মৎস মারিব খাইবো সুখে -৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার
আমি পিছু ফিরে তাকাই। শব্দের উৎস খুঁজতে যেয়ে আমায় তাকাতে হয় ঊর্ধ্বাকাশে। আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে ছায়ামূর্তির পুরো শরীর ধরা দেয় না। আমি পিছিয়ে যেয়ে ওকে দেখার চেষ্টা করি। করুই গাছের মতো ওর শরীর উঠে গেছে আকাশ পানে। বিশাল এক কাঁধের উপর ছোট্ট এক লালচে মুখ। নর্থ আমেরিকার পুলিশ মিলিটারি অধিকাংশই শরীরে অতিকায় হয়। এরা আমাদের দেশের মতো আনুভূমিক ভাবে জায়গা দখল করে না। এদের দেখলেই কেমন যেন অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। আজ এই কনজারভেশন অফিসারকে দেখে আমায় একটা আতংক ঘিরে ধরে। সুঠাম দেহ, চোখে কালো গগলস, কোমরবন্ধে পিস্তল,রোপ, টর্চ-লাইট, গলায় বাইনোকুলার সহ নানা সরঞ্জামে ও নিজকে সজ্জিত করেছে। আমার চোখের সামনে জোনাথন সুইফটের গ্যালিভারকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আতংকের পাশাপাশি দু’চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। দুএকবার মুখ ফসকে পরম্পরা থেকে পাওয়া সেই স্যার শব্দটা বেড় হয়ে আসে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ভুলে গেছি আমার লাইসেন্সের কথা। ওয়ালেট তন্য তন্য করে খুঁজে outdoor card টা পেতেই ওর দিকে এগিয়ে দেই। ও আমায় আস্বস্ত করে, মুখে বলে take your time. আমি কিছুতেই মনে করতে পারি না কোথায় লাইসেন্স রেখেছি। কোন দিন কেউ কনজারভেসন অফিসারকে দেখতে পায়নি বলে, আমি তেমন গুরুত্ব দেইনি। হঠাৎ করে মনে পড়ে আমিতো অনলাইনে লাইসেন্স রিনিউ করেছি। ওর একটা সফ্টকপি আমি আমার সেল ফোনে সেভ করে রেখেছি। আমি সফ্ট কপিটা ওকে দেখাই। ও সন্তুষ্ট হতে পারে না। ও চায় হার্ডকপি। আশে পাশের অনেকে মাছ ধরছে ওদের সাথে বিশেষ করে ওর মতো লালচে বর্ণের সাথে অতি বিনয়ের সাথে ও হাই হ্যালো বলে যায়। মনে মনে ভাবি আজ আমি ওর শিকার ও আমায় সহজে ছাড়বে না। ও আমার মাছের পাত্রটা উল্টিয়ে ফেলে ধরা পড়া মাছগুলো মেপে জুখে নানান ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে। সাথে অনেক উপদেশ। আমি প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করি এই বুঝি ও আমার দিকে হলুদ স্লিপ এগিয়ে দেবে। নর্থ আমেরিকার পুলিশ বর্ণবাদকে বর্জন করতে পারেনি। সংবাদ পত্রে, খবরে এমনি অনেক খবর আসে। আজ আমি যে বর্ণবাদের শিকার হয়েছি তা বুঝতে দেরী হয় না ওর আচরণ দেখে। ও কোন অনিয়ম না পেয়ে আমায় ছেড়ে দেয়। আমি ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে, মাছ ধরার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গাড়ী চালিয়ে যাই। রেয়ার মিররে হঠাৎ করে ওর গাড়ীটা চোখে পড়ে। মনে প্রশ্ন জাগে ওকি আমাকে অনুসরণ করছে? একটা চরম বিরক্তি আমার চোখে মুখে। ও আমায় গাড়ী থামাতে বলে। আমি ওকে অনুসরণ করে একটা শপিং মলের প্যাকিং লটে গাড়ী পার্ক করি। মনে ভেসে ওঠে অতীতের এমনি কিছু অপ্রিয় স্মৃতি।
আমাদের মাড়োয়ারি পট্টি। আমাদের এলাকার প্রতিটা বাড়ী রাস্তামুখী। বাড়ির পেছনটা মিশে গেছে একটা অভিন্ন জলাভূমিতে। সে জলাভূমিতে মাছ চাষ হয়। প্রতি বছর সে জলাভূমি ইজারা দেওয়া হয়। বর্ষাকালে এক ভয়ঙ্কর দর্শন এক যুবক সেই জলাভূমি পাহারা দিতো। আমার দাদা সহ আর অনেকেই লুকীয়ে লুকীয়ে মাছ ধরত। হঠাৎ হঠাৎ করে সেই যুবক ধাওয়া করতো। আমরা প্রাণপণে দৌড়ে কারোর বাসায় ঢুকে পড়তাম। ভয়ঙ্কর হলেও ও কখনো কোন private property তে ঢুকত না। কিন্তু এখানকার কনজারভেশন অফিসার অনেক ক্ষমতাবান। তারা প্রয়োজনে private property তে ঢুকে পড়তে পারে, কারোকে গ্রেফতার করতে পারে। এ ক্ষমতাবান অফিসারটি আমার গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে ফেলে, এখানে সেখানে তণ্য তণ্য করে খুঁজে দেখে কোথাও কোন মাছ লুকিয়ে রেখেছি কিনা। সার্চ শেষে আমি হতবিহবল হয়ে বাসায় ফিরে আসি। পরবর্তী দুবছর চলে যায় মাছ ধরার আগ্রহ ফিরে পেতে।
ইতোমধ্যে ওদের সম্বন্ধে অনেক জেনেছি। যতো জানি তত শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে কানাডার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করার জন্য প্রণীত আইন এবং তার উপযুক্ত প্রয়োগ দেখে। আজ আর অফিসারটিকে তেমন বর্ণবাদী বলে মনে হয় না। একটা দেশ তখনি উন্নত হয় যখন তার নাগরিক প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করতে শেখে, অসহায় বৃক্ষরাজি, বন্যপ্রাণীদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র তথা জনমানব দেয় বিশেষ গুরুত্ব। তাই তো দেখি জনবহুল রাস্তায় যখন বন্য হাঁসগুলো দল বেঁধে নির্ভয়ে হেলে দুলে চলে, তখন বিশাল গাড়ীর বহর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। ড্রাইভিং পরীক্ষা দিতে যেয়ে রাকুনকে yield না দেওয়াতে যখন পরীক্ষক ফেল করিয়ে দেন – তখন সত্যি মনে হয় আমরা এক উন্নত বিশ্বে বসবাস করছি। যখন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে আলবার্টার হাইওয়ে জুড়ে বন্য প্রাণীদের চলাচল নিশ্চিত করতে ওভারপাস আান্ডারপাস তৈরি করা হয় তখন নিজকে সর্ব শ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে গর্ব করতে মোটেই দ্বিধাবোধ হয়না।
মৎস মারিব খাইবো সুখে -৫ | সুশীল কুমার পোদ্দার, ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান