ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

মুখোশ || নাজনীন নিশা । পর্ব-১

মুখোশ || নাজনীন নিশা । পর্ব-১

আমার বাবা একজন আদর্শ মানুষ। তাই আদর্শ লিপির আদর্শ নিয়ে বড় হবার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি আমাকে নিয়ে। আর আমিও তাঁর স্বপ্ন পূরণে বিভোর। সদা সত্য কথা বলি, সৎ পথে চলি, যা যা আছে আদর্শ লিপির আদর্শ পাতায়  তার সবকিছুই আমার মধ্যে বিদ্যমান ।

আমার বাবা আর মায়ের নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে, আমি তখন পাঁচ বছর বয়সী ছোট্ট এক কিশোর।  কিন্তু কিশোর বয়সের সেই দুরন্তপনার  সবটুকুনই আমার ভেতরে দানা পাকিয়ে থাকলেও আমি তার খুবই অল্পস্বল্প পরিমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতাম। মায়ের কথা আমার যৎসামান্য মনে আছে। মা কোথায় আছেন, কেমন আছেন এসবের কিছুই আমি জানিনা, এমনকি বাবা কিংবা আত্মীয়স্বজন কারো মুখে আমি কোনোদিন শুনিনি আমার মায়ের কথা। তবে বড় হবার পর প্রতিবেশী বন্ধুদের দু’একজন আমাকে ইনিয়েবিনিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল আমার মা কোন পরপুরুষের হাত ধরে ভেগে গিয়েছিলো কিনা বাবার অত্যাচার সইতে না পেরে। ভেগে গিয়েছিলো কথাটা আমাদের পরিবারের সাথে নাকি খুবই বেমানান।  কিন্তু তারপরেও আমাদের পরিবার নিয়ে এমন রটনা শুধু আমাদের মহল্লার ভেতরেই আছে।

আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন ছোটখালা একবার খুব আদর করে আমাকে আমার স্কুলের সামনে থেকে বেড়াতে নিয়ে যাবে বলে নানুর বাসায় নিয়ে গিয়েছিলো। সেখানে গিয়ে খুব আনন্দ করেছিলাম আমার খালাতো ভাইবোন যারা আমারই সমবয়সী তাদের সঙ্গে। নানুমনি আর নানাভাই আমাকে কোল থেকে নামতে দিতেই চাইছিলেননা । নানুমনি তাদের বাসার একটি ছবির অ্যালবাম বের করে আমার মায়ের সঙ্গে তোলা অনেক ছবি আমাকে দেখিয়েছিলেন। আমার মা খুব সুন্দরী ছিলেন। ছবিগুলো তাই বলে।  সেখান থেকে মায়ের সঙ্গে তোলা আমার একটি ছবি আমি আমার স্কুল ব্যাগ এ করে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম।  তারপর বাবার কাছে ধরা পড়ে যাই।  বাবা ছবিটা সরিয়ে ফেলেন। সে ছবি আমি আর কোনদিন দেখতে পাইনি। তবুও মা শব্দটির প্রতি রয়েছে আমার অগাধ বিশ্বাস, শ্রদ্ধা আর অপরিসীম ভালোবাসা ! কোথায় যেন কিঞ্চিৎ পরিমান একটা হাহাকার আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করতে থাকি আমার মায়ের অনুপস্থিতিতে !

সেদিন ভর সন্ধ্যায় আমি পড়ার টেবিলে মাথা গুঁজে পড়ছিলাম চোখ কান বন্ধ করে। পাশে কি হচ্ছে আমার তা জানা নেই। হঠাৎ বাবা কিছুটা চড়া গলায় আমাকে ডাক দিলেন —  “বাবু এদিকে আসো”  আমার নাম বাবর, কিন্তু বাবর নামটা কেটেছেঁটে জন্মের পর থেকে আজ অব্দি বাবা আমাকে বাবু নামেই ডাকছেন, ওনার দেয়া এই নাম আমার খুবই অপছন্দের হলেও আমি আদর্শে মানুষ হয়েছি তাই ওনার মুখের উপরে এ নাম নিয়ে কোনদিন রা’ শব্দটা করতে পারিনি। বাবার ডাকে সাড়া দিয়ে বৈঠকখানার দরজায় পা ফেলতেই বাবা তার অপরদিকের সোফার দিকে  হাত বাড়িয়ে বললেন তোমার চাচা আর চাচী, সালাম কর । আমি এক পলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে চাচা আর চাচির পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম, তাঁরা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন সালাম লাগবেনা, ততক্ষনে আমার সালাম শেষ। পাশে একটি মেয়ে বসা ছিল এক পলক তাকানোতে যা বুঝলাম, কিন্তু আমি ভালো করে তাকাইনি, আমার আদর্শে সেটা অভদ্রতামি। চাচা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন তুমি এখন কিসে পড়ছো বাবা?  চাচার কথার জবাবে বাবা উত্তর দিলেন – ওতো এখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আছে একাউন্টিং অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ।  মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েট দুটোতেই ষ্টার মার্কস ছিল।

ছেলেবেলায় আমি স্কুলে পড়ার সময় আমার ক্লাসের বন্ধুদের বেশিরভাগই বলতো তারা ডাক্তার হবে, দুএকজন বলতো তারা ইঞ্জিনিয়ার হবে, তাদের মত আমারও মনে হত আমিও  ডাক্তার হবো, কিন্তু ইচ্ছের কথা মুখে বলতে হয় সেটা আমার জানা ছিলোনা। তাই বাবার ইচ্ছেতেই আজ আমি একাউন্টিং বিষয়ে অনার্স করছি। বাবার উত্তর দেয়া শেষ হলে আমি বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এসে আমার পড়ার টেবিলে আবারো মননিবেশ করলাম। আমার এই ছোট্ট এক চিলতে ঘরের দেয়ালের গা ঘেঁষে লাগানো মাঝারি আকৃতির প্রতি ঘন্টায় টুংটাং শব্দ করে বেজে ওঠা ঘড়িটার টুংটাং শব্দে বুঝলাম রাত ৮’টা বেজে চলছে।  শব্দটা গুনে গুনে আট বার শব্দ করেছে।  ঘড়ির টুংটাং করা শব্দটা শেষ হতেই আরেকটি শব্দে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম কিছুক্ষন আগে বৈঠকখানায় চাচা চাচির পাশে যে মেয়েটি বসা ছিল সেই মেয়েটি এখন আমার রুমের বইয়ের তাক থেকে একটা একটা করে বই নামিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে আবার তা তাক বরাবর উঠিয়ে রাখছে, আমি কয়েক মিনিট সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম,  আমার চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি আমাকে বললো আপনি কার বই পড়তে বেশি ভালোবাসেন ?  আপনার নাম বাবু ? আমি তাহলে আপনাকে বাবু ভাই বলে ডাকবো, কিন্তু বাবু আবার ভাই হয় কি করে ? নিজের কথায় মেয়েটি নিজেই মুখ টিপে হাসলো। মেয়েটিকে এবার আমি পলক ফেলে একটু ভালো করে দেখতে লাগলাম, আর তা দেখার একমাত্র কারণ উত্তর না পেয়েও ও আমাকে এতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে কেন করে যাচ্ছে তাই।

একটু পরেই যেন বাবার সেই ডাক বাবু ۔۔বাবু ۔۔۔কানে এলো।  বাবা ডাকছেন, আমি মেয়েটিকে আমার রুমে ছেড়ে চলে গেলাম বাবার ডাকে সাড়া দিতে, বাবা ততক্ষনে আমার সেই চাচা চাচীকে সঙ্গে নিয়ে টেবিলে রাতের খাবার খাবেন বলে  বসে আছেন, তাদের সহযোগিতা করছেন বাসার কাজের বুয়া জোৎস্না খালা।  জোৎস্না খালা দারুন রূপসী !  রূপের সঙ্গে তার নামটা দারুন মানিয়েছে। তার চেহারা এবং কাপড়চোপড় দেখলে আলাদা করে বোঝার উপায় নেই যে সে আমাদের বুয়া নাকি কোন পরম আত্মীয় ! বাবা আমাকে ডেকে তার পাশের চেয়ারটায় বসতে দিলেন বরাবরের মতন, টেবিলের অন্যপাশের চেয়ার দুটোতে চাচাচাচি বসে আছেন, বাবা বললেন কিরে শৈলী কোথায় ?  প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু পরে আর বুঝতে বাকি রইলোনা যে চাচা চাচির সঙ্গে আসা  মেয়েটির নাম শৈলী । বাবা জোৎস্না খালাকে বললেন বুয়া দেখতো শৈলী কি করে ? ওকে খেতে আসতে বল, ততক্ষনে শৈলী নিজেই চলে এলো খাবার টেবিলে,  খালি চেয়ার দুটোর একটি টেনে বসে পড়লো। বাবা শৈলীকে ওর ছেলেবেলা  থেকেই জানেন।

খাবার টেবিলের গল্পকথার অধিকাংশই আমাকে নিয়ে  বাবা বলে গেলেন । মাঝে মাঝে চাচাও  বললেন তার মেয়ে শৈলী এবং তার বড় বোন রিয়াকে নিয়ে, যে কিনা স্বামী সন্তানসহ বিদেশে আছে সেই বিয়ের পর থেকেই। এভাবেই গল্প কথার মাঝে আমাদের সেদিনের রাতের খাবার পর্বটা শেষ হলো। খাবার শেষ হতেই চাচাচাচি আর দেরি না করে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ।

রাত ঠিক ১২ টা নাগাদ বাড়ির একমাত্র ফোনটা ক্রিং ক্রিং শব্দ করে বাজতে  লাগলো, আমাদের কাতর ঘুমটা ভেঙে গেলো এই ভয়ানক ফোনের শব্দে।  আমি যাবার আগে বাবা গিয়ে ফোনটা তুলে হ্যালো বললেন, আমার রুম থেকে আমি স্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম বাবার সে শব্দ।  কিন্তু ওই পাশের কণ্ঠস্বরটা কার ছিল আমি তা জানিনা, এবং জানার প্রয়োজনবোধ না করে তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।

চলবে…

 



সংবাদটি শেয়ার করুন