গণমাধ্যমে কেন মুক্তিযুদ্ধ থাকে দুই মাস! |||| সালেক খোকন
জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পালন করছে গোটা দেশ। সামনেই বিজয়ের মাস। প্রস্তুতি চলছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনেরও। কিন্তু দেশে গণমাধ্যমে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো কতটা স্থান পাচ্ছে? সেটি তুলে ধরতেই এ লেখার অবতারণা।
১৯৭২ সালে সারা দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৩০টি। সব ধরনের পত্রিকা ও সাময়িকীর সংখ্যা এখন ১ হাজার ৮৩৪টি। এ ছাড়া ৩০টির ঊর্ধ্বে টিভি চ্যানেল ও অসংখ্য অনলাইন নিউজ পোর্টাল তো রয়েছেই। গণমাধ্যম গণমানুষের ভাবনার জগতে নাড়া দেয়। গণমাধ্যমে যা প্রকাশ পায় মানুষ সে বিষয়ে চিন্তা করে। সহজভাবে বলতে গেলে, গণমাধ্যম মানুষের চিন্তার জগৎকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। এক অর্থে গণমাধ্যম যা ভাবায় মানুষ তাই ভাবে। সে হিসেবে প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনন্য। কিন্তু সেই গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিষয় বা ঘটনাগুলো প্রকাশ বা প্রচার হচ্ছে কি?
মিডিয়াতে বা গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ থাকে কেবল মাত্র দুই মাস। কিছু মিডিয়ার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম থাকলেও তার সংখ্যা খুবই নগণ্য। বাস্তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিকে আমরা পাই আর সকল দিবসের মতোই একটি ইভেন্ট হিসেবে।
মুক্তিযুদ্ধের মাস কি চলে এসেছে? মার্চ ও ডিসেম্বর এলেই পত্রিকায় চোখ রেখে মেয়ে পৃথার মুখে এমন প্রশ্ন ওঠে।
কীভাবে বুঝলে?
এটা তো খুব সহজ। পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কাহিনী লেখা শুরু হয়ে গেছে। অন্য মাসগুলোতে তো সেটি হয় না। মেয়ের কথায় আমি নিশ্চুপ। বিষয়টি পাশ কাটাতে শুধু বললাম উপলক্ষেরও তো প্রয়োজন আছে। কথা শুনে পৃথা মুচকি হাসে।
টিভি চ্যানেলগুলোতে দেশের গান, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনী, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র, নাটক প্রভৃতি দেখলেই বোঝা যায় মাসটা ডিসেম্বর, নয়তো মার্চ। একইভাবে পত্রিকায় যখন প্রথম পাতায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ধারাবাহিক লেখা স্থান পায়, তখনই বুঝতে হবে মাসটি মুক্তিযুদ্ধের। মিডিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে পৃথার মতো এ প্রজন্মের ধারণা ঠিক এমনটিই। মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তরুণ প্রজন্মের এ ধারণা হওয়াটাও কিন্তু সুখকর বিষয় নয়।
বছর দুয়েক আগের কথা। মাসটি ছিল মে। প্রথম সারির একটি দৈনিকের উপসম্পাদকের সঙ্গে বসেছিলাম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের বিষয়ে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্য থেকে তাদের রক্তঝরানো দিনগুলোর আত্মত্যাগের কাহিনী ও ১৯৭১-এ গণহত্যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান লেখার মাধ্যমে এ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার পরিকল্পনার কথাই জানিয়েছিলাম তাকে। সব শুনে তিনি এ উদ্যোগের প্রশংসা করলেন বটে কিন্তু আসল কাজটি এড়িয়ে গেলেন। লেখা প্রকাশে অনীহা পোষণ করলেন। কারণ? তার ভাষায় ‘ডিসেম্বর ও মার্চ ছাড়া মানুষ এটা খাবে না’। ওই দিন তাকে বলেছিলাম ‘মানুষকে ভালো জিনিস খাওয়ার রুচিটা তৈরির দায়িত্বও তো গণমাধ্যমকেই নিতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে শুধু নামকাওয়াস্তে ইভেন্টের মতো প্রকাশ না করে গণমাধ্যমগুলোর উচিত সারা বছরই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ধারাবাহিকভাবে নানা প্রতিবেদন বা অনুষ্ঠান প্রকাশ ও প্রচার করা। কিন্তু নিয়মিতভাবে সারা বছর মুক্তিযুদ্ধের বিষয় স্থান পাওয়া গণমাধ্যমের সংখ্যা আসলে কতটি? এ ক্ষেত্রে সময়, চ্যানেল আই, মাছরাঙা, একাত্তর টিভি ও দু-একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের কথা বলা যেতে পারে। যেখানে সারা বছরই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশের মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্ট করেছে।
চ্যানেলগুলোতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনুষ্ঠান সারা বছরই হতে পারে। কিন্তু সেটি আমরা পাই না। প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে অপরাধবিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় নিয়মিতভাবে, সারা বছর। সেটি যদি নিয়মিত হতে পারে, তবে কেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনুষ্ঠান নিয়মিত নয়! প্রিন্টেড পত্রিকাগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র বা বিশেষ সংখ্যা বের করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি। ডিসেম্বর ও মার্চে সারা দেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপন ও বাণী ছাপানোর হিড়িকও পড়ে যায়। বিশেষ দিবসে বিশেষ সংখ্যা হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সারা বছর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু দুই মাস দায়সারাভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিকে সামনে রেখে কেবল স্পন্সর খোঁজার মাঝে কোন ধরনের চেতনা নিহিত রয়েছে জানা নেই!
দৈনিক পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি কর্নার, চ্যানেলগুলোতে একটি করে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান, অনলাইনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা তথ্যের উপস্থাপনায় বিশেষ উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে খুব সহজেই। শুধু দরকার মিডিয়া মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের আন্তরিকতা আর দেশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও দেশপ্রেমের গভীরতা। আর এটা করা গেলে মানুষের ভাবনার মাঝে যুক্ত হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সংগ্রামের ও আমাদের বীরত্বের কাহিনীগুলো। যা জেনে পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হবে। অন্যথায় মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম গড়া বাস্তবে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের কাজ সত্যিকারভাবে কতটুকু তুলে ধরা হয়েছে? প্রায় একই ঢংয়ে এক চ্যানেলের অনুষ্ঠান অনুকরণে তৈরি হচ্ছে আরেক চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো। গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যত কাজ হয়েছে, তার অধিকাংশই রাষ্ট্রপ্রধান বা বড় বড় নেতাকেন্দ্রিক। কিন্তু গণহত্যার দলিল এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে তৈরি বা প্রকাশিত হয়নি। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশের বয়স ষাটের ঊর্ধ্বে। আগামী বিশ বছরে এদের একটি বড় অংশকে আমরা হারিয়ে ফেলব। একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গল্পই মুক্তিযুদ্ধের একেকটি ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে ধারণ করা ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের গণমাধ্যমগুলো।
গণমাধ্যম খুব সহজেই মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের, বীরত্বের ইতিহাস সারা বছরই প্রচার ও প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম গড়তে সহায়ক হতে পারে। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধকে আর দশটা দিবসের মতোই ইভেন্ট হিসেবে চিন্তা করলে চলবে না। দেশের স্বাধীনতা ও ত্যাগের ইতিহাস আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করতে না পারলে আমরা দেশপ্রেমিক জাতি কীভাবে তৈরি করব?
চ্যানেলগুলোতে এখন বিভিন্ন নামে চলে টক শো। টক শোর বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের কোনো একটি বিষয়কে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে আরো সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় আমরা দেখি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত কোনো বিষয় নিয়ে টক শোজীবীরা আলোচনা করতে গিয়ে এমন সব অবাস্তব তথ্য ও বিষয়ের কথা তুলে ধরেন, যার কোনোই ভিত্তি নেই। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রকৃত সত্য নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা) ও মুজাহিদের মতো যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির সময়ও গণমাধ্যমে যেভাবে সম্প্রচার করা হয়েছে, সেটিও গণমাধ্যমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। রাজাকারদের ফাঁসির সংবাদ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটি কীভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে সে বিষয়ে গণমাধ্যমের অপরিপক্বতাই আমরা তখন দেখেছি। এটি এখন থেমে নেই!
কোনটি নিউজ আর কোনটি নয়, তা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের অদক্ষতা রয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের ইতিহাস প্রকাশে গণমাধ্যমগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। মিডিয়া বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগের কাহিনী তুলে ধরে কিছু উলঙ্গ ও অর্ধ-উলঙ্গ ছবি প্রকাশের মাধ্যমে। প্রশ্ন হচ্ছে, একাত্তরের বীরাঙ্গনা যাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে, তাদের পরিচিত করতে ওই ছবিগুলোকেই কি তুলে ধরা খুব জরুরি?
মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা- এই তিনটি বিষয়কে সমাজের মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রজন্ম গড়তে মিডিয়াকেই সামনে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই, মিডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধ থাকুক সারা বছর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মিডিয়াগুলোও জাগ্রত হোক।
লেখক ও গবেষক
সূত্রঃ সারাক্ষণ
-এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন