মৌলভীবাজারে উজাড় হচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ, ওদের থামাবে কে?
ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে ।। কি ছিল আর এখন কি? দিন দিন কোথায় যাচ্ছে মৌলভীবাজার জেলার জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। কেন প্রতিনিয়ত চোখের পলকেই অদৃশ্য আর উজাড় হচ্ছে এ জেলার চিরচেনা পরিবেশ ও প্রাণ প্রকৃতি। এত এত সরকারি-বেসরকারি সংস্থা-সংগঠন। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ওদের ভূমিকাই বা কি? এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন প্রবীণ ও সচেতন প্রকৃতিপ্রেমীরা। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলছেন নেপথ্যের ওই প্রভাবশালীরাতো খুবই পরিচিত জন। তারাই রক্ষক। তারপরও কেন জনসম্মুখে ওদের মুখোশ উন্মোচন হয় না? ওই চক্রের কবল থেকে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায় না। এভাবে চলতে চলতে এখনতো তা ধ্বংসের দোরগোড়ায়। তারপরওতো টনক নড়ে না কারও। জেলাজুড়ে পাহাড়ি টিলা কেটে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বাড়ি।
হোটেল আর নামিদামি রিসোট। শ্রেণি পরিবর্তন করে হচ্ছে নানা ফলজ বাগান। অবৈধ পন্থায় দেদারছে উত্তোলণ হচ্ছে বালু। প্রকাশ্যে দিনেদুপুরে কিংবা রাতের আঁধারেই কাটা হচ্ছে রিজার্ভ ফরেস্টের নানা দুর্লভ গাছ।
শুষ্ক মৌসুমে কৌশলে দখলের উদ্দেশ্যে আগুন দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে পাহাড়ি বন। ভরাট হচ্ছে নদী, হাওর, জলাশয়, গাঙ ও খাল। বাসস্থান ও খাদ্য সংকটে লোকালয়ে ধরা পড়ছে বনজ প্রাণি। এমনি করে প্রভাবশালীদের খপ্পরে অযত্ন আর চরম অবহেলায় ধ্বংসের দোরগোড়ায় এ জেলার চিরচেনা জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ। অভিযোগ উঠেছে জনপ্রতিনিধি, বন বিভাগ আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটই এর জন্য দায়ী। জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে পাহাড়ি টিলা কাটা ও অবৈধ বালু উত্তোলনে ১ম স্থানে আছে শ্রীমঙ্গল, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ। কিন্তু ওই এলাকাগুলোতে ২-১টি লোক দেখানো অভিযান ছাড়া নেই কোনো স্থায়ী প্রতিকার। অথচ বছরজুড়ে প্রতিদিনই এই অবৈধ কর্মযজ্ঞ জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের নাকের ডগায় চললেও রহস্যজনক কারণে তারা থাকছেন নির্বিকার। দৃষ্টিনন্দন, দুর্লভ ও বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্র্য আর প্রাকৃতিক পরিবেশের মৌলভীবাজার এমন সুনামের ঐতিহ্য এখন হারাতে বসেছে। আবাসস্থল ও খাদ্য সংকটে মহা হুমকিতে থাকা জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় নেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ।
আর যেগুলো আছে তা কেবল কাগজে কলমে। তাই ক্রমেই এসংকট আরও ঘণীভূত হচ্ছে। জেলার হাওর, নদী ও গাঙগুলি নাব্যহ্রাস আর দখল, দুষণে অস্তিত্ব সংকটে। এতে মহা হুমকিতে পড়ছে জলজ উদ্ভিদ, প্রাণি ও জীববৈচিত্র্য। ২৭৯৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ৭টি উপজেলা আর ৬৭টি ইউনিয়নের এ জেলা পাহাড়ি টিলা, নদী ও হাওর বেষ্টিত। ইতিমধ্যে অনেক নদী ও হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হলেও কোনো রকম টিকে আছে ৩টি হাওর ও ৬টি নদী। দেশের সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকি আর কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওর। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের হাওরগুলির নানা জীববৈচিত্র্য, জলজপ্রাণি ও উদ্ভিদের নিরাপদ আবাসস্থল এখন মহা হুমকিতে। নানা সংকট ও সমস্যায় কোনো রকম অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে মনু, ধলাই, ফানাই, সোনাই, কন্টিনালা ও জুড়ী নদী। আর বরাকের মতো অনেক খরস্রোতা নদীও এখন নিশ্চিহ্ন প্রায়। দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদনের অন্যতম উৎস শতাধিক গাঙ, খাল ও ডোবা অনেক আগেই বিলীন। দূর্লভ ও বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণির অভয়াশ্রম ‘বৃষ্টিবন’ হিসেবে খ্যাত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও পাথারীয়া রির্জাভ ফরেস্ট এখন প্রাণিকুলের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে নানা কায়দায় প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের ছত্রছায়ায় প্রভাবশালীরা দখল করছে রির্জাভ ফরেস্টের জায়গা। চুরি হচ্ছে গাছ। উজাড় হচ্ছে বন্য পরিবেশ। জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে সড়ক থাকায় দ্রুতগতির বাস, ট্রাকসহ অন্যান্য গাড়ি ও ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে প্রায়ই মারা যাচ্ছে নানা প্রজাতির প্রাণি। সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের ৩৩ কেভি গ্রিড লাইনে প্রাণ যাচ্ছে বন্য প্রাণির।
জলচর পাখির জলকেলী। জলজ উদ্ভিদ আর প্রাণির প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস। দেশীয় নানা প্রজাতির ঝাঁকে ঝাঁকে মাছের অবাধ বিচরণ। এমন মনোহর দৃশ্যের এখন ছন্দপথন। দেশের সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকি আর হাইল হাওরের বাইক্কা বিল। অতিথি পাখির জন্য জেলার বিখ্যাত স্থান দু’টিতে নেই সেই পাখির দল। এখন পাখিপ্রেমী দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়লেও প্রতিবছরই পরিসংখ্যান ছোট হচ্ছে পরিযায়ী ও দেশীয় পাখির। পাখি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা বলছেন এর অন্যতম কারণ দীর্ঘদিন থেকে চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধানে ব্যর্থতা। পাখি রক্ষায় বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ বিভাগের চরম উদাসীনতা ও স্থানীয়দের অসচেতনতা। তারা বলছেন বন্যপ্রাণি, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণির আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ার কারণে বিপর্যয় নেমে আসছে জেলার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে। পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মাঈদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, গেল প্রায় ৩ বছরে পাহাড় কাটাসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যান্য বিষয়ে ২৮টি মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত জরিমানাও করা হয়েছে ১১২ প্রতিষ্ঠানকে। জরিমানা আরোপ করা হয়েছে ১,৩৫,৫৩,৯০০ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জরিমানা হয়েছে পাহাড় কাটা ও অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের উপর। লোকবল কম থাকায় নিয়মিত অভিযান কম হচ্ছে স্বীকার করে তিনি বলেন, গুরুত্ব বিবেচনায় এজেলার প্রতিটি উপজেলায় একজন করে উপ-পরিদর্শক থাকা প্রয়োজন।