পূর্ব প্রকাশের পর… ধা রা বা হি ক
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার
আকাশে সকালের কাঁচা রোদ। সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁসে এগিয়ে চলছে আমাদের নৌকো। বিশাল এক কাশবন পার হতেই চোখে পড়লো আবছা জনপদ। মুহূর্তে চারিদিকে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়লো। গুহাবাসী মানুষগুলো সবাই একসাথে হূরমূর করে উপরে উঠে আসতে চাইছে। ক্রমে ক্রমে জনপদের রেখাগুলো হোল আর স্পষ্টতর। অসংখ্য ছোট বড় নৌকো ইতস্তত ছড়িয়ে। চারিদিকে জীবনের সেই পরিচিত কোলাহল। আমরা ম্যানকার চরের মাটিতে পা রাখি । কিন্তু কোথায় যাবো? আমাদের পরিচয় এখন শরণার্থী তাই একে অপরকে অনুসরণ করে আমরা এগিয়ে চলি শরণার্থী শিবিরের দিকে।
নদীতীরে অসংখ্য তাঁবু খাটানো হয়েছে। গিজগিজ করেছে জীর্ণ-শীর্ণ মানুষের ভীরে। নাক দিয়ে সর্দি ঝরা একদল নগ্নদেহ বাচ্চা কাঁদার মধ্যে খেলছে। মুহূর্তে মনটা বিষণ্ণ হোয়ে যায়। আমি কল্পনায় ওদের ভীড়ে আমায় দেখতে পাই। মাকে জিজ্ঞেস করি, মা আমরা কি এখানে থাকবো? মা নিরুত্তর – ছবির মতো বসে থাকে উদাস চোখে। আমাদের বসিয়ে রেখে বাবা দাদারা কোথায় যেন চলে গেছেন। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে বিশাল নৌকোগুলো থেকে মালামাল উঠানামা দেখি। আমাদের গা ঘেঁসে ট্রাক থামে। মুটেরা সেই ট্রাক থেকে বড় বড় পাথরের চাই নৌকাতে উঠায়। পরে শুনেছি নৌকোগুলো আমাদের দেশ থেকে পাট নিয়ে আসে আর নিয়ে যায় এই পাথরের চাই যা দিয়ে সিলপাটা তৈরি হয়।
বাবা ফিরে আসেন। বিষণ্ণ চিত্তে মাকে বলেন এখানে থাকা যাবে না। এখানে থাকলে ছেলেমেয়েরা কলেরায় মারা পড়বে। কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে শিবির জুড়ে আর তার সাথে চোখ উঠা ব্যামো। আমরা বসে থাকি কারোর প্রতীক্ষায়। আচ্ছা কষ্টে কি ঘন ঘন ক্ষুধা পায়? আমি পেট কোঁকড়ানো ক্ষুধা নিয়ে বসে থাকি মায়ের পাশে।
শিবিরে বিরামহীন মানুষের ঢল। এখানে জীবন ও মৃত্যু পাশাপাশি বাস করে। হঠাৎ করে আমাদের সামনে দিয়ে চলে যায় এক খণ্ড মিছিল। সাদা কাপড়ে মোড়া খাটিয়ায় শুয়ে আছে মৃত দেহ। পিছনে পিছনে তার স্বজনেরা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে যায় ‘বল হরি হরি বোল’। এ মিছিল কারোকে বিচলিত করে না। এ যেন প্রাত্যহিক জীবনেরই অংশ। মানুষের এমন নিরুত্তাপ আচরণে আমার ভীষণ কান্না পায়। বাবা আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে যান অন্যদিকে।
ফিরে আসে আমার দাদা আরেক এক মেসতাতো ভাইয়ের সাথে। একটা বাসা ভাড়া পাওয়া গেছে। দুই পরিবার একটা ঘর। চারিদিকে দালাল ছোঁ ছোঁ করেছে। বাবা সস্তায় বেশ কিছু জিনহা টাকা ভাঙ্গিয়ে ফেলেন। আমরা দল বেঁধে হাজির হই আমাদের ভাড়া বাড়ীতে। বাড়ীটি নদী তীর থেকে বেশী দূরে নয়। বাড়ি থেকে অদূরে আকাশ ছোঁয়া পাহাড় চোখে পড়ে। একটা খোলা মেলা পরিবেশ। পেছনে একটা লেকের মতো – মনে হয় নদীরই আরেকটা অংশ। সামনে এক বিশাল তাল পুকুর। সে তাল পুকুরে বৃহদাকার পাকা তাল উবু হোয়ে ভেসে থাকে। বাড়ির মালিক সেনা ক্যাম্পে রসদ যোগায়। ছোট্ট সংসার। আমার দিদির বয়সী দু’ মেয়ে। ওরা অল্প সময়ে আমাদের অত্যন্ত কাছের হোয়ে উঠে। ভাষার ভিন্নতা ওদের আন্তরিকতার কাছে ম্লান হোয়ে যায়। আমি সুযোগ পেলেই তাল পুকুরে উবু হোয়ে ভেসে থাকা তাল নিয়ে আসি। অহমিয়েরা পাকা তাল খেতে জানে না। মা ওদের তালের বড়া বানাতে শিখায়। আমাদের খাবারের কোন সমস্যা নেই। যথেষ্ট পরিমাণ রেশন আসে। প্রায় বিকেলে ওরা আমায় বেড়াতে নিয়ে যায় সেই আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের পাদদেশে সেনা ক্যাম্পে। আমি আস্তে আস্তে সব চিনে ফেলি। একা একা নদী পার হোয়ে চলে যাই পাহাড়ের সবুজ নিসর্গে। পাহাড়ের ঢালুতে ছোট্ট প্রাকৃতিক জলাশয়ে হরেক বর্ণের মাছ। অসংখ্য সিঁড়ি বেয়ে যাওয়া যায় মেঘের খুব কাছে। সুউচ্চ শিখরে আছে কামাখ্যা মন্দির, মীরজুমলা সহ অনেক ভাগ্যহত সৈনিকের সমাধি। সুমসাম নীরবতার মাঝে সমাধিসৌধগুলো আমায় ভীষণ টানে। সমাধি সৌধকে জড়িয়ে থাকা আঙ্গুর লতা, কাঠ বিড়ালীর ত্রস্ত চলাচল, দূরের কোন পাহাড়ের ঢালে ডুবে যাওয়া সূর্যের বিচিত্র বর্ণ আমি প্রাণভরে উপভোগ করি।
একদিন ম্যানকার চর বাজারে ভীষণ উন্মাদনা। কিছু তরুণ নাকি পাকিস্তানী গুপ্তচরকে আটক করেছে। আমি ছুটে যাই দেখতে। একজন হাত ও চোখ বাঁধা দীর্ঘদেহীকে ওরা হিরহির করে টেনে নিয়ে চলেছে। আমি পেছনে পেছনে হেটে চলি ওদের দীর্ঘ মিছিলে। আমার যে কিছুই করার নেই। সারাদিন উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াই। ঘরে ফিরে আসি ক্ষুধার টানে। আমার কেন যেন শুধু ক্ষুধা পায়, শুধুই ক্ষুধা
চলবে…
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
-এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন