মৃত্যু ।।।। শিতাংশু গুহ
মৃত্যু নিত্য, অমোঘ সত্য। একটা সময়ে মানুষ মৃত্যু’র কথা ভাবে বটে! কিশোর কুমারের সেই গান, ‘আমি নেই, ভাবতেও ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যায়–। কিছুক্ষন আগে একজন মানুষ ছিলেন, এখন নেই, তাঁর শেষ যাত্রার প্রস্তুতি চলছে, ফুল-চন্দনে সাঁজিয়ে তাঁকে চিতায় তোলা হবে, ‘চিতাতেই সব শেষ’, ‘এই তো জীবন’। জীবন অনিত্য, মায়া। ৩১শে জানুয়ারী ২০২৩ সকালে অফিসে যাবার সময় শবদেহ বহনকারী একটি কালো মার্সিডিজ দেখ্লাম, ভাবলাম আমিও একদিন এমন একটি মার্সিডিজে শেষযাত্রা করবো, সাথে পুত্রকন্যা-স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব, সুহৃদ, হয়তো আরো অনেকে। এক সময় সব শেষ হয়ে যাবে, সবাই ঘরে ফিরবে, আমি ফিরবো না, আমি হবো অনন্ত পথের যাত্রী!
আমি না থাকলে কি এমন ক্ষতি? কিচ্ছুনা, আমি ফ্রেমবন্দী হবো, প্রিয়তমা স্ত্রী স্মরণ করবে, একদিন তিনিও গত হবেন। এরপর সব শেষ। পুত্রকন্যা হয়তো প্রথম প্রথম বাবার কথা মনে করবে, কালের নিয়মে তারাও ব্যস্ত হয়ে পড়বে, বছরে একটি, দু’টি ফুল দিতেও পারে, আবার নাও পারে। আমি কি আমার পিতামাতাকে দেই ? আমার বাবা নেই ৩৪ বছর, মা গত হয়েছেন ১৮ বছর, আমরা কতটুকু স্মরণ করি? এটাই বাস্তবতা। ‘এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায়’-তবু যেতে হয় বটে! পৃথিবীটা জীবিতের জন্যে, মৃতের জন্যে নয়। মানুষ মরে গেলে তাঁকে নিয়ে যত ‘আচার’ সবই জীবিতের জন্যে, যত তাড়াতাড়ি মৃতদেহ ‘অপসৃত’ হয় (করা যায়) ততই মঙ্গল।
বাবা একটি গল্প বলতেন। গ্রামাঞ্চলে এক দম্পতি চার দশকের বেশি সংসার করার পর এক ঝড়ো রাতে স্বামী মারা যান। বাড়িতে তখন স্ত্রী ও এক দেবর। ঝড়বৃষ্টি থামছে না, শবে’র শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে হবে, দেবর বললেন, বৌদি, তুমি থাকো, আমি পাড়া-পড়শী, লোকজন ডেকে নিয়ে আসি। বৌদি কান্না জড়িত কণ্ঠেই বললেন, ‘ঠাকুরপো, তুমি যেওনা, আমি ‘একা’ থাকতে পারবো না! কিয়ৎ আগেও স্বামী ছিলেন, মারা গেছেন, দেহ চোখের সামনে, অথচ স্ত্রী নিজেকে একলা ভাবছেন, এটি বাস্তবতা, নির্মম সত্য। আমি কি মৃত্যু’র কথা ভাবছি? হয়তো, যেতে তো হবে! ‘দিন্ তো গেল সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে–’। আমাদের বাবা-মা যথেষ্ট বয়সে মারা গেছেন, আশির ঊর্ধ, এর মানে এই নয় যে, আমরাও দীর্ঘজীবী হবো। আমার পরের ছোটভাই স্বপন পঞ্চাশেই চলে গেছে।
সেই তুলনায় আমি বহাল তবিয়তে আছি। আমার বড়দা হিমাংশু, বা মেঝদা প্রেমাংশু ৮০ বা একটু কম, তাঁরা ভালোই আছেন, বড়সড় তেমন অসুখ নেই? বড়দি ‘ডলি’ তো সবাইকে বিট করছেন, মেঝদি ‘পলি’ও তাই! তবে বলছিলাম যে, একটা বয়সে কোন কিছুর বিশ্বাস নেই! আমি কি বেশিদিন বাঁচতে চাই? আমি ব্যায়াম করি, সাঁতার কাটি, দেহ মোটামুটি ভালো। অনেকে বলেন, ব্যায়াম-ট্যায়াম করে বেশিদিন বাঁচতে চান? তাঁদের বলি, যতদিন বাঁচি, সুস্থভাবে বাঁচতে চাই’। মানুষ না মরলে কি হতো? জীব না মরলে কি হতো? সত্যযুগে নাকি জীব মরতো না, তাই জীবের ভারে পৃথিবী জলের নিচে তলিয়ে যায়? কেন মরতো না? কারণ যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি মারেন কিভাবে? অর্থাৎ স্রষ্টা তাঁর নিজের হাতেই মৃত্যু মন্ত্রণালয়টি রেখেছিলেন, তিনি দয়ার শরীর, তাছাড়া নিজের সৃষ্টিকে কেউ ধ্বংস করে? কূর্ম (কচ্ছপ) অবতার পৃথিবীকে জলের তলা থেকে উঠিয়ে আনেন, এবং এরপর থেকে ‘মৃত্যু’ মন্ত্রণালয় ‘যমরাজ’-র হাতে যায়।
‘দয়াল, দিন যে গেলো, সন্ধ্যা হলো, পার কর আমারে’-ছেলেবেলায় আমরা বুড়োদের মুখে এগানটি শুনতাম। এর সুরটি বিষাদের। দৃশ্যটি এরকম, বৃদ্ধ নদীর ঘাটে বসে আছেন, কখন নৌকা আসবে, তিনি নদী নামক সংসার পার হবেন। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, এ যাত্রা অগ্যস্ত যাত্রা। পৃথিবী থেকে বিদায়। ওই যে গান, ‘আমি নাই, ভাবতেও ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যায়’। ‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’? সবাই যায়, যেতে হয়, কোথায় যায়? কেন যায়? মানুষ শুধু তাঁর ‘মধ্যভাগ’ জানে, আদি বা অন্ত জানেনা, জানেনা কোথা থেকে এসেছে, কোথা যাবে? শুধু মধ্যভাগ নিয়ে যত বাহাদুরী, অহমিকা, গরিমা। একদিন সব থেমে যায়? এইতো জীবন, চিতাতেই সব শেষ! এই যে অভিব্যক্তি, ‘পরের জায়গা, পরের জমি, ঘর বানিয়ে আমি রই’ -এটিই একমাত্র সত্যি।
পৃথিবীতে কিছুই আমার নয়, ‘সবকিছু পিছে পরে রবে’। তবু মানুষ বাঁচতে চায়? ‘মরলেই বাঁচি’ এ কথাটার মধ্যেও বাঁচার আকুতি, মরেও বাঁচার চেষ্টা? মানুষ যদি না মরতো তাহলে কি হতো? এজন্যেই বিধির বিধান, ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’। প্রাণী জগতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একের সাথে অন্যের ‘খাদ্য-খাদক’ সম্পর্ক। এটিও সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার্থে। ‘কা তব কান্তা’, কে কাহার? আজ যে আমরা সামাজিক বন্ধন দেখি, সবই তো মায়া, মানুষ নিজের প্রয়োজনে তা সৃষ্টি করেছে। আমার ঘর, আমার বাড়ী, এই যে আমার বা আমি, ইনি কে? এই আমি কে? আমি কি দেহ? নাকি এই আমি আত্মা? বলা হয়, দেহ নশ্বর, মৃত্যু’র অধীন। ‘আত্মা অবিনশ্বর’, আত্মার মৃত্যু নেই? তা, এই আত্মা থাকেন কোথায়? # [email protected];