়ে গেছে বউদির সাথে।
— কী বলছেন? বউদি? বউদি মানে?
— হ্যাঁ বউদি, মানে দাদার স্ত্রী। বউদি তো লন্ডনের একটি স্কুলের টিচার। ছুটিতে ছিল বাপের বাড়িতে। গতকাল তো ওরা লন্ডন চলে গেছে।
— না মানে, আচ্ছা। ঠিকাছে। আসলে আমাকে তো কখনও বলেননি…
— হ্যালো হ্যালো শুনুন, শুনছেন? আপনি কে?  কী হয়েছে? কোথায় যাওয়ার কথা বললেন?    — কিছু না। ঠিক আছে, অনেক ধন্যবাদ। অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল মানালির। ধরতে গিয়েও পারল না।
শীতের দুপুর। নরম রোদ পড়ে মানালির পিঠের ব্যথাটা হয়তো একটু কমবে। কাল থেকে খুব পিঠে ব্যথা হয়েছে ওর। জবা একবার গরম সেক দিয়েছে। তাও বলছে ব্যথা।
শান্তিনীড়ে এখন প্রায় কুড়ি জন মনরোগী। মানালিকে নিয়ে একুশ। গত জানুয়ারিতে শান্তিনীড়ে এসেছে মানালি। অনেকক্ষণ ধরে মানালির চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে জবা। আর মানালি বিরক্ত হয়ে বলছে, চুলটা বেঁধে দে না জবা। অর্ণব আসবে। দিঘা যাওয়ার ট্রেন কিন্তু সকাল দশটায়। রেডি করে দে তাড়াতাড়ি। না হলে আমি ওকে জানাতে পড়ব না আমি ওকে ভালোবাসি।
————————
মধুবন চক্রবর্তী- কবি কণ্ঠশিল্পী টেলিভিশন প্রেজেন্টার
সংবাদটি শেয়ার করুন