মার্কিন পলিসি খোলাসা করে গেলেন বিগান
মিজানুর রহমান || ইঙ্গিত মিলেছিল আগেই। ঢাকা সফরে তা খোলাসা করে গেলেন মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই-বিগান। ভূ-রাজনীতির হিসাব যেন আরো জটিল হচ্ছে। কূটনীতির অন্দরমহলে নানা আলোচনা। ক’দিন বাদেই যুক্তরাষ্ট্রে ভোট। দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পদে কোনো পরিবর্তন আসে কি-না সেদিকে দৃষ্টি সবার। সেই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তার সফরে দেয়া অঙ্গীকারই-বা কতটা কার্যকর থাকবে নির্বাচনের ফল উল্টো হলে? মার্কিন মন্ত্রীর ঢাকা সফর চলাকালে সে প্রশ্নও উঠেছিল। জবাবও মিলেছে।
বলা হচ্ছে মার্কিন ফরেন পলিসিতে নির্বাচন বা নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রভাব খুব একটা নেই। ফলে নির্বাচনের আগে বা পরে, এমনকি নির্বাচনের মুহূর্তেও প্রয়োজনীয় সফর চলমান থাকবে। ওয়াকিবহাল মহলের কাছে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদধারীর ঢাকা সফরের আচমকা কি এমন প্রয়োজন পড়লো?
নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য বিগানের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিকে এ অঞ্চলে অর্থাৎ ভারত এবং বাংলাদেশে ছুটে আসতে হয়েছে, বিশেষ করে ঢাকায়। পর্যবেক্ষণে দৃশ্যমান- মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ঢাকায় আসার আগে নয়া দিল্লিতে দু’দিন কাটিয়েছেন। সেখানে তিনি সিরিজ কর্মসূচিতে কাটিয়েছেন। মোদি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব ছাড়াও পেশাদার কূটনীতিকদের সঙ্গে তার মতবিনিময় হয়েছে। দিল্লিতে দেয়া একটি বক্তৃতায় বিগান একটি প্রবাদ ব্যবহার করেছেন। যাতে চীনের প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
সাউথ এশিয়ান মনিটর এ নিয়ে রিপোর্ট করেছে। সেখানে মোদ্দা কথা ছিল এ অঞ্চলে ভারতের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে ওয়াশিংটনের আগ্রহের বার্তা স্পষ্ট করেছেন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই-বিগান। একই সঙ্গে এ অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী চীনের আধিপত্য বা প্রভাবের বিষয়টি যে প্রবাদ ব্যবহার করে তুলে ধরেছেন, তাহলো- হাতি ঘরে ঢুকে গেছে। এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম।
ঢাকায় মার্কিন মন্ত্রীর সফরটি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণকারী একাধিক পেশাদার কূটনীতিক মানবজমিনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলাপে বলেছেন, সামপ্রতিক সময়ে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশকে কাছে টানতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে দীর্ঘদিনের একটি পারসেপশন বা বদ্ধমূল ধারণা দূর করার চেষ্টা করেছে। তাহলো- এতদিন যাই হোক, এখন আর বাংলাদেশকে দিল্লির চোখ দিয়ে দেখে না যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের বহুল আলোচিত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে দূতিয়ালির জন্য দিল্লিতে ছুটে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ‘ধারণা’টি বাংলাদেশে বেশ প্রতিষ্ঠিত।
সেপ্টেম্বরে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এক ওয়েবিনারে আলোচনার সূত্র ধরে যখন মানবজমিনে খবর ছাপা হয়েছিল দিল্লির চোখে এখন আর বাংলাদেশকে দেখে না যুক্তরাষ্ট্র, তখন এক পাঠক মন্তব্য করেছিলেন, এটা ওয়াশিংটনের অবস্থান হতে পারে, কিন্তু পেন্টাগন এখনো দিল্লির চোখেই বাংলাদেশকে দেখার চেষ্টা করে। বিগান কেন দিল্লি হয়ে ঢাকা এলেন? সেই প্রশ্ন তুলেও অনেকে বলছেন, মুখে যাই বলা হোক, দিল্লির চোখে এখনো বাংলাদেশকে দেখে যুক্তরাষ্ট্র। আর এ জন্যই বিগান বাংলাদেশ বিষয়ে আগে দিল্লির সঙ্গে বিশদ আলোচনা করেছেন। হিন্দুস্তান টাইমসের রিপোর্ট বলছে, মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান ভারত সরকারকে সফরকালে বলেছেন, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আরো বেশি পরামর্শ, আলোচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিচ্ছেন তিনি।
ওই খবরে বলা হয়, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে বৈঠক করেন বিগান। বৈঠক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, মার্কিন মন্ত্রীকে বাংলাদেশ নিয়ে ব্রিফ করেছেন শ্রিংলা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের আরো বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি তুলে ধরেন। কারণ বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের উত্থান হচ্ছে। কট্টরপন্থার পথ থেকে সরে এসেছে। খবরে বলা হয়, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বাড়ছে। বাংলাদেশ ৮০ শতাংশের বেশি সামরিক যন্ত্রপাতি, অস্ত্র চীন থেকে কিনছে। ২০১৮ সালে ভারত সামরিক খাতে বাংলাদেশকে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব দিলেও এক্ষেত্রে এখনো অগ্রগতির জন্য কাজ হচ্ছে। ওয়ান ইন্ডিয়া অনলাইনের খবরে বলা হয়, ভারতের বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলার সঙ্গে বিভিন্ন বৈদেশিক নীতি নিয়ে বিগান আলোচনা করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রিংলার সম্পর্ক বহুদিনের। এক সময় তিনি বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। ফলে তার কাছ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য তিনি পাবেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন বিগান। শ্রিংলা যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম যাই বলুক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সাফ জানিয়েছেন, মিডিয়ায় যাই বলা হোক না কেন, ঢাকাকে দিল্লির চোখে ওয়াশিংটন দেখে না বলেই বিগান ঢাকা সফর করেছেন। মন্ত্রী যেটি বলতে চেয়েছেন, যদি দিল্লির চোখেই দেখতো, তবে ভারত সফর করেই ফিরে যেতে পারতেন মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ঢাকার ওয়াকিবহাল মহল বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার তাগিদ থেকেই যে বিগানের সফর- এটা মানতে হবে। কারণ সফরটি ওয়াশিংটনের আগ্রহেই হয়েছে এবং সেখানে ইন্দো-প্যাসিফিক, সিকিউরিটি কো-অপারেশন, গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে ডিরেক্ট নেগোসিয়েশনে মার্কিন কোম্পানির কাজ পাওয়া, অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগ আকর্ষণসহ স্পর্শকাতর সব বিষয়েই কথা হয়েছে। আর এ কারণেই যৌথ ব্রিফিংয়ে মার্কিন মন্ত্রী বিগান খোলাসা করেই বলেছেন, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কেন্দ্রে থাকছে বাংলাদেশ। ওয়াশিংটন অন্তত তাই ভাবছে। যদিও বাংলাদেশের অবস্থান আসলে কী তা এখনো স্পষ্ট নয়।
-মানবজমিন থেকে
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন