ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

প্রায়শ্চিত্ত | দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

এ সপ্তাহের  গল্প : প্রায়শ্চিত্ত | দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

হঠাৎ ট্রেনের কামরায় একটা আঁশটে গন্ধ। চিৎকার চেঁচামেচি সকলের ” শুঁটকি মাছ তুলেছে কামরায়”। ঝাঁপিয়ে পড়া হাওয়ায় গন্ধটা যেন আরো প্রকট হতে লাগলো। ঘুম উঠলো লাটে। গন্ধে এক ভদ্রমহিলার বমি হবার উপক্রম।তার স্বামীর লম্ফঝম্প শুরু হয়ে গেল। বিভিন্ন মন্তব্যে কামরা উত্তাল। উৎসাহী দুজন গেটের কাছে নাইলনের ব্যাগে শুঁটকি মাছের গন্ধের উৎস আবিস্কার করল। দেখলাম এক ষাটোর্ধ বৃদ্ধা ব্যাগ নিয়ে গেটের কাছে বসে। এ প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। ফুলেশ্বরে শুঁটকি মাছের আড়ত।তাই এরা এখান থেকে মাছ নিয়ে সাঁকরাইল যায় বিক্রি করতে। এভাবেই কটা ষ্টেশন গন্ধ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। বয়স্কা মহিলাকে দেখে কেমন যেন মায়া হল।এই বয়সেও পেটের আগুন মেটাতে প্রতিদিন লড়তে হয় ! মনখারাপের ডানা ঝাপটানো আমার ভেতর ঘরে!

হঠাৎ কামরায় দুজন টিকিট চেকারের উদয়। সকলের চিৎকার , ওকে পরের ষ্টেশনে নামিয়ে দিতে হবে এ কামরা থেকে।টিটি দুজন তো বেশ বেকায়দায়।তারা জানে আসল সত্যটা।সকলের দাবি জোরালো হতে থাকলে ওরা বৃদ্ধাকে পরের ষ্টেশনে নেমে যাওয়ার জোর করতে লাগলো। বৃদ্ধার চোখে কান্না। বুঝলাম, বিক্রি না হলে ও খাবে কি !

উল্টোদিকে বসা এক ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে রিমলেস চশমা। বেশ ব্যক্তিত্বময় চেহারা। ভদ্রলোক চেকারদের দিকে এগোতেই ওরা “স্যার, স্যার” করে এগিয়ে এলো। বুঝলাম , বড়ো কোন পদাধীকারী হবেন ভদ্রলোক। ভদ্রলোক হাত জোর করে সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন :” আমি আপনাদের কয়েকটা কথা বলতে  চাই, কোন পদাধিকারী হয়ে নয়, একজন বিবেক সম্পন্ন মানুষ হয়ে। আপনারা এই বুড়িমাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, ও কেন এই কামরায় উঠলো? ওর কাছে বৈধ টিকিট আছে। মান্থলি। ওর মতো মানুষগুলোকে ভেন্ডার কামরায় উঠতে দেওয়া হয় না। সেখানে ফুল, ছানা,পানের রাজত্ব। এদের ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়। এরকম করার ওরা প্রশ্রয় পায় টিটি ও রেল পুলিশের। কারণটা আপনারা জানেন। তাহলে এই প্রান্তিক  মানুষগুলো যাবে কোথায়? এ বয়সেও একে মাছ বিক্রি করে পেটের ভাত জোগাড় করতে হয়।  আপনার আমার মায়ের মতই কষ্টে বড়ো করেছেন ছেলেকে। সেই ছেলে মাকে ভাত দেয় না। কি করবে বলুনতো এই বয়সে? একটু এনার জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবুন। আর একটু মানবিক হতে হবে আমাদের”। ভদ্রলোকের গলা যেন জড়িয়ে এলো। চা বিক্রেতার কাছ থেকে এক কাপ চা কিনে বৃদ্ধার হাতে দিয়ে উনি আবার আগের সিটে এসে বসলেন। বুড়িমার সারা মুখ জুড়ে প্রশান্তি। অবস্থা অনুকুল দেখে ওনাকে নমস্কার জানিয়ে টিটি দুজন নেমে গেল পরের ষ্টেশনে।

বাকরুদ্ধ  কামরার সকলে। চিৎকারের মুখগুলো মাথা নিচু করে। বুকে জোর ধাক্কা লেগেছে বোঝা গেল। ভদ্রলোকের তীক্ষ্ণ ও শাণিত কথাবার্তায় আমি মুগ্ধ। পরিচয় করতে বাড়িয়ে দিলাম হাত। ওনার পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, হাওড়ার টিটিদের বড়বাবু। ওদের ডিউটি ঠিক হয় ওনার নির্দেশেই। মুখ নীচু করে নীরব রইলেন। হঠাৎ দেখলাম কয়েক ফোঁটা চোখের জল পড়ল ওনার পায়ের বুটের ওপর। উনি কাঁদছেন ! চমকে উঠলাম। কান্নার ইতিহাস জানার আগ্রহ তৈরি হলো। ভদ্রলোক চোখ তুলে তাকালেন।  আমার প্রশ্নের উত্তরে উনি তখন অতীতের পথে।

কয়েক বছর আগের কথা। উনি তখন হাওড়া স্টেশনের গেটে ডিউটি করেন। আসা যাওয়ার পথে যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা। টিকিট না থাকলে ফাইন। কিন্তু ওনার পয়সার লোভ ওনাকে বিপথগামী করে। অসৎভাবে পয়সা উপার্জনের নেশা চেপে বসে ঘাড়ে। একদিন এক বৃদ্ধাকে টিকিট না থাকার জন্য জোর করে শাক বিক্রির পুরো টাকাটাই নিয়ে নেন। অসহায় বৃদ্ধা বার বার বলতে থাকে, ও ফিরতে পারবে না বাড়ি। রাতের চালও কিনতে পারবে না। কিন্তু কে শোনে ওসব? শেষে যাবার সময় বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে বলে যান, টাকাটা কেড়ে নিয়ে ভালো করলেন না উনি। ওকেও কাঁদতে হবে একদিন বৃদ্ধার মতো। এর সপ্তাহ খানেক পরেই স্কুল থেকে ফেরার পথে ওনার স্ত্রী ও ছেলেকে একটা লরি পিষে দিয়ে চলে যায় রাস্তায়। বুড়িমার সেদিনের অভিশাপ! তারপর থেকে কেঁদেই চলেছেন। অনেক খুঁজেছেন সেই বুড়িমাকে। পান নি। পেলে পায়ে ধরে বলতেন, মা তোমার অভিশাপ ফিরিয়ে নাও। তাই ট্রেনে সবজি মাছ নিয়ে যাওয়া বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের ওপর অন্যায় দেখলেই গর্জে ওঠেন।

সারা কামরায় সকলের চোখে জল। এভাবে একটা মানুষ প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছে অহর্নিশ। বুকের দহনে পুড়ে চলেছে প্রতি মুহূর্ত! মনে মনে প্রার্থনা করলাম,হে ঈশ্বর একে শান্তি দাও।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন