যাচাই ছাড়াই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ
পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি প্রকল্প নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। খোদ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাই বলছেন, প্রকল্পটি অত্যন্ত জটিল, বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। দেশের বর্জ্যের দাহ্য হওয়ার ক্ষমতা বা ক্যালরিফিক ভ্যালু খুবই কম হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ পড়বে অনেক বেশি।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০১৩ সালে ইতালীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। এবার প্রায় একই ধরনের শর্তে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। অথচ আগের প্রকল্পটি কেন বাস্তবায়িত হয়নি, সেটির কোনো মূল্যায়ন হয়নি।
উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প নেওয়ার অন্যতম কারণ ঢাকার আমিনবাজারে ল্যান্ডফিল্ডের ওপর চাপ কমানো। উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র নির্মাণে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আগ্রহপত্র চায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ১৭টি কোম্পানি আগ্রহপত্র জমা দেয়। সেখান থেকে যাচাই–বাছাই করে একটি তালিকা পাঠানো হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে। এরপর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ সেখান থেকে চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনকে (সিএমইসি) মনোনীত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠায়।
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এস এম শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশের বিষয়টি ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বিদ্যুৎ বিভাগ বলতে পারবে।’
তবে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়ম অনুসারে সম্ভাব্যতা যাচাই করার কথা ডিএনসিসির, কারণ প্রকল্পটি তাদের। তারা এ প্রকল্পের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আগ্রহপত্র নিয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিবেশের সনদ না নিলে পিডিবি চূড়ান্ত অনুমতি দেবে না। এটি তাদের নিতে হবে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করার আগে কয়েকটি বিষয়ে সমীক্ষা প্রয়োজন ছিল। বর্জ্য থেকে অনেকটা তাপ উৎপন্ন করা গেলেই কেবল বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। কিন্তু ঢাকার দুই সিটির সংগ্রহ করা বর্জ্যে ভেজা বা তরল অংশ থাকে অনেক, যা থেকে প্রচুর পরিমাণে তাপ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ক্ষতিকারক বিভিন্ন রাসায়নিক উৎপাদিত হয়। পরিবেশগত সমীক্ষা জরুরি ছিল।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প নেওয়ার আগে বেশ কিছু বিষয়ে সমীক্ষার প্রয়োজন ছিল। এই প্রকল্প আদৌ আমাদের জন্য লাভজনক কি না, সেটি দেখতে হবে। যে পদ্ধতিতে চীনের কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয়েছে, সেটি সঠিক হয়নি। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কাজ দেওয়া উচিত ছিল।
- ঢাকার বর্জ্যে ভেজা বা তরল অংশ থাকে অনেক, যা থেকে প্রচুর পরিমাণে তাপ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।
- ঢাকার প্রতি কেজি বর্জ্যে ৬০০ কিলোক্যালরি ক্যালিরিফিক ভ্যালু থাকে। অথচ ১০০০ কিলোক্যালরি না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্টের জমি
- ডিএনসিসি চায় ৩০ একর দিতে
- চীনা প্রতিষ্ঠানের চাহিদা ১০০ একর
মহাপরিকল্পনায় রয়েছে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা। জাইকার সহায়তায় কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে ডিএনসিসি। ১৫ বছরের জন্য তৈরি করা মহাপরিকল্পনার খসড়াটি গত বছর স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
ডিএনসিসির মহাপরিকল্পনাতেও সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে। বর্জ্য থেকে কয়েক ধরনের সম্পদ উৎপাদন করা হবে। বায়োগ্যাস, কম্পোস্ট, রিসাইকেল, কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণবর্জ্যের পুনর্ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন। মহাপরিকল্পনাটির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত বা মতামত জানায়নি স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর মধ্যেই সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে সরে এসে ব্যাপক মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত জাইকার সাবেক ন্যাশনাল টিম লিডার শরিফুল আলম মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, মহাপরিকল্পনায় বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। গতানুগতিক ল্যান্ডফিল্ড নয়, আবার গতানুগতিক বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়। কারণ, সব বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব নয়।
বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা
বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে গত ২২ জুলাই চীনা প্রতিষ্ঠান সিএমইসির একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে সিএমইসি জানায়, তারা ২৫ মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। চুক্তি হবে ২৫ বছরের জন্য। বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে ১৮ থেকে ২০ মাসের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ২০ বছরের জন্য চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের পাঠানো নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করে চীনের এই প্রতিষ্ঠানটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে বিদ্যুতের দাম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে প্রতিষ্ঠানটি।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৩৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা খরচ করবে সিএমইসি। বিনিয়োগকারীর উৎপাদিত বিদ্যুৎ নির্ধারিত দামে কিনে নেবে পিডিবি। চীনা প্রতিষ্ঠান সিএমইসি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২৩ সেন্ট চেয়েছে। আর বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে ২১ সেন্ট। বর্তমানে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে দর–কষাকষি চলছে।
প্রাক্–সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল জাইকা
২০১৮ সালের নভেম্বরে জাইকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাক্–সম্ভাব্যতা যাচাই করে। জাইকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনের সংগ্রহ করা বর্জ্যের ক্যালিরিফিক ভ্যালু খুবই কম, প্রতি কেজিতে মাত্র ৬০০ কিলোক্যালরি; যা থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদন অসম্ভব। বিশেষ ব্যবস্থায় বর্জ্যের ক্যালিরিফিক ভ্যালুর মান বাড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
ডিএনসিসি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে জমি দেবে তাদের ‘আমিনবাজার ল্যান্ডফিল্ড সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ প্রকল্প’ থেকে। এস এম শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে উৎসেই বর্জ্য পৃথককরণ করতে হবে। সিটি করপোরেশনের সংগ্রহ করা বর্জ্যের ক্যালিরিফিক ভ্যালু অনেক কম। ফলে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বেশি হবে।
সূত্রঃপ্রথম আলো
বাঅ/এমএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন