পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
৩৭ জনের মন্ত্রিসভা, ১৯ জনই নতুন মুখ, আজ শপথ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আলোচনা ছিল নতুন মন্ত্রিসভায় কারা আসছেন তা নিয়ে। গতবারের মতো এবারের মন্ত্রিসভায়ও রয়েছে চমক। এবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে, তাতে অর্ধেকের বেশি নতুন মুখ এসেছেন। প্রধানমন্ত্রীসহ মোট ৩৭ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে ১৯ জনই নতুন নিয়োগ পেয়েছেন।
গত মন্ত্রিসভার ১৫ জন মন্ত্রী ও ১৩ জন প্রতিমন্ত্রীকে বাদ দেওয়া হয়েছে। টানা চতুর্থবারসহ পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও এবার মন্ত্রিসভায় ২৫ জন মন্ত্রী ও ১১ জন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন।
২৫ জন মন্ত্রীর মধ্যে নতুন ১২ জন এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে সাতজন নতুন মুখ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৭ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মধ্যে ৩১ জন নতুন মুখ ছিলেন। গতবার তিনজন উপমন্ত্রী নিয়োগ করা হলেও এবার কাউকে উপমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীসহ ২৫ জন মন্ত্রী ও ১৯ প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছিল। ফলে গতবারের চেয়ে এবার মন্ত্রিসভায় ১১ জন কম মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী।
আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেবেন। এ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন প্রথমে প্রধানমন্ত্রীকে শপথ পড়াবেন। এরপর মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের শপথ পড়াবেন রাষ্ট্রপতি।
শপথের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দপ্তর বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
গতবারের মতো এবারও শেখ হাসিনার নতুন মন্ত্রিসভার সবাই আওয়ামী লীগের, শরিক দলের কাউকে তিনি ফেরাননি। মন্ত্রিপরিষদসচিব মো. মাহবুব হোসেন গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন তা আজ শপথের পর জানা যাবে।
নতুন মন্ত্রিসভা কেমন হলো—এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেউ কাজ শিখে আসেন না। কাজ করতে করতেই শেখা হয়। তবে মন্ত্রিসভায় যাঁরা এসেছেন তাঁদের মূল কাজ হবে দেশের গতিধারা অনুযায়ী সমস্যাগুলো সমাধান করা। এরপর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিসভা থেকে যাঁরা বাদ পড়েছেন তাঁরা সংসদে থাকবেন। ফলে আইন প্রণয়নের সময় তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবেন।’
৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা
৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভায় পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাচ্ছেন আ ক ম মোজাম্মেল হক (গাজীপুর-১), ওবায়দুল কাদের (নোয়াখালী-৫), নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন (নরসিংদী-৪), আসাদুজ্জামান খান (ঢাকা-১২), দীপু মনি (চাঁদপুর-৩), মো. তাজুল ইসলাম (কুমিল্লা-৯), মুহাম্মদ ফারুক খান (গোপালগঞ্জ-১), আবুল হাসান মাহমুদ আলী (দিনাজপুর-৪), আনিসুল হক (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪), মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ (চট্টগ্রাম-৭), মো. আব্দুস শহীদ (মৌলভীবাজার-৪), সাধন চন্দ্র মজুমদার (নওগাঁ-১), র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩), মো. আব্দুর রহমান (ফরিদপুর-১), নারায়ণ চন্দ্র চন্দ (খুলনা-৫), আব্দুস সালাম (ময়মনসিংহ-৯), মহিবুল হাসান চৌধুরী (চট্টগ্রাম-৯), ফরহাদ হোসেন (মেহেরপুর-১), মো. ফরিদুল হক খান (জামালপুর-২), মো. জিল্লুল হাকিম (রাজবাড়ী-২), সাবের হোসেন চৌধুরী (ঢাকা-৯), জাহাঙ্গীর কবির নানক (ঢাকা-১৩), নাজমুল হাসান (কিশোরগঞ্জ-৬), ইয়াফেস ওসমান (টেকনোক্র্যাট) এবং সামন্ত লাল সেন (টেকনোক্র্যাট)।
এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন সিমিন হোসেন রিমি (গাজীপুর-৪), নসরুল হামিদ (ঢাকা-৩), জুনাইদ আহমেদ (নাটোর-৩), মোহাম্মদ আলী আরাফাত (ঢাকা-১৭), মহিবুর রহমান (পটুয়াখালী-৪), খালিদ মাহমুদ চৌধুরী (দিনাজপুর-২), জাহিদ ফারুক (বরিশাল-৫), কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা (খাগড়াছড়ি), রুমানা আলী (গাজীপুর-৩), শফিকুর রহমান চৌধুরী (সিলেট-২) ও আহসানুল ইসলাম (টাঙ্গাইল-৬)।
বাদ পড়লেন ১৫ মন্ত্রী ও ১৩ প্রতিমন্ত্রী
মন্ত্রীদের মধ্যে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় বীর বাহাদুর উশৈ সিং, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার নতুন মন্ত্রিসভায় থাকছেন না।
বয়স আর অসুস্থতার কারণে গত দুইবার বাজেট দেওয়ার সময় যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। তাঁর দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তাঁদের দুজনের কেউই থাকছেন না নতুন মন্ত্রিসভায়।
গত সরকারের প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসাও থাকছেন না মন্ত্রিসভায়।
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন এবং সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এবার জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। ফলে তাঁদের না থাকা অনুমিতই ছিল। মনোনয়ন পেয়েও ভোটে হেরে যাওয়ায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. স্বপন ভট্টাচার্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সংসদ থেকেই বাদ পড়েছেন।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অর্থ, বাণিজ্য, পরিকল্পনা ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব পালন করা জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের নতুন মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা। বিষয়টিকে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বরাবরই বেশ সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর প্রথম মন্ত্রিসভায় প্রবীণ ও নবীনের সমন্বয় ছিল, সেই সঙ্গে মন্ত্রিসভার আকারও তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল। দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় তারুণ্যের আধিক্য থাকলেও পরবর্তীকালে প্রবীণদের অন্তর্ভুক্ত করে সমতা আনার চেষ্টা করেছেন। তৃতীয় মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে ১৪ দলীয় জোটের শরিক ও জাতীয় পার্টি থেকেও বেশ কয়েকজনকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। চতুর্থ মন্ত্রিসভা অনেক বেশি নতুননির্ভর, অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। গতবারের মতো এবারের মন্ত্রিসভায়ও অনেক বেশি নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য রয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য অভিজ্ঞতার ঘাটতির কথাও বলেছেন।
সরকারের ২৫ জন মন্ত্রীর মধ্যে ১৩ জনই একেবারে নতুন। বিদায়ি সরকারে না থাকলেও আগে মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করেছেন এমন চারজনকে শেখ হাসিনা ফিরিয়ে এনেছেন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে। এ ছাড়া গত সরকারের দুইজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন উপমন্ত্রী এবার পদোন্নতি পেয়ে মন্ত্রী হয়েছেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন গত সরকারে অনির্বাচিত (টেকনোক্র্যাট) মন্ত্রী ছিলেন তিনজন, তাঁদের মধ্যে একজনকে এবারও সরকারে রাখা হয়েছে। এর বাইরে টেকনোক্র্যাট হিসেবে মন্ত্রীর দায়িত্বে এসেছেন আরো একজন।
আবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
এদিকে গতকাল দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। সেই সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য সম্মতি দেওয়া হয়। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এসংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন সংসদ সদস্য শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এতে আরো বলা হয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন রাষ্ট্রপতি। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে গণ্য হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে বলা হয়।
সূত্র: কালের কন্ঠ