শোকাবহ আগস্ট ’৭৫ ।। অধ্যাপকড. মুহম্মদ মাহবুব আলী
বাঙালির জীবনে আগস্ট শোকাবহ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ পরিবার-পরিজন ও নিকটজনদের নৃশংস ও বর্বরতার সঙ্গে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যে জাতির জন্য জাতির পিতা প্রাণ উৎসর্গ করতে দ্বিধা করেননি, যিনি দেশকে এগিয়ে নিতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন, যার সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম, তারা সেদিন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যা করে দেশের ইতিহাসকে কলুষিত করেছে।
দেশের অগ্রযাত্রাকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ঘাতকেরা সুনিপুণভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে বাঙালী জাতির অগ্রগতি, প্রগতি ও উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। অথচ এদেশের মানুষের মানবিক ও আর্থিক উন্নয়নের জন্য সমগ্র জীবনকে তিনি ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বলিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন। এদেশের মৃত্তিকায় মিশে আছে বাঙালীর জন্য তাঁর অন্তহীন ভালবাসা, মমত্ববোধ এবং উন্নয়ন করার জন্য উদগ্র বাসনা। দীর্ঘদিন পরে হলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে। যারা বিদেশে রয়ে গেছে তাদের এখনও প্রাপ্য শাস্তি কার্যকর করা যায়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নিকৃষ্টতম হত্যাকান্ড ।
বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সকল প্রেরণার উৎস। ঘাতকেরা তাকেও হত্যা করে। মোশতাক-জিয়া-চাষীর নেতৃত্বে বিপথগামী সেনাদের তারা যেভাবে পরিচালনা করে কার্যোদ্ধার করেছিল তাতে দেশ ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বাংলার স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করতে চেয়েছিল। যারা এ হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল তারা দেশ ও সমাজের শত্রু। অচিন্তনীয়ভাবে এ হত্যাকান্ড বিশ্ব বিবেককে তাড়িত করেছিল। তবে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন কিন্তু কোন বিবৃতি দেননি। এদিকে মোশতাক সরকারে যারা যুক্ত হয়েছিল তারা কেবল বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচারই করেনি, বরং দেশ ও জাতির প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। যিনি তাদের সব সময় দেখ-ভাল করেছেন, চিন্তা করেছেন রাষ্ট্রের উন্নয়নের, মানবিক হতে সহায়তা করেছেন, তিনি নিষ্ঠুরভাবে হত্যার শিকার হলেন। জাতীয় চার নেতা এবং কতিপয় আদর্শবান নেতা-নেত্রী ছাড়া অধিকাংশই সেদিন এই বর্বরোচিত ঘটনাকে পেছনে ফেলে আবার আখের গোছাতে সচেষ্ট হয়। এই ধরনের পরিকল্পনায় বেশ সময় লেগেছে। কিন্তু বাঙালীর প্রতি অবিচল বিশ্বাস থাকলে এবং সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হয়ত এদের হাত থেকে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে সেদিন রক্ষা করা যেত। পাকিস্তানীরা যে বিশ্বাসঘাতকতা করেও সামাল দিতে না পারার ভয়ে দুঃসাহস দেখায়নি তাদেরই প্রেতাত্মা যারা বাঙালী নামধারী তারা এ নির্মম ও পৈশাচিক হত্যাকান্ডসমূহ ঘটায়। আসলে দুর্জনের যেমন ছলের অভাব হয় না, সেদিন যারা এ অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছিল তারা দীর্ঘমেয়াদে কিন্তু লাভবান হয়নি। সাময়িকভাবে হয়ত তারা ক্ষমতা দখল করেছিল, কিন্তু জনগণের ঘৃণা এবং একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক সঙ্কট সব সময় তাদের ওপর বিরাজ করছিল।
বঙ্গবন্ধু বাংলার বন্ধু হিসেবে, এদেশের মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছিলেন, যাঁর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তাঁকে মাত্র সাড়ে তিন বছর শাসনকালের মধ্যে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। তাঁর দুই কন্যা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁর সুযোগ্য বড় কন্যা শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, পিতার মতোই তিনি জনগণের কল্যাণে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। কুচক্রীরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গমাতা, ছোট রাসেলসহ তাঁর তিন পুত্র, দু’জন পুত্রবধূ, তাঁর ভাই শেখ নাসের, শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর স্ত্রী আরজু মণি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অনেককেই হত্যা করেছিল। শিশুপুত্র শেখ রাসেলের হত্যাকান্ডেই ফুটে ওঠে হত্যাকারীদের নির্মম বীভৎসতা। দুষ্টচক্র যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে তা পূরণ করা পরবর্তী একুশটি বছর সম্ভব হয়নি। যিনি বাঙালীর মুক্তির প্রতীক ছিলেন, বাঙালীকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন প্রয়াসে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন, তাঁকে ঘৃণ্যভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটা বাঙালি জাতির জন্য চিরলজ্জার ও ধিক্কারজনক। বঙ্গবন্ধু বাঙালীকে বড় ভালবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। তাই তো ঘৃণ্য নরপিশাচেরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুচর হিসেবে ব্যক্তিগত লোভ-লালসায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ডেইলি স্টারের ১৯ নবেম্বর, ২০০৯ সংখ্যায় ফারুকের স্বীকারোক্তিতে (Farooqs Confession) দেখা যায় যে, ১৯৭৪ সালে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিল এবং সে প্রায়ই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার অসন্তোষ নিয়ে আলোচনা করত, যিনি সে সময় সেনা উপপ্রধান ছিল। জিয়াউর রহমান এমন একটি বৈঠকে ফারুককে ওই পরিস্থিতিতে ‘কিছু করার’ পরামর্শ দিয়েছিল। ওই স্বীকারোক্তিতে আরও দেখা যায় যে, মেজর রশিদ, মেজর ডালিম এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, তারা বাকশাল ভেঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে অপসারণ করবে। মেজর রশিদ বিষয়টি মেজর ফারুককে অবহিত করে এবং সে এ পরিকল্পনার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিল। তাকে আরও জানানো হয়েছিল যে, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাদের সমর্থন করবে। বস্তুত দীর্ঘদিন ধরে এ চক্রান্ত চলে আসছি॥ সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন এবং সময়মতো ব্যবস্থা নেয়া গেলে এমনটি ঘটতে পারত না। যাদের ওপর দায়িত্ব ছিল এ ধরনের হীন চক্রান্ত হলে তাঁকে জানানোর তারা কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে পৃথিবীর বর্বরতম হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল ১৫ আগস্ট। এ হত্যাকান্ড বাঙালী জাতিকে তার দিকপাল ও নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস ছিল। তাঁর হত্যাকান্ডের পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। গণতন্ত্র ধ্বংস করে সংবিধানের মূল আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছিল। অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিনষ্ট করার চেষ্টা করা হয় এবং মানবাধিকারের সকল প্রয়াস লুপ্ত করা হয়। ইনডেমনিটি বিলের মাধ্যমে এই ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের বিচারকার্য রহিত করা হয়েছিল। এদিকে যারা ক্যু করেছিল তারা স্বৈরতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, স্বাধীনতা বিরোধিতার উপাদানসমূহকে উৎসাহিত করেছিল। শোকাবহ আগস্ট জাতির জনককে হারানোর এক বিয়োগান্তক ঘটনা। শোকাবহ আগস্টের পথ ধরেই নবেম্বরে জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন (অব) মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয় কারাগারে। চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও জোরজবরদস্তি ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশের সকল শুভ কর্মকান্ড বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিল তারা। ফলে ধর্মীয় উগ্র মতবাদের উত্থান ঘটাতে থাকে। এক অরাজক পরিস্থিতি শোকাবহ ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ পরবর্তীতে দেশে ঘটতে থাকে। শাসন ব্যবস্থায় চেন অব কমান্ড এতে বিনষ্ট হয়। দুর্নীতি, ভন্ডামি, লাম্পট্য, অসততা, বেলাল্লাপনা-রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে যাঁতাকলের মতো পিষ্ট করতে থাকে। দেশে যে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে বিভিন্ন ধরনের প্রপাগান্ডা সাধারণ মানুষকে হতাশ ও বিষণ্ণ করে তোলে। লুটেরা শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রে ক্ষমতা বলয়ের কাছাকাছি থাকায় তখন ব্যাংকিং সেক্টর থেকে অর্থ পাচার হতে থাকে। পাটকলগুলো একের পর এক লোকসানের মুখোমুখি হয়। সাধারণ মানুষ সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হয়। শাসনভার পরিচালনায় উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকগুলো ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিল। সে সময় জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেছিল, ‘আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলব।’ আসলেই রাজনীতিতে তখন কিছু শয়তান প্রকৃতির বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী, আমলা, সুযোগসন্ধানী ও ভুঁইফোঁড়রা এবং গিরগিটির মতো রং পাল্টানোদের সমাবেশ ঘটাতে থাকে। সত্যিকার রাজনীতিবিদদের আকাল দেখা দেয়। সাধারণ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটিয়ে একক বা গুটিকয়েক ব্যক্তির জোরজবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত শোকাবহ আগস্ট পরবর্তী থেকে শুরু হয়। যার ফলে সাধারণ জনমানুষের মধ্যে ভীতি ও হতাশা কাজ করতে থাকে। মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ে, অদৃশ্য শক্তির ওপর নির্ভর করতে থাকে। শাসকবর্গ এবং জনগণের মধ্যে সহজাত জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। অবস্থা দাঁড়ায় অনেকটা মাৎস্যানয়ের মতো বড় মাছ যেমন করে ছোট মাছকে গিলে খায়। বিয়োগান্তক ঘটনার পর রাজনৈতিক মূল্যবোধ উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যে অপূরণীয় ক্ষতি এ দেশের ও দেশবাসীর হয়েছিল তাতে রাজনৈতিক মূল্যবোধের জোগান ও সরবরাহের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা দরকার ছিল এবং প্রয়োজন ছিল সংস্কার সাধন করার। তারা স্বল্পকালীন লক্ষ্য ও লোভ নিয়ে কাজ করায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ এবং বোবা কান্না বিরাজ করতে থাকে এবং প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার শক্তি মানুষ হারায়। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৭ মে, ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের সঙ্গে জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের আদর্শ, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মানুষের প্রতি অফুরান ভালবাসা ও জনকল্যাণমুখী কর্মসূচীর মাধ্যমে রাজনৈতিক উপাদানসমূহকে কাজে লাগিয়ে হতাশা এবং দিকভ্রষ্ট সাধারণ মানুষকে পথ দেখানোর দিশা গ্রহণ করেন। যে দমবন্ধকর হতাশাযুক্ত অবস্থা ছিল তা থেকে জনগণকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেন। তাই তো আজ তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। শোকাবহ আগস্ট আমাদের দুঃখের ভেলায় ভাসায়। তারপরও বাঙালী আশা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ, গণতন্ত্র তাঁর সুযোগ্য কন্যার হাত ধরে আশার আলোর বাতিঘরের মতো নানা ঝড়ঝঞ্ঝা, অতিমারী সবকিছু উপেক্ষা করে দেশ এগিয়ে যাবে। দেদীপ্যমান ও চিরভাস্বর হয়ে উঠুক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মূল্যবোধ, যা মানবকল্যাণে ব্রতী। অন্যায় অসত্যের পথ থেকে বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্র চর্চা ও জনকল্যাণে কাজ করে চলেছে। অতিমারীর সময়ও সবার জন্য খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিতে বর্তমান সরকার কাজ করছে। শোকাবহ আগস্ট আমাদের জন্য দুঃখ-শোকের একটি বেদনাবহ অভিশপ্ত দিনলিপি। ম্যাকিয়াভ্যালির নীতিতে বিশ্বাসী মোশতাক-জিয়া হারিয়ে গেছে অন্যায়-অসত্য-মিথ্যার গহ্বরে চিরকালের জন্য।
লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ও আইটি এক্সপার্ট