ফিচার্ড বিশ্ব

হিজাব পুড়িয়ে বিক্ষোভ, ৬ দিনে নিহত অন্তত ৩১, প্রেসিডেন্টের হুঁশিয়ারি

হাসপাতালে মারা যাওয়া তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যুতে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ইরান

হিজাব পুড়িয়ে বিক্ষোভ, ৬ দিনে নিহত অন্তত ৩১, প্রেসিডেন্টের হুঁশিয়ারি

মাথায় হিজাব না থাকায় ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হাতে (মর‌্যালিটি পুলিশ) গ্রেপ্তার, হেফাজতে থাকা অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ হওয়া এবং পরে হাসপাতালে মারা যাওয়া তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যুতে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ইরান। বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সেই বিক্ষোভের ষষ্ঠ দিন চলছে।

বিক্ষোভকারীদের ওপর দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর তাণ্ডবে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩১ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন। নরওয়ে ভিত্তিক এক এনজিও এই তথ্য জানিয়েছে।

এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টম্বর) বিক্ষোভকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি।

নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৭তম সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে এক সংবাদ সম্মেলনে রাইসি বলেন, বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড মেনে নেওয়া হবে না। মাহশা আমিনির মৃত্যু ঘিরে তিনি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান।

ইরানের এই প্রেসিডেন্ট আরও বলেছেন, ইরানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড অগ্রহণযোগ্য। ২০১৯ সালের পর দেশটিতে তুমুল বিক্ষোভ চলছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের বিক্ষোভে দেশটির নারীরা প্রথম সারিতে আছেন। তারা হিজাব নাড়ছেন এবং তা পুড়িয়ে ফেলছেন। দেশটির ধর্মীয় নেতাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে অনেকে প্রকাশ্যে নিজের চুল কাটছেন।

মাহশা আমিনির বাবা আমজাদ আমিনি বলেছেন, চিকিৎসকরা মাহশার মৃত্যুর পর তাকে আর দেখতে দেয়নি। ইরানের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, মাহশা হার্ট অ্যাটাক করেন এরপর কোমায় মারা যান। কিন্তু মাহশার পরিবার বলছে, মাহশার আগে কোনো হার্ট অ্যাটাক হয়নি, তার স্বাস্থ্যও ভালো ছিল।

এদিকে, ইরানের মানবাধিকার সংস্থার (আইএইচআর) পরিচালক মাহমুদ আমিরি মোঘাদ্দাম এক বিবৃতিতে বলেন, ইরানের জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা আদায়ে রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু ইরান সরকার বুলেট দিয়ে তাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমন করছে।

গত শুক্রবার পুলিশের হেফাজতে মারা যান মাহশা। এরপর টানা আট দিনের মতো চলছে দেশটিতে বিক্ষোভ। বিক্ষোভ দমাতে দেশটির কর্তৃপক্ষ সামাজিম যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ-ইন্সটাগ্রাম সেবাও বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া ইরানজুড়ে উল্লেখযোগ্য ইন্টারনেট পরিষেবাও বিপর্যয় ঘটেছে। দেশটির লাখ লাখ মানুষ এখন অফলাইনে।

আইএইচআর নিশ্চিত করেছে, ইরানের ৩০ টির বেশি শহরে এবং অন্যান্য নগর কেন্দ্রেও বিক্ষোভ চলছে। দেশটির নিরাপত্তাবাহিনী গণহারে বিক্ষোভকারীদের এবং সিভিল সোসাইটির অ্যাক্টিভিস্টদের গ্রেপ্তার করছে।  সূত্র: রয়টার্স, এএফপি

টিএইচ

সেদিন কী ঘটেছিল : ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানে যখন তাকে আটক করা হয়, তখন আমিনির মাথার হিজাবের নিচ দিয়ে কপালের ওপর কিছু চুল বেরিয়ে ছিল বলে অভিযোগ করেন নৈতিকতা পুলিশ। এই বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়ার এক পর্যায়ে কোমায় চলে যান তিনি। তিন দিন পর পুলিশ হেফাজতে হাসপাতালেই মারা যান মাহসা। তবে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ।

নৈতিকতা পুলিশ কারা : গাশত-ই এরশাদ (গাইডেন্স পেট্রোল) হলো ইরানের বিশেষ পুলিশ ইউনিট, যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইসলামিক নৈতিকতার সম্মান নিশ্চিত করা। ইসলামি রীতিবিরুদ্ধ বা অশালীন পোশাক পরিহিত লোকজনকে আটক করা। বাজার, শপিং সেন্টার , বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে থেকে নারীদের পোশাক-পরিচ্ছদের ওপর নজরদারি করে তারা।

ওরা খুবই কঠোর : তেহরানের অতিরক্ষণশীল তৎকালীন মেয়র মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রচারণা চালানোর সময় নিজেকে এ বিষয়ে আরও বেশি প্রগতিশীল দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরের বছর তার নির্বাচনি বিজয়ের পরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে গাশত-ই এরশাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। নৈতিকতা পুলিশের কঠোর পদ্ধতির সমালোচনা করতে থাকে জনগণ। তারা মহিলাদের আটক করে তখনই মুক্তি দেয়, যখন কোনো আত্মীয় ভবিষ্যতে নিয়ম মেনে চলার আশ্বাস দেন। ইসফাহানের মধ্য শহর থেকে একজন নারী বলেন, ‘লিপস্টিক লাগানোর কারণে আমি আমার মেয়েসহ গ্রেফতার হয়েছিলাম। তারা আমাদের থানায় নিয়ে যায় এবং আমার স্বামীকে আসতে বলে। একটি কাগজে সই করতে বলে যে ভবিষ্যতে হিজাব ছাড়া বের হতে পারব না।’

বিপ্লবোত্তর ডিক্রি : ‘খারাপ হিজাব’ কিংবা অন্যান্য বাধ্যতামূলক পোশাক ভুলভাবে পরার বিরুদ্ধে ইরানি কর্তৃপক্ষর লড়াই শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পরপরই। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল মহিলাদের শালীন পোশাকে অভ্যস্ত হতে বাধ্য করা। এর আগে ক্ষমতায় ছিলেন পশ্চিমাপিন্থ শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। ওই সময়ে তেহরানের রাস্তায় মিনিস্কার্ট এবং এলোচুলে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য ছিল খুবই স্বাভাবিক। ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যে শাহ আমলে প্রতিষ্ঠিত নারী অধিকার রক্ষার আইন বাতিল শুরু হয়।

লড়াইটা শুরু হয়েছিল তখনই : খোমেনির ডিক্রি সত্ত্বেও মহিলাদের যথাযথ পোশাক নির্ধারণ করতে কর্তৃপক্ষের কিছু সময় লেগেছিল। কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলেও পোস্টার এবং ব্যানার বানিয়ে অফিসের দেওয়ালে টানানো হয়েছিল ছবি, আর বলা হয়েছিল, এই নিয়মে পোশাক পরে অফিসে প্রবেশ করা বাধ্যতামূলক।

মানবাধিকারকর্মী মিসেস কার বলেন, ‘বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে লড়াইটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। আমরা আমাদের চুল সঠিকভাবে না ঢেকেও আমরা সৃজনশীল ছিলাম।’

 

 



সংবাদটি শেয়ার করুন