স্মরণের আভরণে
তোফায়েল আহমেদ ।।মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, আমার এক সময়ের প্রিয় সহকর্মী শাজাহান সিরাজ গত ১৪ জুলাই মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।স্বাধীনতা-উত্তরকালে তার রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক আছে। থাকতেই পারে; কিন্তু একজন মানুষ মৃত্যুর পর সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে যান। আমরা তখন তার অবদানকেই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা অকুতোভয় সহযোদ্ধা সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, নিবেদিতপ্রাণ নেত্রী সাবেক মন্ত্রী সাহারা খাতুন, দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি ও মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামসহ আরও অনেক বরেণ্য ব্যক্তিই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। জগতে কেউ-ই চিরদিন বেঁচে থাকেন না। একদিন আমাকেও এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। মত ও পথের পার্থক্য সত্ত্বেও আমরা যথাসম্ভব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় প্রত্যেক মৃত ব্যক্তিকেই স্মরণ করে তার ভালো কাজগুলো ঊর্ধ্বে তুলে ধরি। এটিই মানব জগতের নিয়ম।
আমাদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মী থেকে শাজাহান সিরাজ নেতা হয়েছিলেন। ষাটের দশকের শুরুতেই, ’৬২তে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, তিনি ছিলেন সেই আন্দোলনের কর্মী-সংগঠক। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজে। ১৯৬৪-৬৫ এবং ’৬৬-৬৭তে তিনি পরপর দু’বার ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ওই কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা মামলার আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে গড়ে ওঠা গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থানের তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। আমি যখন ছাত্রলীগের সভাপতি তখন তিনি সেই কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। ’৭০-এর ২১ মার্চ ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) মাঠে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন। সেই সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজ। ’৭১-এর ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সেদিনই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ডাকসু ও ছাত্রলীগের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করে নেতৃত্ব প্রদান করেন ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজ এবং ডাকসু ভিপি আসম আবদুর রব ও জিএস আবদুল কুদ্দুস মাখন। আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ’৭১-এর ৩ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ এক অবিস্মরণীয় দিন। সেদিন পল্টনের জনসমুদ্রে স্বাধীনতার ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতির পিতা’ এবং ‘স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক’ ঘোষণা করে ইশতেহার পাঠ করেছিলেন শাজাহান সিরাজ। অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিটি দিনেই তিনি সক্রিয় সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। এরপর জাতির পিতার নির্দেশে হাতিয়ার তুলে নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বিজয়ের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে যে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি, দুর্ভাগ্য সেসময় নিয়তি আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। শাজাহান সিরাজ জাসদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। তারপরের ইতিহাস সবাই জানেন। তিনি বেশ কয়েকবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপি সরকারে মন্ত্রী ছিলেন। বেশ ক’বছর ধরে তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
যে কোনো মৃত্যুই দুঃখের-কষ্টের এবং শোকের। আবার এ করোনা মহামারীকালের মৃত্যু আরও করুণ। মৃতজনের কষ্ট, বাঁচার আকুতি, মৃতের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা- এসব মিলিয়েই বর্তমান পরিস্থিতি এক কথায় অসহনীয়। এ অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে বিশিষ্ট শিল্পপতি নুরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেছেন। দেশের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে মানুষের কর্মসংস্থানে নুরুল ইসলামের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যমুনা গ্রুপ প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি অসামান্য মেধা, শ্রম, দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে ধাপে ধাপে গড়ে তোলেন ৪১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যমুনা ফিউচার পার্ক, যমুনা টেলিভিশন এবং দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে লক্ষাধিক মানুষ কর্মরত রয়েছেন। তার শেষ সময়ের কথাগুলো স্মরণ করি। মৃত্যুর প্রাক্কালে স্টিভ জবসের মতো তিনিও চিকিৎসকদের উদ্দেশে প্রাণের আকুতি রেখে বলেছেন, ‘আমার সব সম্পদ দিয়ে দেব। শুধু আমার কষ্টটা একটু কমিয়ে দাও। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।’
এসব দুঃখ-কষ্টের মাঝেই অনেক প্রিয়জন এ করোনা দুর্যোগকালে আমাদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। বিদায় নিয়েছেন কর্মীবান্ধব-সংগঠক ও নেতা, বন্ধুবৎসল এবং অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী মোহাম্মদ নাসিম। সাংবাদিক মহলসহ দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। আমরা যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, তাদের প্রতি আচরণ তার এতটাই বিনম্র ছিল যে, বিস্মিত হতে হতো! বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মোহাম্মদ নাসিম ভয়ভীতি উপেক্ষা করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারির নেতা। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি, কোনোদিন অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত শোকবার্তায় যথার্থই বলেছেন, ‘বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি।’ তার এ অকাল মৃত্যুতে ব্যক্তিগতভাবে আমি হারিয়েছি আমার পরম স্নেহভাজন অকুতোভয় প্রিয় সহযোদ্ধাকে, আর প্রিয় দেশবাসী হারিয়েছেন তাদের কাছের মানুষ, প্রিয় নেতা ও সংগঠককে।
এ দুর্যোগকালে আমরা আরও হারিয়েছি নিবেদিতপ্রাণ নেত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে। তিনি ছিলেন নির্ভীক, সৎ ও বলিষ্ঠ সংগঠক। স্বৈরশাসনের কঠিন দিনগুলোতে আমাদের যখন বিভিন্ন মামলার আসামি করে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হতো, তখন অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন আমাদের পক্ষে দাঁড়াতেন। বলিষ্ঠ কণ্ঠে আইনের শাসন ও রাজনৈতিক অধিকারের পক্ষে কথা বলতেন। দুঃসময়ে আমাদের পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন। সারা দেশের আইনজীবীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিস্তার এবং আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ গঠনে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। দলের নেতাকর্মীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় নেত্রী ছিলেন তিনি। সংগ্রামী নেত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের মৃত্যু আওয়ামী লীগ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
ফিরে আসি শাজাহান সিরাজের কথায়। তিনি যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এ্যাপোলো হাসপাতালে (বর্তমান এভারকেয়ার হসপিটাল) চিকিৎসাধীন তখন আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আজ স্মৃতির পাতায় সেই দিনটির কথা ভেসে ওঠে। আমাকে কাছে পেয়ে ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। অতীতের স্মৃতিচারণ করে সুখ-দুঃখের অনেক কথাই তিনি সেদিন বলেছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে উত্থান-পতন থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনে অমায়িক, ভদ্র ও শান্ত চরিত্রের অধিকারী শাজাহান সিরাজ বয়োজ্যেষ্ঠদের যেমন সম্মান প্রদর্শন করতেন, তেমনি প্রিয়ভাজন অনুজদের প্রতি তার ছিল অগাধ স্নেহ-ভালোবাসা। তার সংগ্রামী স্মৃতির প্রতি- সেই সঙ্গে করোনাকালে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন সবার প্রতি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করছি।
তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন