পূর্ব প্রকাশের পর… ধা রা বা হি ক
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | সুশীল কুমার পোদ্দার
রিলিফের চাল খেয়ে বড়লোক হয়ে ওঠা আর হয় না। দিন দিন সাহায্যের পরিমাণ কমতে থাকে। শীত আসি আসি করে। ট্রাক ভর্তি মোটা মোটা কম্বল আসে। মোটা কম্বল পাতলা হয়ে যায়। কারো ভাগ্যে জোটে, কারোর জোটে না ।
সময়ের সাথে সাথে ছোট মামার মৃত্যুশোক আমরা অনেকটা কাটিয়ে উঠি কিন্তু দিদিমা কিছুতেই তার ছেলের অকাল মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেন না। যুদ্ধের প্রসঙ্গ, দেশের প্রসঙ্গ এলেই তার চোখ জলে ভরে যায়। তিনি শোকভার বইতে যেয়ে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যান। কলিকাতায় তার বড় ছেলে থাকে। কি এক অজানা কারণে সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যোগাযোগ করে না। দিদিমা দিন দিন নিশ্চুপ হয়ে যান। বড় ছেলেকে দেখে হয়তো তার পুত্র বিয়োগের শোক কিছুটা লাঘব হবে সে প্রত্যাশায় দাদা দিদিমাকে কলকাতা নিয়ে যাবার কথা ভাবেন। কিন্তু কলকাতা যাবার যে অনেক খরচ! নিরুপায় হয়ে দাদা তার বৃত্তির টাকা দিয়ে কেনা seiko ঘুড়িটা তার ছাত্রের কাছে যৎসামান্য মূল্যে বন্ধুক রাখেন। দাদা ভেবেছিলেন গুরু দক্ষিণা হিসেবে হয়তো ছাত্রটি বলবে স্যার ঘড়িটা আপনার কাছেই রাখুন, টাকাটা পরে দিয়ে দেবেন। সেদিন দাদা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন আজও তিনি সেদিনের কথা ভুলতে পারেন না।
আমরা দিদিমাকে চির বিদায় জানালেম। দাদার সাথে সঙ্গী হলো আমার দিদি। যে উৎসাহ নিয়ে দাদা কলকাতা গিয়েছিলেন ফিরে এলেন ততোধিক নৈরাশ্য নিয়ে। আত্মীয় স্বজনের শীতল আচরণে ভাই বোন যে ব্যথিত হয়েছেন তা বুঝতে বাকী রইলো না ।
গাওয়াল ব্যবসায় দাদা ক্রমাগত ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে অবশেষে একদিন প্রায় নিঃস্ব হাতে গ্রাম থেকে ফিরে এলেন। অদূরে সাউতাল পল্লী। সেখানে নিয়মিত হাট বসে। সাউতাল মেয়েরা মাথায় করে নিয়ে আসে আলু, বেগুন, পেঁপে। দাদা আমায় বসিয়ে রেখে চলে যায় দূরে বহুদূরে পথের মাঝেই পণ্যগুলো কেনার জন্য। এদিকে আমি অধির উৎকণ্ঠায় বসে থাকি। এক মারোয়াড়ী ভদ্রলোক আমার কাছে এক কেজি মিষ্টি লাউ কিনতে চায়। আমি কিছুতেই এক কেজি বানাতে পারি না । লাউটা কাটতে কাটতে খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়। আমার অসহায়ত্বে ভদ্রলোকের মনে মায়া জাগে।তিনি সবটুকু কিনে নিয়ে যান। এমনি করে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবন গড়িয়ে গড়িয়ে চলে।
একদিন বড় হাটের দিন। দাদা চলে গেছে সাউতাল মেয়েদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। দাদার দেখা নাই। আমার ভীষণ কান্না পায় । কোথায় যাবো খুঁজতে বুঝে উঠতে পারি না। অবশেষে দাদা খালি ঝাঁকা হাতে ফিরে আসেন। পথে কোন কথা হয় না। দেখে বুঝা যায় শরীর মনের উপর দিয়ে একটা বিরাট ঝড় বয়ে গেছে। অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হাতড়াতে ফিরে আসি ঘরে। বাসায় এসে দাদা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পথের মাঝে না বুঝে এক সাউতাল মেয়ের মাথার বোঝা নামাতে সাহায্য করতে গিয়ে গ্রাম্য সালিশের মুখোমুখি হন। সাউতাল সমাজে কোন অবিবাহিত তরুণীর মাথার বোঝা নামানো ভীষণ অন্যায়। আর এ অন্যায়ের শাস্তি হলো বিয়ে। ভিন্ন সংস্কৃতি ও শরণার্থী হবার কারণে কিছু মাতব্বরের হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় দাদা ছাড়া পেয়েছিলেন। দাদার হাটে যাওয়া বন্ধ হলো।
আমাদের ঘর থেকে একটা বাঁশের সাকো পাড়ি হলেই মহাসড়ক। মহাসড়কটা চলে গেছে বালুরঘাট পার হয়ে। একদিন রাতের আধারে মহাসড়ক দিয়ে ছুটে যায় অসংখ্য সাঁজোয়া যান। আমরা ভয়ার্ত চোখে ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। মানুষের মাঝে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শরণার্থী হবার কারণে যারা আমাদের অত্যন্ত হেয় চোখে দেখতো তাদের সাথে আমাদের দিন দিন দূরত্ব কমে যায়।
মহাসড়কটা এখন দিন রাত ধরে ব্যস্ত। বালুর ঘাটে নাকি পাকসেনারা সেলিং করেছে। নিরাপত্তা হীনতায় মানুষের ঢল আসে মহাসড়ক ধরে। একদিন ভীষণ গর্জন করে পাকিস্তানী বিমান ঢুকে পড়ে ভারতীয় আকাশে। আমরা খুব কাছ থেকে দেখতে পাই সেই বিমানকে। তাকে তাড়া করেছে ভারতীয় মিগ।লোকমুখে খবর আসে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত সাফল্যের সংবাদ। আমাদের সবার মনে আবারো নতুন করে আশা জেগে ওঠে । আবারো সন্ধ্যা হলে হতাশাগ্রস্ত মানুষগুলো জটলা করে রেডিওকে ঘিরে ….
চলবে…
যুদ্ধের স্মৃতি কথা ৮ | সুশীল কুমার পোদ্দার , ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন