মৎস মারিব খাইবো সুখে -৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার
ভরা বর্ষাকালে যখন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরত তখন আমাদের পেছনের পুকুরটা জলে টৈ টুম্বুর হয়ে ওর সীমানা ছেড়ে আমাদের পিয়ারা গাছ অবধি চলে আসতো। বিরামহীন বৃষ্টি টিনের চালে আছড়ে পড়তো এক অপার্থিব সুরে। টিনের চালের ফুটো দিয়ে সে বৃষ্টির জল আমাদের ঘরের এখানে সেখানে চুয়ে চুয়ে পড়তো। আমরা ছোট ভাই বোন থালা, বাটি দিয়ে সে জল ধরে ফেলার খেলায় মেতে উঠতাম। চরাচর জুড়ে ব্যাঙের একটানা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দ, ঝি ঝি পোকার ঐকতান সব মিলে কেমন এক অসহনীয় ভাললাগার মধ্য দিয়ে কেটে গেছে আমার শৈশবের দিনগুলো। কতো সহজ সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো। জীবনের ছিল না কোন জটিলতা। প্রতিবেশীর আঙ্গিনার মাঝে ছিল না কোন সীমানা রেখা। আমাদের বড়ই গাছ ওদের বাড়ীর টিনের চালে টুপটাপ করে ঝরে পড়ত, ওদের বাড়ীর ঢাউস আকারের কামরাঙ্গা আমাদের আঙ্গিনায়।
এ ভরা বর্ষাকালে সবাই যখন ঘরের চার দেওয়ালের মাঝে বন্ধী, তখন সবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে আমার ছোড়দা ঘর ছেড়ে পুকুর পাড়ে মাছ ধরতে ব্যস্ত। সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে ভিজে চুপচুপা হয়ে অজস্র বরশী একটা লম্বা দড়ির সাথে বেঁধে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ঝুলিয়ে রাখতো। আমরা ভোরের আলোর প্রতীক্ষায় থাকতেম। ঘুম ভেঙ্গে দাদার সাথে প্রায় দৌড়ে যেতাম পুকুর পাড়ে। দড়িটা মাছের ভারে ডুবে থাকতো। এক একটা বরশী টেনে তুলতেই খলবল করে উঠে আসতো শিং, সোল, সাটি – কতো মাছ। আমি বরশী থেকে মাছ খুলতে খুব ভয় পেতাম বিশেষ করে শিং মাছের কাঁটার ভয়। অত্যন্ত সন্তর্পণে মাছ খুলতে যেয়ে মাঝে মধ্যে দু একটা লাফিয়ে পালিয়ে যেতো। ওরা পালিয়ে যাবার সাথে সাথে আমার কপালে নেমে আসতো চরম দুর্দশা। ছোড়দার চড় থাপ্পড় ছিল নিশ্চিত। মার খেতাম আবার ভুলে যেতাম। দাদা আমায় মারত আবার আদরে আদরে ভরিয়ে দিতো। আজ সুদূর বিদেশের জলাভূমিতে মাছ ধরতে এসে শৈশবের সেই সব স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়।
গ্র্যান্ড রিভারের জল একটা উঁচু অঞ্চল থেকে প্রবল বেগে ভেঙ্গে পড়ছে। প্রচণ্ড ঘূর্ণাবর্তের পাশে একটা অঞ্চল বেশ শান্ত। ওখানে ছিপ ফেললেই উঠে আসে শিং মাছ। এখানে দড়ি বেঁধে মাছ ধরার কোন নিয়ম নেই। একটা ছিপের সাথে একাধিক বরশী বাঁধা এখানে বেআইনি। জাল দিয়ে, হাত দিয়ে বা বর্ষতী দিয়ে মাছ মারা এখানে দণ্ডনীয় অপরাধ। কঠোর নিয়ম কানুনের সূত্র মাথায় রেখে অত্যন্ত সতর্ক ভাবে এখানে মাছ ধরতে হয়। আজ আমার ছোট সন্তান আমায় সাহায্য করতে এসেছে। বরশী থেকে একটা ক্যাটকে খুলতে যেয়ে ওর প্রচেষ্টা দেখে ওর বয়সের সাথে আমাকে এক করে ফেলি। আবারো স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। যে আমার স্মৃতির সাথে নিবির ভাবে জড়িয়ে আছে সে আজ নেই। দুঃসহ স্মৃতিরা মুহূর্তে আমায় আনমনা করে দেয়।
আমার হারিয়ে যাওয়া দুরন্ত ছোড়দা বিরাট এক দিঘির গলা জলে দাঁড়িয়ে। একটা বড়সড় মাছকে সে দাঁতে চেপে রেখেছে। পায়ের তলে আরেকটি। দাতে চাপা মাছটা আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে ডুব দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে আসে আরেকটা। আমি ওকে ধরতে যেয়ে ধরতে পারিনা। ও লাফাতে লাফাতে স্বল্প জলের মধ্যে মুহূর্তে নিঃচিহ্ন হয়ে যায়। ক্রোধান্বিত দাদাটি আমায় গালে একে দেয় পাঁচ আঙ্গুলের এক বিশাল চিহ্ন। আমি কান্না ভরা চোখ নিয়ে দাদার পিছে পিছে বাসায় ফিরে আসি। দাদা আমার কান্না ভুলাতে অনেক চেষ্টা করে যায় কিন্তু মা-বাবার কাছে শাস্তি দেবার জন্য আমি দাদার কোন প্রচেষ্টায় আগ্রহ দেখাই না। ঘরে ফিরে বাবা সেদিন দাদাকে অনেক মেরেছিল। আজ মনে পড়তে চোখ দুটো জলে ভিজে উঠে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘরে ফিরতে হবে। জলের বুকে পড়েছে বিশাল এক ছায়া । আমি সেই ছায়াকে আমার সন্তানের মনে করে ওর দিকে এগিয়ে দেই আমার গাড়ীর চাবি। ওকে বলি গাড়ীতে উঠতে। প্রতিত্তরে ছায়ামূর্তি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে – license please…
চলবে…
মৎস মারিব খাইবো সুখে -৪ | সুশীল কুমার পোদ্দার, ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী । ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স, মাস্টার্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি, ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান