বাবা ইদি নামে পরিচিত পাকিস্তানের এই সমাজকর্মী সম্পর্কে ২০১৩ সালে হাফিংটন পোস্ট লিখেছিল, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবিত মানবতাবাদী’। যার মৃত্যুতে ভারতের সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এক শোকবার্তায় বলেন, ‘তার পুরো জীবন তিনি মানবতার কল্যাণে ব্যয় করেছেন’।
সবচেয়ে বেশি সন্তানের অভিভাবক হয়েও যিনি ‘শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী’
এম. জেড || ‘মানবতার ওপর কোনো ধর্ম হতে পারে না’- এই মতবাদে বিশ্বাস করা মানবতাবাদী আবদুস সাত্তার ইদি ৯২ বছর বয়সে মারা যান ২০১৬ সালের ৮ জুলাই। বাবা ইদি নামে পরিচিত পাকিস্তানের এই সমাজকর্মী সম্পর্কে ২০১৩ সালে হাফিংটন পোস্ট লিখেছিল, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবিত মানবতাবাদী’। যার মৃত্যুতে ভারতের সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এক শোকবার্তায় বলেন, ‘তার পুরো জীবন তিনি মানবতার কল্যাণে ব্যয় করেছেন’।
সারা পৃথিবীর কাছে পাকিস্তানের যে উগ্র ইমেজ পরিচিত, বাবা ইদি ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ। গুজরাটে জন্ম নেয়া ইদি ১৯৪৭ দেশ বিভাগের সময় পাড়ি জমান পাকিস্তানে। চরম অভাবের মধ্যে মায়ের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু তার জীবনের গতি বদলে দেয়। অসহনীয় অর্থকষ্টে থেকেও তিনি মানবতার সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫১ সালে করাচির ছোট এক গলিতে তিনি প্রথম ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে তার কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে এশিয়ান ফ্লু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে তিনি তার প্রথম অ্যাম্বুলেন্স কিনে মানবতার সেবায় তা কাজে লাগান। স্ত্রী বিলকিস ইদি ছিলেন তার সবচেয়ে বড় সহযোগী।
বর্তমানে ইদি ফাউন্ডেশনের ১৮০০ অ্যাম্বুলেন্স বিরতিহীন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একক অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। তাদের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সও আছে। শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা নয়, প্রসূতি সেবা, দাফন কার্যক্রম, এতিমখানা, প্রবীণদের জন্য বৃদ্ধনিবাস স্থাপনসহ নানামুখী কাজ করছে ইদি ফাউন্ডেশন।
সন্ত্রাসী হামলা থেকে শুরু করে প্রতিটি বিপর্যয়ে তার প্রতিষ্ঠান এগিয়ে গিয়েছে সবার আগে। র্যামন ম্যাগসেসে পদকজয়ী বাবা ইদির নাম অনেকবার নোবেল শান্তি পদকের জন্য বিবেচিত হয়েছে। নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের বাবাসহ পাকিস্তানের ত্রিশ হাজারের বেশি মানুষ তাকে নোবেল পদক দেয়ার জন্য এক পিটিশনে স্বাক্ষর করেন। তবে এসব বিষয়ে তার কোনো আগ্রহ ছিল না।
তিনি ছিলেন লাখ লাখ মানুষের আশ্রয়স্থল। ধর্ম, জাতি, বর্ণ কোনো কিছুই তার কাছে বিবেচ্য ছিল না। তার কাছে আশ্রয় পাওয়া অনাথ এতিম বিশ হাজার শিশুর জীবন বদলে গিয়েছে। এরা যখন বড় হয় তখন জাতীয় পরিচয়পত্রে অভিভাবকের নাম লেখার প্রসঙ্গ আসে। এদের পারিবারিক কোনো পরিচয় ছিল না। বাবার নামের জায়গায় ইদি তখন নিজের নাম লেখেন। যা পরে আদালতে গড়ায়। আদালতের অনুমোদনক্রমে ইদি এদের সবার অভিভাবক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সে হিসেবে তার জীবিতকালে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি সন্তানের অভিভাবক। এ কারণে সবাই তাকে বাবা ইদি বলে ডাকেন। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষেরা তাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। তাদের দেয়া ছোট ছোট অনুদানেই ইদি ফাউন্ডেশন পরিচালিত হয়। জানা যায়, একবার পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক তাকে বড় অঙ্কের অর্থ সাহায্য দিতে চাইলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন। এতে জিয়াউল হক তার প্রতি ক্ষিপ্ত ছিলেন।
তার প্রতিষ্ঠান একপর্যায়ে অনেক ফান্ড পেলেও তিনি সেখান থেকে কিছুই গ্রহণ করেননি। তার নিজস্ব কোনো গাড়ি বা বাড়ি ছিল না। এক রুমের একটি জানালাবিহীন ঘরে তিনি থাকতেন। সেটাই ছিল তার অফিস কক্ষ। একবার তার বাড়িতে চোর চুরি করতে এসে নেয়ার মতো কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে সামান্য যেসব আসবাব ছিল, তা ছুড়ে ফেলে চলে যায়। সব সময়ই তিনি সর্বোচ্চ দুই সেট পোশাক রাখতেন। এক সেট পরতেন, অন্যটি ধুয়ে দিতেন।