দুঃখ গাঁথা:ঘুড়ি উড়াই জীবন |||| সুলতানা শিরীন সাজি
একটা কবিতা ঘুরছে জানো, চোখের নাচনে মনের কাঁপনে।
৩৯ দিন পার হয়ে গেলো,
বাতাসে ঘুরতে থাকা শব্দরা,আহত পাখির মত ডানা ঝাপটাচ্ছে অবিরত।
চোখের পলকেই চলে যাওয়া সময়গুলো,
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে সরে আসন পেতেছে ,
বুকের ভিতরে,সাদা পাতায়!
খসখস করে লিখছি ওখানেই।
সেই যে গত বছর শুরু হলো,
কলোনোস্কোপি,সিটিস্ক্যান,অঙ্কোলোজিস্ট,কিমো,ইমিউনোথেরাপী!
সতেরো বছর আগে হয়েছিল শুরুটা।
দুই দুইবার অজস্র কিমো আর রেডিয়েশন এর পর,
বেঁচে থাকার অপার্থিব আনন্দ শুরু হয়েছিল।
আমার ব্লগবাড়ির জানালায় লেখা,”বেঁচে থাকা দারুণ ব্যাপার।”
কতবার কত নাম এসে বলে গেছে,এই লাইনটাই বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের।
আমাদের বেঁচে থাকাও চলছিল এক আশ্চর্য্য ম্যাজিকে।
আনন্দ এখানে ছিল উদ্ভাসিত জোছনার মত।
কতবার হাইওয়ে ৪১৭ থেকে এক্সিট নিয়ে,
বিশাল আকাশের নীচে জোনাক ছুঁতে গেছি,
কতবার আলোকিত জোছনার কাছ থেকে মুঠো মুঠো আলো এনে বিলিয়েছি।
যেখানেই দুঃখ,কষ্টর মত অনুভব,
সেখানেই ফুল আঁকা রুমাল ভরে দিয়েছি প্রেম!
আমাদের প্রেম সাথে নিয়ে গেছি পূর্ব থেকে পশ্চিমে,
যারা সেই প্রেম ছুঁয়েছে তারাই জেনেছে,
প্রেমভাসি মানুষের কত আনন্দরাশি, কত নিঃশ্বাস রাতভর বৃষ্টিতে জেগে থাকে।
চিঠি লিখেছি কত শত! শুক্রবারের চিঠিতে কত কথাবলা ছিল।
কত নেমন্ত্রন ছিলো চুপিসারে।
সূর্যোদয়,আর সূর্যাস্ত দেখতে যাবার জন্য ড্রাইভে,
সাথে প্রিয়গান ছিল।
গাড়ির ড্যাশবোর্ডে কবিতার খাতা আর কলম ছিল !
নিজের ভালোলাগা কবিতা যতবার উচ্চারণ করেছি,অবাক তাকিয়েছো!
কতবার প্রিয় কবির আনত চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেই লজ্জায় ম্রিয়মান হয়ে গেছি।
পাছে বুঝে ফেলো এই অবাক প্রেমটুকু।
চোখ ফিরে তাকাতে,দেখে ফেলি দেখাটুকু, চোখমেলে চেয়ে আছো প্রশ্রয় ভরে।
বলেছো ,”তোমার প্রিয় কবি যেই হয় হোক, তুমি আমার প্রিয় কবি !”
একথা শুনে আমি নুয়ে পড়া ঘাসফুল হয়ে গেছি।
দিন গুনতে গুনতে মাস,
মাস গুনতে গুনতে বছর হবে পার,এমনি প্রত্যাশা ছিল!
এগারো মাসের প্রতিটা দিনের সব সেকেন্ড,মিনিট,ঘন্টাকে জড়ো করি।
প্রায় ত্রিশ কোটি সেকেন্ড ছুঁয়েছিল আমাদের ভালো হবার অপেক্ষা।
চলে যাবার আগে কত কথা বলে গেছো।
এভাবেও চলে যাওয়া যায়?
সবকিছু ফেলে নিমেষেই এপার থেকে ওপার!
এপার থেকে ওপারের দূরত্ব কত?
নিজেই বলেছিলে,কয়েক আসমান!
কত দ্রুত চলে গেলে তুমি। কোথা থেকে কোথায় চলে যায় মানুষ!
হাত ধরে বসেইতো ছিলাম,হাত ধরে বসে থাকি!
কপাল ছুই,ঠোঁট ছুই,
২৮ বছরের চেনা হৃদস্পন্দন থেমে গেলোরে সাজি!
“সাজি পানি দাও,পানি”! কেউ বলবেনা আর।
সন্তানের হাহাকার,চোখের জল সব পিছে পড়ে থাকে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মত সেই শূন্যতার গহ্বরে ডুবে যেতে থাকি!
এইতো সেদিন ছিলে!
গ্রীসের ইকারিয়া দ্বীপে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখতাম দু’জন।
সারা সকাল সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবে তুমি,
দুপুরবেলা মাথায় পাথর কুঁচি গুলের মালা জড়িয়ে,
পাহাড়ের নীচের ঢালে বসে অপেক্ষায় আমি।
দূর থেকে রবার্ট রেডফোর্ড এর মত হ্যাট পড়ে হেঁটে আসবে তুমি।
আমি মনেমনে দৌঁড়ে যাবো তোমার দিকে।
জড়িয়ে ধরবে তুমি,আর ঠোঁটের কাছে সেই সম্মোহন!
দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ৬৭ তে যায় থামবো।
আমাদের লাল বাংলোটায় আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে ৩৩টা কবুতর আর ৩টা বিড়াল।
তোমার জন্য ফীশ ফ্রাই বানাবো আর পাঁচ ফোড়ন দেয়া ডাল।
মৌ মৌ গন্ধে মাতাল হয়ে পাশের বাড়ির ফরাসী প্রতিবেশি মিঃ ক্লাউড গলা বাড়িয়ে বলবে,
quelles épices vous utilisez madame?
বলবো পাঁচ ফোঁড়ন!
হাতের আঙুল গুনে গুনে বলবো,আন,দ্যু ,থোয়া,ক্যাথ,স্যাঙ্ক!
ও গলগল করে হাসবে! আর আঙুলে গুনে বলবে, cinq épices?
এক বাটি ডাল আর মাছভাজি দিয়ে আসবো ওদের দু’জনের জন্য।
এই দ্বীপে মানুষের কোন অসুখ হয়না জানার পরই আমরা স্বপ্ন দেখতাম এখানে থাকার।
ক্যানসার যখন বন্যার বাঁধভাঙা পানির মত তোমার ভিতর দখল করে নিচ্ছে,
খুব দূর্বল অথচ ভীষণ শান্ত হয়ে উঠেছো তুমি!
বেঁচে থাকার যত অভিলাষ,যত প্রেম,যত আনন্দ আমায় দিয়ে
তুমি দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছো!
আমি আমার ভিতরে তোমাকে শুনতে পাচ্ছি।
নিজের নিঃশ্বাসটুকু তুমিময় হয়ে গেছে!
সবাই বলে একলা হয়ে গেছি,
কি করে বলি,এত প্রেম বুকে নিয়ে,
আমার কি আর একলা হওয়া চলে!
বলেছিলাম, একটা কবিতা ঘুরছে জানো,
চোখের নাচনে মনের কাঁপনে।
যতবার তোমার কাছে যাই।
কত কথা বলে আসি। কত প্রার্থনা।কত কবিতা!
তোমায় শোনাই “ঘুড়ি উড়াই জীবন”।
“কিছু অপ্রাপ্তিকে ধরে রাখি ছায়ার মত।
কে জানে কখন আবার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাই।
আর তুমি এসে বলো,আজ যাই!
জানোতো সব চলে যাওয়াতেই মৃত্যুর কষ্ট ছুঁয়ে থাকে।
মৃত্যু অনিবার্য তবু
আনন্দ শুধু বেঁচে থাকাতেই!
জানি একদিন চলে যেতে হবে।
ইচ্ছে করেনা জানো!
চলো পুরো নক্ষত্রকাল জুড়ে শুধু এলোমেলো বাঁচি!
যখন যেমন ইচ্ছেমতন,
হাতধরে বসে থাকি!
ঘুড়ি ওড়াই,
আর নাটাই এর হাতদুটোকে একটুও না ছাড়ি।
চলো শুধু চোখের ভিতর চোখের মত
অনন্তকাল ডুবে থাকি এক আশ্চর্য্য মহিমায়!
আহা, শুধু মানুষ জীবন এত ভালোবাসি!
পাখি জীবন তবে,কত ভালো হবে?”
রাতভর জেগে বসে থাকি।
লিখি নিজের ভিতরের নিজেকেই,
কষ্টকে বলতে ইচ্ছে করেনা।
এত একা লাগে! একা শব্দটা এতকাল দেখেছি,লিখেছি।
এত বেদনা এই একটা শব্দে।
এত কষ্ট!
দুঃখ গাঁথা:ঘুড়ি উড়াই জীবন |||| সুলতানা শিরীন সাজি | কবি, গল্পকার ও আবৃত্তিকার। অটোয়া