মুক্তিযুদ্ধের সময় স্যার ফজলে হাসান আবেদ যুক্তরাষ্ট্রের তেল কম্পানি শেল অয়েল কম্পানির পাকিস্তান শাখায় কর্মরত ছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান ছিলেন সেসময়। তিনি শেল অয়েলে কর্মরত থাকা অবস্থায়ই ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। এরপর তিনি ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে মনপুরা দ্বীপে গিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেন। মনপুরা দ্বীপে থাকা অবস্থায়ই ২৫ মার্চের কালোরাত নেমে আসে। পাকিস্তানি হানাদাররা আকস্মিকভাবে ঢাকায় আক্রমণ করে।
যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় ‘হেলপ’ এর বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো তাদের লোকদের সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। ফলে ফজলে হাসান আবেদও চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন।
শেল অয়েল এর চেয়ারম্যান ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। তার ইঙ্গিতেই হয়তো পাকিস্তানি সেনারা আবেদকে আটক করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। এবং তাকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে শেল কম্পানির সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষাকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
কিন্তু আবেদের মনে ছিলো অন্য পরিকল্পনা। তিনি শুধু পালানোর সুযোগ খুঁজছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে একটি বিশেষ ‘পাস’ দিয়েছিলো। ফলে তার প্লেনের টিকেট কেনার অনুমতি ছিলো। কিন্তু একটা সমস্যা ছিলো। বাংলাদেশ থেকে শুধু করাচি এবং ইসলামাবাদের উদ্দেশেই বিমান ছেড়ে যেতো। আর কোনো দেশে যেতে বিমান যেতে পারতো না।
ক্যান্টনমেন্টে দুই সপ্তাহ থাকার পর তিনি ছুটি নেন। এবং মে মাসের প্রথম দিকে করাচি চলে যান। সেখানে তিনি ১০ দিন বসে থেকে একটি পরিকল্পনা গুছিয়ে আনেন। সরাসরি ইউরোপে না গিয়ে বরং আফগানিস্তানের কাবুল হয়ে লন্ডনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কেননা ইউরোপের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বিমানগুলোতে কড়া নজরদারি করছিলো পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু করাচিতে থাকা অবস্থায় ঘটনাক্রমে শেল অয়েল এর এক সহকর্মীর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। ওই সহকর্মী শেল অয়েল এর চেয়ারম্যানকে জানিয়ে দেন যে আবেদ ছুটি নিয়ে করাচিতে চলে এসেছে এবং তার গতিবিধি সন্দেহজনক। তখন শেলের চেয়ারম্যান পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-কে বার্তা পাঠান আবেদকে গ্রেপ্তার করার জন্য।
ওদিকে আবেদ তার সহকর্মীর এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানতেন না। ফলে তিনি করাচি থেকে ইসলামাবাদের শেল অফিসে গেলেন বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে। আর সেখানে গিয়েই আটক হলেন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর হাতে।
আবেদকে আটকের পর তাকে পাকিস্তানের সেনা সদরদপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। সেখানে তার লাগেজ তল্লাশি করার সময় তার বেতনের স্লিপ দেখে সেনা কর্মকর্তারা বলে উঠেন, ‘তুমি নিশ্চয় পূর্ব পাকিস্তানের বিয়ের বাজারে সবচেয়ে যোগ্য পাত্র!’
জিজ্ঞাসাবাদের সময় আবেদ ছুটি কাটানোর উদ্দেশেই তার করাচি যাওয়ার কথা বলেন। ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় তিনি বুদ্ধি করে একটি রিটার্ন টিকেট কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটি দেখিয়ে তিনি বলেন, তাকে যদি আদেশ করা হয় তাহলে তিনি ঢাকায় ফিরে যাবেন। ওই রিটার্ন টিকেট এবং তার ব্রিটিশ পাসপোর্টই হয়তো তাকে সেদিন বাঁচিয়ে দিয়েছিলো।
সেখান থেকে ছাড়া পেয়েই একটি ট্যাক্সিতে করে তিনি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রদেশ পেশওয়ারে চলে যান। সেখানে গিয়ে সবচেয়ে ভালো হোটেলগুলির একটিতে ওঠেন। বন্ধুরা বলে দিয়েছিলো অভিজাত কোনো হোটেলে উঠলে তাকে কেউ সন্দেহ করবে না।
সেখান থেকে তিনি অনেক যাত্রীবোঝাই একটি বাসে চড়ে খাইবার গিরিখাত পাড়ি দিয়ে কাবুলে চলে যান। কিন্তু কাবুলে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন লন্ডনে সব ফ্লাইট বুক হয়ে আছে কয়েক সপ্তাহের জন্য। কাবুলে দুই সপ্তাহ কাটানোর পর তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুলের একটি ফ্লাইটের টিকেট পেলেন। সেখান থেকে তিনি অবশেষে লন্ডনে যেতে সক্ষম হন।
লন্ডনে গিয়েই স্যার ফজলে হাসান আবেদ শেল অয়েলের সদর দপ্তরে গিয়ে হাজির হন এবং চাকরি ছেড়ে দেন। এসময় তিনি শেল কম্পানির পাকিস্তান শাখার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তাকে যুদ্ধকালীন ‘দাবার ঘুটি’ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ করেন।
লন্ডনে পৌঁছে আবেদ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মিলে গঠন করলেন একটি সংগঠন, ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’। যার উদ্দেশ্য ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করা। এই সংগঠনের মাধ্যমেই তারা পুরো বিশ্বের সামনে বাংলাদেশে চলমান পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরেন।
প্রথমেই লন্ডন টাইমস পত্রিকায় একটি বড় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলেন তাঁরা।
বিজ্ঞাপনের ভাষ্য ছিল- বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যা চালানো হচ্ছে। এরপর তাঁরা ব্রিটিশ এমপিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের কাছে বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং অমানবিক নৃশংসতা তুলে ধরলেন। শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে গিয়ে সে দেশের জনমতকে প্রভাবিত করার জন্যও নানামুখী প্রচারমূলক তত্পরতা চালালেন তাঁরা। বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিশেষত রেডিও-টেলিভিশনে সাক্ষাত্কার প্রদান করে তাঁরা পাকিস্তানিদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরলেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত তার সাক্ষাত্কারগুলো ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল।