পূর্ব প্রকাশের পর… ধা রা বা হি ক
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ | সুশীল কুমার পোদ্দার
বাবা একের পর এক জিনহা টাকা ভাঙ্গিয়ে ফেলেন। বাড়ী ভাড়া, আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে যেয়ে তিনি হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন। সর্বোপরি অপরের সাহায্যের উপর নির্ভর করে এ অলস ও দুর্ভাবনাময় জীবনকে তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তিনি যখন এই চক্রব্যূহ থেকে বেড়ানোর পথ খুঁজছেন তখন আমি আমার এ উদ্দেশ্যহীন সময়ের মধ্যে উদ্দেশ্য খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে যাই।
এক অলস দুপুর বেলায় রাস্তায় বেড় হয়েছি। পথে এক ফেরিওয়ালা। কাঁধে বাহুকা ঝুলিয়ে বিরাট বড় দুটো ঝাঁকার ভেতর নানান ধরনের পশরা সাজিয়ে নিয়ে সে ছুটে চলেছে। প্যাকেটের মাঝে থরে থরে পশু পাখীর আদলে বানানো বিস্কুট আমায় ভীষণ আকর্ষণ করে। আমি হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালার মতো ফেরিওয়ালার পিছু নিয়ে অলি গলি কতো অজানা জনপদ পেরিয়ে হাজির হই বিরাট এক হাটের উপকণ্ঠে। জনাকীর্ণ হাট, বিচিত্র পণ্যের সমাহার। আমি বিমোহিত হয়ে ঘুরে বেড়াই। এই প্রথম একা একা হাটে এসেছি। নিজকে বেশ বড় বড় লাগে। মনে পড়ে যায় বাবার হাত ধরে একবার হাটে গিয়েছিলেম। আমি আনমনা হয়ে বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে অন্য এক আগন্তুকের বুড়ো আঙ্গুল ধরে হেটে চলেছি। আঙ্গুলের স্পর্শ কেমন যেন অচেনা লাগে। মাথা উঁচিয়ে দেখি ওটা বাবা নয়। সেদিন খুব কেঁদেছিলেম হারিয়ে গেছি বলে। আজ কেন যেন হারিয়ে যাবার কোন ভীতি নেই। পকেটে সেদিনের মতোই কোন পয়সা নেই। কিন্তু কেন যেন যা দেখি তাই খেতে ইচ্ছে করে।
ঘুরে ঘুরে পরিশ্রান্ত হয়ে অনেক কষ্টে ফিরে আসি আপন ঠিকানায়। কিন্তু বাঘ ভালুক, পাখীর আদল খচিত বিস্কুটগুলো আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এখন আমার ঘোরাঘুরির জায়গা আরও বেশী বিস্তৃত হয়েছে। পাহাড়ের চেয়ে ঐ জনাকীর্ণ হাট আমায় বেশী আকর্ষণ করে। একদিন ঘুরতে ঘুরতে ফলের হাট পেয়ে যাই। গারোপাহাড়ীরা নিয়ে এসেছে হরেক রকম ফল। আমার পাশে সাগর কলার একটা ছোটখাটো পাহাড়। পাহাড়ের পেছনটা সম্পূর্ণ অরক্ষিত। পেটে কোন ক্ষুধা নেই। কিন্তু মনের বড় ক্ষুধা। আমি কাধি থেকে একটা বড় আকৃতির কলা ছিঁড়ে নিয়ে মিশে যাই হাটের মাঝে। সাহসের প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আবারো ফিরে আসি। আবারো একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি। নিজকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করি। পথে ফিরতে ফিরতে অবচেতন মনের সাথে অনেক যুদ্ধ হয়। লজ্জায় দংশিত হই । মনে পরে মায়ের মুখ। কিন্তু মুহূর্তে সে মুখ ছাপিয়ে একটা বিজয়ের আনন্দ আমার সারা মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমি দ্বিধান্বিত। অপরাধ বোধ আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। রাতে স্বপ্ন দেখি আমায় হাত ও চোখ বেঁধে পাকিস্তানী গুপ্তচরের মতো কিছু অহমীয়া তরুণ হিরহির করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি আর হাটে যাই না। মনমরা হয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই। তারপর একদিন মনের অজান্তে আবারো হাটে চলে যাই। আমি সেই সাগর কলার পাহাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে। ছোট challenge নিতে মন সায় দেয় না। আজ তাই বড় একটা কলার ছড়ি নিয়ে জনস্রোতে মিশে যাই। দু’কদম এগুতেই একটা ভারী হাতের স্পর্শ আমার সাড়া শরীরে হিম শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়। আমি চোখ ভরা জল নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। ঠিক যেমন বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হতে আসন্ন মিলিটারির ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হোয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেম, তেমনি আমি চোখ বুজে প্রার্থনা করি। লোকটা বাঙ্গালী। শুদ্ধ বাংলায় মায়া ভরা কণ্ঠে আমার মাথায় হাত রাখেন। বলেন খোকা তোমার ক্ষুধা পেয়েছে? চল তোমায় কলা কিনে দেই। লোকটা আমায় নিয়ে গেলেন দোকানির কাছে। পরম স্নেহে কিনে দিলেন না বলে উঠিয়ে নেওয়া কলাগুলো।
আমি ক্লান্ত অবসন্ন। রাস্তার ধারে একজন অন্ধ ভিখারি বসে আছে। আমি নীরবে কলা গুলো ভিখারির কাছে রেখে হেটে চলি। আমার ভীষণ কান্না পায়। এতদিনের জমানো কষ্টগুলো গলার কাছে কাটার মতো বেঁধে। স্কুলের কথা মনে পড়ে, এক সাথে বড় হোয়ে উঠা বন্ধু কামালের কথা মনে পড়ে, গোপালের কথা মনে পড়ে। ক্লাস ওয়ানে প্রথম হবার পর রাগী হেড মাস্টার মাথায় হাত রেখেছিলেন – সেই সব স্মৃতিরা প্রগাঢ় হোয়ে আমায় ঘিরে ধরে।
সেদিন রাতের খাবার না খেয়েই শুয়ে পড়েছি। মা বললেন বাবা শরীর খারাপ লাগছে? আমি নীরবে মাথা নাড়াই। মা মাথায় হাত রাখেন। মুহূর্তে অপরাধের অসহনীয় গ্লানি কান্না হোয়ে ঝরে পড়ে। মা বুঝে পায় না। আমায় জড়িয়ে ধরে রাখেন। মাকে বলি মা আবার কবে স্কুলে যাবো? আবার কবে বাড়ি ফিরবো?
চলবে…
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৬ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
-এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন