পদত্যাগের জন্য গত কয়েক সপ্তাহ চাপে থাকার পর শেষমেশ প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাস্টিন ট্রুডো। একই সঙ্গে তিনি নিজ দল কানাডার লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব থেকেও সরে দাঁড়াচ্ছেন। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ট্রুডোর রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ এক অধ্যায়ের অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
২০১৩ সালে এমন এক সময় তিনি লিবারেল পার্টির দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যখন দলটি গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত ছিল। সেই সময় কানাডার হাউস অব কমন্সে তৃতীয় অবস্থানে নেমে গিয়েছিল লিবারেল পার্টি।
সেখান থেকে দলকে টেনে তুলে ২০১৫ সালে ক্ষমতায় বসেন ট্রুডো। এরপর থেকে টানা গত নয় বছর ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন লিবারেল পার্টির এই নেতা।
পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার জন্য আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন ট্রুডো গতকাল বলেন, আমি যখন ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী হই তখন থেকেই কানাডার স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছি। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে মজবুত করার জন্য কাজ করেছি আমি।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেবা করার সুযোগ পাওয়ায় আমি গর্বিত। করোনা মহামারির সময়ে আমি দেশের মানুষের পাশে থেকে সেবা করতে পেরেছি, গণতন্ত্রকে মজবুত করার জন্য কাজ করেছি।
সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডো বলেন, নিজের পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করার পর তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে লিবারেল পার্টি নতুন একজন নেতা নির্বাচিত না করা পর্যন্ত তিনি নিজ পদে দায়িত্ব পালন করবেন।
কিন্তু তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকা ট্রুডো হঠাৎ পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন কেন? তিনি ক্ষমতা ছাড়ার পর লিবারেল পার্টির পরবর্তী নেতা কীভাবে বেছে নেওয়া হবে?
চাপে ছিলেন ট্রুডো
এ বছর কানাডায় সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা যাচ্ছে। কিন্তু তার আগেই দলের নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হলেন জাস্টিন ট্রুডো।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে কানাডায় বেশকিছু জনমত সমীক্ষা চালানো হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, কয়েক বছর আগেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ট্রুডো ক্রমেই ভোটারদের আস্থা হারাচ্ছেন।
এর অর্থ হলো এবারও যদি তিনি লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে থাকেন, তাহলে দলটি আগামী নির্বাচনে হেরে যেতে পারে। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিরোধিদের পাশাপাশি নিজ দলের ভেতর থেকেও বেশ চাপে ছিলেন ট্রুডো।
লিবারেল পার্টির সদস্যরা গত গ্রীষ্মকাল থেকেই প্রধানমন্ত্রীকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন। ওই সময় টরোন্টোর একটি উপনির্বাচনে কনজারভেটিভদের কাছে ব্যাপক ভোটে পরাজিতও হয় লিবারেলরা।
গত ডিসেম্বর মাসের জনমত সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে, কানাডার নাগরিকদের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ ট্রুডোর নেতৃত্বে ভরসা রাখেন। ২০১৫ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গত নয় বছরে জনসমর্থন এত কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দেখা যায়নি।
টরোন্টোয় বিবিসির সংবাদদাতা জেসিকা মারফি বলেছেন, কানাডায় রাজনৈতিক অস্থিরতা এমন একটা সময় দেখা দিলো যখন দেশটি অর্থনৈতিক কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছে, যার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য কারণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নিতে চলেছেন আগামী ২০ জানুয়ারি।
তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প বলেই দিয়েছেন যে কানাডা যদি অনুপ্রবেশকারীদের এবং বেআইনি মাদক আমেরিকায় প্রবেশের ওপরে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে তাহলে কানাডা থেকে আসা পণ্যের ওপরে তিনি ২৫% কর আরোপ করবেন। এই পরিমাণ কর কানাডার অর্থনীতিকে শেষ করে দিতে পারে।
বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে গত মাসে পদত্যাগ করেন কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড।
এই কঠিন চ্যালেঞ্জ আসলে কতটা অনুধাবন করতে পেরেছেন ট্রুডো, সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হঠাৎই ইস্তফা দেন দেশটির অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, বলছিলেন জেসিকা মারফি।
মূলত এ ঘটনার পর থেকেই ট্রুডোর ওপর পদত্যাগের চাপ বাড়তে থাকে।
পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত
তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা ট্রুডো বলেছেন যে, বিশ্ব বর্তমানে একটি জটিল সময় পার করছে। এমন একটি সময়ে কানাডাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য দেশটির পার্লামেন্টে নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন।
এ অবস্থায় আগামী ২৪ মার্চ পর্যন্ত পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে লিবারেল পার্টি নতুন নেতা নির্বাচন করার কথা রয়েছে। সাধারণত রাজনৈতিক সংকটের সময় পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করা হয়। এর ফলে পার্লামেন্ট না ভেঙেই দেশে বিতর্ক বা ভোটাভুটি বন্ধ রাখা যায়।
২০২০ সালেও বিশেষ এক রাজনৈতিক পরিস্থিতে পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করেছিলেন ট্রুডো।
লিবারেলদের পরবর্তী নেতা কে?
পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত থাকা অবস্থায় আগামী ২৪ মার্চের মধ্যে কানাডার লিবারেল পার্টিকে তাদের নতুন নেতা বেছে নিতে হবে। কিন্তু কোন কোন প্রক্রিয়ায় কীভাবে দলটি নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবে, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়।
সাধারণত চার-পাঁচ মাসের একটি লম্বা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দলগুলো নতুন নেতা নির্বাচন করে থাকে। এর প্রক্রিয়ার মধ্যে আনুষ্ঠানিক একটি সম্মেলনও অন্তর্ভুক্ত থাকে।
কিন্তু এবার নেতা নির্বাচন করার জন্য লিবারেলরা বেশি সময় পাবেন না। তবে দলের নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া যে বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, সোমবারের ভাষণে সেটি আভাস দিয়েছেন ট্রুডো।
তিনি বলেছেন যে, দেশব্যাপী একটি শক্তিশালী ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লিবারেল পার্টির নতুন নেতা নির্বাচন করা হবে।
কানাডার লিবারেল পার্টির প্রেসিডেন্ট সচিত মেহরা জানিয়েছেন যে, তাদের নতুন নেতা নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা করার জন্য খুব শিগগিরই একটি দলের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসবেন।
ট্রুডোর উত্তরসূরি কে হতে যাচ্ছেন, সেটি এখনও পরিষ্কার নয়। তবে বেশ কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ট্রুডোর সরকারের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, পরিবহনমন্ত্রী অনিতা আনন্দ এবং কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা মার্ক কারনির নাম বেশ আলোচনায় রয়েছেন। তথ্যসূত্র: বিবিসি
দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত