ফুটবলের মাঠ থেকে মেকআপ রুমে, পেশা যখন মেকআপ আর্টিষ্ট : চ্যানেল এস থেকে একাত্তর। সিলেটের একমাত্র মেকআপ আর্টিষ্ট বিপ্রজিৎ
জীবন পাল ।। একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে পারফেক্ট ভাবে মেকআপ করতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা। শুধু যে মেয়েদেরকেই মেকআপ করতে হয় এমন কিন্তু নয়। টিভি স্ক্রীনে যেতে হয় এমন সবাইকেই মেকআপ নিতে হয়। অকেশন অনুযায়ী মেকআপের ধরন বদলে থাকে। প্রেজেন্টারদের গর্জিয়াস মেকআপ করা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তবে গর্জিয়াস মানে কিন্তু বিয়ের মেকআপ হলে হবেনা। মেকাপ নিয়ে এসব কথা বলছিলেন মেকআপ আর্টিষ্ট বিপ্রজিৎ। যিনি একজন মেকআপ আর্টিষ্ট হিসেবে বর্তমানে কর্মরত আছেন মেঘনা গ্রুপের একাত্তর টেলিভিশনে।
ফুটবলের মাঠ থেকে মেকআপ রুমে, পেশা যখন মেকআপ আর্টিষ্ট হয়ে উঠলো ক্রমান্বয়ে তিনি আর কেউ নন, পুরো নাম বিপ্রজিৎ পাল। যার জন্ম মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলার ফুলতলা ইউনিয়নের বটুলী গ্রামে। ২ ভাই ১ বোনের মধ্যে বিপ্রজিৎ দ্বিতীয়। বাবা বিধু ভূষন পাল দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। মা রেখা রানী পাল ছিলেন গৃহিনী। দুজনেই মারা গেছেন।
বিপ্রজিৎ পাল খুব ভাল ফুটবল খেলতেন। তাই ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ভাল ফুটবলার হওয়ার। বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার। সময় ও বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে স্বপ্নের পথে আর পাড়ি দিতে পারেন নি। মেকাপ আর্টিষ্ট হিসেবে ২০০৫ সালে ক্যারিয়ার শুরু করেন ইউকে ভিক্তিক টেলিভিশন চ্যানেল এস এর মৌলভীবাজার অফিসে। যেখানে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত নাটকের নায়ক-নায়িকাদের মেকআপ করানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। সময়ের সাথে সাথে এই পেশাটাকে আরো বেশি আপন করে নেওয়ায় স্বপ্নের পরিধিটা বাড়তে থাকে। জেলা শহরে এই মাধ্যমে কাজ করে ভাল কিছু করার সম্ভাবনা নেই দেখে ঢাকা শহরে কাজ করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। স্বপ্ন দেখতে থাকেন এফডিসিতে সিনেমার মেকআপ আর্টিষ্ট হিসেবে কাজ করার। সুযোগ না পাওয়ায় সেই স্বপ্নের দাড়প্রান্তেও পৌছাতে পারেন নি। তবে আগ্রহ না হারিয়ে কিভাবে একজন মেকআপ আর্টিষ্ট হিসেবে ঢাকায় কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায় সেটাই যেন তার চিন্তাচেতনায় পরিনত হয়ে যায়। অত:পর সেই কাঙ্খিত সুযোগ যেন তার দড়জায় কড়া নাড়ে। বেসরকারী টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের ঢাকা অফিসে কর্মরত সিলেটের পরিচিত একজনের মাধ্যমে মেকআপ আর্টিষ্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান বিপ্রজিৎ পাল। যিনি এই সুযোগ করে দেন তিনিও ইউকে ভিক্তিক টেলিভিশন চ্যানেল এস এর সাবেক কর্মী ছিলেন।
সুযোগ পেয়ে ২০১১ সালের ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ বেসরকারী টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের ঢাকা অফিসে মেকআপ আর্টিষ্টের কাজ শুরু করেন বিপ্রজিৎ। দীর্ঘদিনের স্বপ্নের আঙ্গিনায় পা রাখতে পেরে বিপ্রজিৎ বেজায় খুশি ছিলেন। তবে নিজেকে আরো পরিপক্ক মেকআপ আটিষ্ট হিসেবে গড়ে তুলতে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। এক নাগারে প্রায় ২ বছরের অধিক সময় একুশে টেলিভিশনের ঢাকা অফিসে কাজ করেন তিনি।
অত:পর একুশে টেলিভিশনে কাজের সুযোগ করে দেওয়া সিলেটের পরিচিত সেই ব্যক্তির মাধ্যমেই ২০১৪ সালে মেকআপ আর্টিষ্ট হিসেবে যোগদান করেন মেঘনা গ্রুপের একাত্তর টেলিভিশনে। প্রায় ৮ বছর ধরে একাত্তর টেলিভিশনে কর্মরত আছেন তিনি। বর্তমানে কাজ ও মেধা দিয়ে নিজের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন বিপ্রজিৎ।
জেলা শহর থেকে উঠে এসে ঢাকায় কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিপ্রজিৎ পাল জানান, আমার আজকের আমি হয়ে উঠার পেছনে যে দুইজন মানুষের যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা হলেন চ্যানেল এস এর, মোস্তফা কামাল এবং সাজন আহমেদ জয়। যাদের হাত ধরেই মেকআপে আমার হাতেখড়ি। জেলা শহরে ছোট্ট পরিসরে কাজ করলেও স্বপ্ন দেখতাম একদিন বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগ পাবো। তখন নিজের মেধা আর কাজ দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করবো। আর আজ ঢাকায় এসে এরকম একটা বড় পরিসরে কাজ করে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছি। যিনি আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন, তিনি হলেন ইউকে ভিক্তিক টেলিভিশন চ্যানেল এস এর মৌলভীবাজার অফিসে কাজ করা সাবেক কর্মী,আমাদের এক বড় ভাই রতন ভট্টাচার্য্য।যিনি প্রথমে একুশে টেলিভিশন ও পরে একাত্তর টেলিভিশনে আমাকে কাজ করার সুযোগ করে দেন।
আর মেকআপ আর্টিষ্ট পেশা সম্পর্কে বলতে গেলে বলবো, আমাদের দেশে এই মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ যেমন কম তেমনি জীবন-জীবিকার স্বার্থে মেকআপ আর্টিষ্টকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার আগ্রহটা খুবই কম। সেই জায়গায় সিলেটের জেলা শহর থেকে উঠে আসাটা আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। এই মাধ্যমে এখন পর্যন্ত সিলেট বিভাগের হয়ে একমাত্র আমিই প্রতিনিধিত্ব করছি। দ্বিতীয় কেউ আর এই মাধ্যমে নেই। কারো মধ্যে খুব একটা আগ্রহও দেখিনা। তবে এই কাজ জানলে ডিমান্ড আছে। আমাদের দেশের ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রি ছাড়াও আমাদের দেশের টেলিভিশনগুলোতে এই মাধ্যমে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
আমাদের দেশে একজন মেকআপ আর্টিষ্ট হিসেবে কাজ শেখা ও চাহিদা সম্পর্কে বলতে গিয়ে একুশে টেলিভিশনের সিনিয়র মেকআপ আর্টিষ্ট আহমেদ আলী বলেন, আমাদের দেশে মেকআপ আর্টিষ্টদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ এখনও হয়ে উঠেনি। সেই সাথে এ বিষয়ে ট্রেনিং নেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। আমাদের দেশে এ সেক্টরে মানুষ কাজ শেখে ওস্তাদের হাত ধরে। সহকারী হিসেবে কাজ করতে করতে। ৫ থেকে ১০ বছর সহকারী হিসেবে কাজ করার পর একজন মেকআপ আর্টস্ট হয়ে উঠে।
জেনারেশন টু জেনারেশন এভাবেই হয়ে আসছে। আমরাও এভাবে কাজ শিখেছি। দীর্ঘদিন ওস্তাদের এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করে করে মেকআপ আর্টিস্ট হয়েছি।
বর্তমান এই সেক্টরের চাহিদা সম্পর্কে বাংলাদেশের সিনিয়র এই মেকআপ আর্টিষ্টের মন্তব্য- বর্তমানে টিভি চ্যানেলে এই সেক্টরে কাজের সুযোগ পাওয়াটা কিন্তু এত সহজ নয়। ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় সেখানের সিনিয়র মেকআপ আর্টিষ্ট,এসিস্ট্যান্ট মেকআপআর্টিস্টসহ হালকা পাতলা কাজ জানা অনেকেই টিভি চ্যানেলে চাকুরী করার জন্য সুযোগে অপেক্ষায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেজন্য টিভি চ্যানেলে চাকুরী পাওয়াটা কঠিন। তাছাড়া সহজে কেউ চাকুুরী ছাড়তেও চায়না। যার কারণে খালি হওয়ারও সুযোগ কম।
অনেকে পেটের দায়ে এই প্রফেসনে আসছে। আবার অনেকে চ্যানেলে চাকুরী করবে সেই আগ্রহ নিয়ে আসছে।
আর মূল কথা হলো,কাজ জানা না থাকলে এখানে তো চাকুরীই হবেনা। কোন না কোন ভাবে কাজ শিখতে হবে। একদম ফ্রেস ছেলেমেয়েদের এখানে কাজের কোন সুযোগ নেই।
সিলেট থেকে উঠে আসা একমাত্র মেকআপ আর্টিষ্ট সম্পর্কে বলতে গিয়ে একুশে টেলিভিশনের সিনিয়র মেকআপ আর্টিষ্ট আহমেদ আলী বলেন, আমাদের টেলিভিশনে একজন মেকআপ আর্টিষ্টের প্রয়োজন পড়েছিল। তখন আমাদের চ্যানেলে লাইটে কাজ করা সিলেটের একজনের রিকোয়েস্টে আমাদের সিনিয়রের কাছে কাগজপত্র জমা দিয়ে বিপ্রজিতকে এসিস্ট্যান্ট মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। যার কারণে সে সহজে সুযোগ পেয়ে গেছে। বর্তমানে এই সেক্টরে কাজের সুযোগ পাওয়াটা কিন্তু এত সহজ নয়।
বিপ্রজিতের ভেতরে কাজ করা ও শেখার প্রতি অনেক অগ্রহ ছিল। সেজন্য সে এখন ভাল করছে। বর্তমানে সে যে চ্যানেলে আছে সেখানেও সে ভাল কাজ করে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সে ছেলে ভাল। তার কাজও ভাল। ভবিষ্যতে সে আরো ভাল করবে সেটাই কামনা,সেটাই প্রত্যাশা।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান