বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, মেজর সিনহা হত্যার পর অগাস্ট মাসে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে মাত্র একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জানা গেছে। সংস্থাটি জানাচ্ছে, অগাস্ট মাসের হিসাব এখনো পুরোপুরি জানা না গেলেও এমন হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা হঠাৎ করেই কমে গেছে বলে তারা দেখেছেন।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে চলতি বছর প্রথম সাত মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন।
অগাস্ট মাসে এ পর্যন্ত যে হত্যার খবরটি জানা গেছে তাতে গত দোসরা অগাস্ট রাতে সিলেটের জকিগঞ্জে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে আব্দুল মান্নান ওরফে মুন্না আহমদ নামে এক ব্যক্তি নিহত হন।
জকিগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায় জানান, নিহত ওই ব্যক্তি একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। তার নামে মাদক, ডাকাতি ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১২টি মামলা ছিল।
তিনি বলেন, তাকে আটকের পর মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারে বের হলে অজোগ্রাম নামে এলাকায় তার সহযোগীরা পুলিশের উপর গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হন তিনি এবং পরে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ওই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় সাত-আট জন পুলিশ সদস্যও আহত হলে তাদেরকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই মাসেও সারা দেশে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৫০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে যার মধ্যে ৪৭টি ছিল বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা।
এছাড়া জুন মাসে ২৮টি, মে মাসে ২৯টি, এপ্রিলে ১৬টি, মার্চ মাসে ৩৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ২৬টি এবং জানুয়ারিতে ২৩টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যার মধ্যে বেশিরভাগই নিহত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে।
সংস্থাটির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে মোট ৩৮৮টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তার মধ্যে সংখ্যার হিসাবে সবচেয়ে কম ছিল ওই বছরের নভেম্বর মাস। ওই মাসে ১৫টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আর ২০১৯এ সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে মে মাসে, যখন ৪৮টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে মোট ৪৬৬টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে নভেম্বর এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৩৬টি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
সবচেয়ে কম হত্যাকাণ্ড হয়েছে ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে (৯টি)। এছাড়া জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ৪৬টি থাকলেও এর পরের কয়েক মাসে তা বহুগুণে বেড়ে যায়। বছরের অষ্টম মাসে এসে মোট হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬১টিতে।
সংখ্যার হিসাব করলে দেখা যায় যে, গত দুই-তিন বছরে সবচেয়ে কম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে চলতি বছরের অগাস্ট মাসে।
গত ৩১শে জুলাই কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার ঘটনার পর পরই পুরো বাংলাদেশেই ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা আশ্চর্যজনকভাবে কমে এসেছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে যাওয়ার ঘটনা ইতিবাচক হলেও বিষয়টিকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন মানবাধিকারকর্মী ও মানবাধিকার আইনজীবীরা।
তারা আবারো বন্দুকযুদ্ধ এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা এবং বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, প্রথম বার্তাটি হচ্ছে এই ধরণের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী সম্পূর্ণভাবে যুক্ত।
“আর এই সংশ্লিষ্টতা যে দুর্ঘটনা না বরং এক ধরণের পরিকল্পিত সেটিই প্রমাণ করে।”
তার মতে, গত এক যুগ বা দেড় যুগ যদি বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে কখনোই দেখা যাবে না যে মাসে একটি মাত্র ঘটনা ঘটেছে। বরং অনেক ঘটনাই প্রতি মাসে প্রত্যক্ষ করা গেছে।
মি. খান মনে করেন, হঠাৎ করে মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের পর জনগণের ভেতর ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এবং প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশল কিনা এবং ভবিষ্যতে কী হয়, সেটি দেখার বিষয় বলে মনে করেন তিনি।
“এই ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট যে রাষ্ট্রের দুর্বলতার কারণে হোক বা প্রচ্ছন্ন সহযোগিতার কারণে হোক এই ধরণের ঘটনা ঘটে এসেছে এতোদিন,” বলেন তিনি।
হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ও আইনজীবী এলিনা খান মনে করেন যে, দুটি কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমে যেতে পারে। তার মধ্যে একটি হতে পারে যে, রাষ্ট্রের হয়তো বোধোদয় হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাষ্ট্র মনে করছে যে, মেজর সিনহার ঘটনার পর এ ধরণের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদক ব্যবসায়ী নাম দিয়ে যে সমস্ত ক্রসফায়ার করতো, মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যার ঘটনার পর অনেক সাধারণ মানুষও নানা ধরণের অভিজ্ঞতা সামনে নিয়ে এসেছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানরা হয়তো বুঝতে পেরেছেন, জনমনে যে ক্ষোভ ছিল তার আউটবার্স্ট হয়েছে, বলেন এলিনা খান।
“কারণ এমনটা হতে পারে না যে, মানুষ অপরাধ করা ছেড়ে দিয়েছে বা যারা মাদক ব্যবসা করতো তারা সেগুলো হঠাৎ করে বন্ধ করে দিয়েছে।”
“সিনহা সাহেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বোঝা গেছে যে এদেশের বর্তমান বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অবস্থাটা কী? নিরীহ মানুষ কীভাবে এগুলোর শিকার হচ্ছে এবং মাদকের নাম করে যেখানে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের হেনস্থা করছে, টাকা-পয়সা গড়ছে, এবং তারা কীভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে।”
একই সাথে তিনি এটিও বলেন যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড উদ্দেশ্যমূলক এবং এর কোন দরকারই নাই।
“একটা দেশের সুশাসন, বিচার ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র যখন সুন্দর ও সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তখন সে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রশ্নই আসে না।”
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী নীনা গোস্বামী বলেন, হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে ভাল লক্ষণ। তবে এটি যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
“নীতিনির্ধারকরা যদি সিদ্ধান্ত নেন যে এধরনের ঘটনা আর ঘটবে না, তাহলে সেটা ইতিবাচক। কিন্তু এটা যদি এমন হয় যে আপাতত বন্ধ থাক, পরে আবার শুরু হবে, তাহলে সেটা হবে দুঃখজনক,” মন্তব্য করেন নীনা গোস্বামী।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
বাঅ/এমএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন