৫ম বর্ষপূর্তি

২৬ মার্চ উপলক্ষে    শ্রুতি নাটক – স্বাধীনতা ||||  সুশীল কুমার পোদ্দার

২৬ মার্চ উপলক্ষে    শ্রুতি নাটক – স্বাধীনতা ||||  সুশীল কুমার পোদ্দার

স্বামী: আজ জীবনের মধ্যাহ্ন বেলায় এসে মনকে প্রশ্ন করি – স্বাধীনতা তুমি না এলে আমি কি হতেম? হয়তো হতেম এক ফেরিওয়ালা। রঙ্গিন শাড়ীর পশরা নিয়ে ডেকে বেড়াতেম ‘ শাড়ী নেবেন গো শাড়ী, হরেক রকম শাড়ী’। আচ্ছা, তুমি কি আমার মতো একজন ফেরিওয়ালার সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে? হয়তো আমি অনেক কষ্টে একটা শাড়ী বেছে রাখতেম তোমার জন্যে। অভাবের সংসারে কষ্ট হবে বলে তুমি হয়তো ফিরেয়ে দিতে। একটা আটপৌরে শাড়ী পড়েই হয়তো চালিয়ে নিতে দারিদ্রের সংসার। আচ্ছা, স্বাধীনতা না এলে তুমি কি হতে?

স্ত্রী: কি আর হতাম। পড়ালেখা নিচ্ছয়ই হতো না। কচুরি পানার মতো ভেসে বেড়াতাম। বাবা হয়তো কোন এক মহাজনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতেন। সংসারে পান থেকে চুন খসলেই হয়তো কথা শুনতে হতো – পূর্ববঙ্গের শরণার্থী।

স্বামী: জান, আমি তখন অনেক ছোট । অথচ আমার আত্মসম্মান বোধ ছিল অত্যন্ত টনটনে। ছেলেরা দল বেঁধে আমাকে খেপাত – ‘জয় বাংলার লোক, ঢেলা ঢেলা চোখ, রিলিফের চাল খেয়ে হোল বড়লোক।’ আমি প্রতিবাদ করতেম। না পারলে মার কাছে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেম। মা বলতেন – দেখ বাবা, ওরা আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য করছে, সব কথা গায়ে মাখতে হয় না’। তবু আমি মানতে পারতেম না। দেখতো, তোমার চোখ কি ঢেলা ঢেলা?

স্ত্রী: তুমি বড্ড বেশী সংবেদনশীল। তুমি আগেও যেমন ছিলে এখনও তেমনি।

স্বামী: জান, যুদ্ধের সময় আমরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেম তার ধার ঘেঁসে মহাসড়ক। মহাসড়কটা চলে গেছে বালুর ঘাট পার হোয়ে সীমান্তের কাছে। তুমি তো সীমান্ত এলাকাতেই ছিলে। কতো ভালো হতো যদি তোমার দেখা পেতাম। শরণার্থী বলে কেউ তেমন মিশতো না। জলমগ্ন ধান ক্ষেতে কলার ভেলা নিয়ে একা একা ঘুরে বেড়াতেম। ছিল না কোন পড়াশুনা, ছিল না কোন স্বপ্ন। না, ভুল বললেম। স্বপ্ন ছিল। আমাদের পাশেই ছিল সিনেমা হল। আমার স্বপ্ন ছিল গেট কিপার হবার। দেখ, আমি গেট কিপার হলে তুমি তো বিনে পয়সায় সিনেমা দেখতে পারতে। গভীর রাতে মহাসড়ক ধরে ছুটে যেত মিলিটারি কনভয়। আমরা ভয়ে ভয়ে বেড়ার ফাঁক গলিয়ে তা দেখতে পারতেম।

স্ত্রী: আমি তখন অনেক ছোট। সব কিছু আবছা আবছা মনে হয়। মার কাছ থেকে শুনেছি আমরা ছিলেম সীমান্ত ঘেঁষা আমাদের গ্রামের বাড়ীতে। আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজন ছিল সীমান্তের ওপারে। বাবা, ওখানে বাসা বানিয়ে রেখেছিলেন। যুদ্ধের সময়টা আমরা ওখানেই ছিলেম। দাদু ছিলেন বিশাল ভূস্বামী। যতদূর চোখ যায় তার জমি। আঁধিয়ারেরা জমির ধান, পুকুরের মাছ সব দিয়ে আসতো। তাই আমাদের হয়তো তেমন কোন কষ্ট হয় নি, অথবা বুঝতে পারিনি।

স্বামী: জান, বড় বেশী অভাব ছিল আমাদের। রিলিফের চাল খেয়ে বড়লোক হওয়া আর হোয়ে ওঠেনি। প্রথম প্রথম রিলিফ দিয়ে সংসার চলে যেত। ধীরে ধীরে পরিমাণ কমে যেতে লাগলো। বাবা নিরুপায় হোয়ে বেড় হোয়ে পড়লেন। কাটা বনের হাট থেকে লাকড়ি কিনে আনতেন নৌকা ভর্তি করে। আমি সুউচ্চ লাকড়ির পাহাড়ের উপর বসে পাহারা দিতেম। সময় পেলেই পূর্ণ ভাওয়ার ছিপ ছিপ জলে ছোট ছোট মাছ ধরতেম। তুমি থাকলে বেশ মজা হতো। আচ্ছা, তোমার মনে পড়ে তোমরা কেমন করে ওপারে গেলে?

স্ত্রী: মা বলেছেন, যখন মিলিটারি এলো আমি নাকি বাড়ির উঠনে বসে মুড়ি খাচ্ছিলেম। কে কোথায় দৌড়ে পালিয়ে গেছে। আমাকে আমাদের কোন এক প্রতিবেশী কোলে করে কাকুর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমার তেমন কিছু আর মনে নেই।

স্বামী: আমার তো বেশ মনে পড়ে। বাবা আমাদের শহর থেকে বেশ দূরে এক গ্রামে রেখেছিলেন। একদিন দুপুরে আকাশে ধুয়ো দেখতে পেলেম। দূর থেকে মানুষের গগন বিদারী চিৎকার ভেসে আসছিল। এখনও মনে পড়ে – আকাশ থেকে পোড়া কাগজ ঝরে ঝরে পরছে, শুকনো মরিচের গন্ধে চোখ দিয়ে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে। আর আমরা জীবন নিয়ে ছুটছি। পড়ে জানতে পেরেছি মিলিটারি স্থানীয় দোসর দের নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার ছোট মামা সহ অসংখ্য হিন্দুকে বেছে বেছে হত্যা করেছে। আমরা কত দূর দৌড়ে পালিয়েছি তেমন মনে নেই তবে মনে পড়ে সেই বৃষ্টি মুখর নিশুথী রাতের কথা। যমুনার জল ছলাৎ ছলাৎ করে কাশবনে আছড়ে পড়ছে। অদূরে বিশাল আকার গয়না নৌকা। গন্তব্য আসামের মানকার চর। আচ্ছা, তুমি কি মুক্তিযোদ্ধা দেখেছো?

স্ত্রী: আমার মেসতো ভাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তেমন জানতেম না। উনি নিরুদ্দেস হয়েছিলেন। সবাই ভেবেছিলো উনি মারা গেছেন। আমাকে আমার বন্ধুরা বলেছিল, মুক্তিযোদ্ধারা খুব সাহসী হয়, ভীষণ উঁচা লম্বা আর স্বাস্থ্যবান হয়। যুদ্ধের পরে উনি যখন ফিরে এলেন ভীষণ রোগা। আমার ভুল ভেঙ্গে গেল।

স্বামী: আর জান, আমাদের নৌকাতেই মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমরা বুঝতে পারিনি। ওদের কাছে তো কোন অস্ত্র ছিল না। লুঙ্গি পড়া আর গেঞ্জি গায়ে মাঝিদের সাথে বসে থাকতো। আমরা যখন মানকার চরে নামলাম তখন ওরা পরিচয় দিল। জান, মানকার চরের সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। অদূরে আকাশ ছোঁয়া পাহাড় আমায় ভীষণ টানতো। নদীর পাড়ে শরণার্থী শিবির। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। আমরা ভাড়া থাকতেম আরও বেশ কয়েকটা পরিবারের সাথে। বাসাটা এক মিলিটারি মেজরের। বড়দা উনার দুমেয়েকে পড়াতেন। সেই সুবাদে ওদের সাথে এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রায় বিকেলেই ওদের সাথে চলে যেতাম পাহাড় ঘেঁষা মিলিটারি ক্যাম্পে। পাহাড়ের ঢালে নীলাভ জলে রঙ্গিন মাছ, চুড়োতে অসংখ্য শ্বেত পাথরের সমাধি সৌধের উপর আঙ্গুর লতা, কাঠ বিড়ালীর ত্রস্ত চলাচল আমায় স্বপ্ন জগতে নিয়ে যেত। তারপর একদিন আমরা আসাম থেকে রওয়ানা হলেম গঙ্গারামপুরের দিকে।

স্ত্রী: তারপর?

স্বামী: এক গরীব আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিলেম। শুরু হোল আমাদের এক নতুন জীবন। সে জীবনে ছিল না কোন আনন্দ। অভাব ছিল নিত্য সঙ্গী। ছোটদা বাজারে সব্জী বেচতেন আমি তাকে সাহায্য করতেম। মাসের শেষ দিকে আমাদের ঘরে তেমন খাবার থাকতো না। একদিন আমরা সবাই বসে আছি ছোট দা বাজার করে ফিরবে বলে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এলো। দাদার দেখা নেই। অবশেষে অনেক রাতে ফিরে এলেন খালী হাতে। কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন ‘মা সব টাকা হারিয়ে ফেলেছি।’ ঘরে চাল নেই। চাদের আলোয় দিগন্ত জোড়া মাঠ চক চক করছে। সাওতাল মেয়েরা সব ধান কেটে নিয়ে গেছে। আশে পাশে অজস্র ইঁদুরের গর্ত। আমরা ভাই বোনরা বেড় হোয়ে পরলাম যদি কিছু ইঁদুরের কাছ থেকে পাওয়া যায়। অবশেষে পেয়ে গেলাম বিশাল এক গুপ্তধন। অনেকটা ধান। সেই রাতেই ধান থেকে চাল হোল, মা রান্না করলেন বিলের কলমি শাঁক দিয়ে। খাবারে এতো স্বাদ, জীবনের এক বিরাট উপলব্ধি।

স্ত্রী: তোমরা অনেক কষ্ট পেয়েছ। আমরা যে কষ্ট পাইনি তা নয়। আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে সীমান্ত ৪/৫ মাইল দূরে বালুর ঘাঁট অঞ্চলে। আমরা যুদ্ধের প্রথম দিকে বেশ ছিলাম। দেশ স্বাধীন হবার একটু আগ থেকে আমাদের সংসারে অভাব নেমে এলো। গ্রামের বাড়ি থেকে খাবার আসা বন্ধ হোয়ে গেল। রাজাকারের ভয়ে বাবা আর গ্রামে যেতে সাহস পেলেন না। মা বলেছেন ঐ সময় নাকি আত্মীয় স্বজনও মুখ ফিরেয়ে নিয়েছিল। আচ্ছা, কষ্টের কথা বাদ দাও। এখন বিজয়ের কথা বোল।

স্বামীঃ বিজয় বুঝার মতো তেমনতো বড় ছিলেম না। তবে, একদিন এক বিশাল পরিবর্তন লক্ষ্য করলেম। মহাসড়ক ধরে মিলিটারি কনভয় গুলো ফিরে আসছে। খোলা কনভয় গুলোতে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবের ছবি। কেউ কেউ হাত তুলে বলছিল ‘জয় বাংলা হো গিয়া…।’ বাবা, একদিন মাকে বললেন ‘আর দেরী নয়, আমরা দেশে চলে যাবো।

স্ত্রী: তারপর?

স্বামীঃ একদিন এক ঘন কুয়াসা ভরা ভোঁরে অনেক জনপদ পার হোয়ে আমরা এসে পৌঁছলেম সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশনে। স্মৃতিগুলো আজ অনেক ফিকে হোয়ে গেছে। তবে মনে আছে আমাদের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বসত বাড়ির কথা। বড় ঘরটা আমাদের অপেক্ষায় একদিকে কাঁত হোয়ে পড়ে আছে। মেঝেতে এখানে সেখানে বিরাট বিরাট গর্ত। ঘর ছাড়ার আগে বাবা মা প্রায় সবকিছু মাটি গর্ত করে রেখে গিয়েছিলেন। দুর্বৃত্তরা সব খুড়ে নিয়ে গেছে। ঘরের টিন খুলে নিয়ে গেছে। আমি দৌড়ে যাই আমার পিয়ারা গাছের কাছে, বরই গাছের কাছে, কলা বাগানের কাছে, পুকুরের কাছে। কলা গাছগুলো বাতাসে দুলে ওঠে, পুকুরের জলে একটা ছোট্ট ঢেউ উঠে। আমাদের পোষা কুকুরটা কোথা থেকে দৌড়ে এসে গা ঘেঁসে দাঁড়ায়। আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নেই। সে নিঃশ্বাসে বিশ্বাস খুঁজে পাই। আবারো স্বপ্ন দেখি…। এবার তোমার কথা বলো

স্ত্রী: দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা প্রথমে গ্রামের বাড়ীতে ফিরে এসেছিলেম। চারিদিকে ধ্বংসযজ্ঞ। রাজাকাররা বাড়ি দখল করে নিয়েছিল – ওরা ভেবেছিল আমরা আর ফিরবো না। তারপর ফিরলাম শহরের বাড়ীতে। আমাদের এলাকাটা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। মনে হোল আমরা ফিরে এসেছি এক খান্ডপ্রস্তে। তবুতো ফিরে এসেছি আপন মাটিতে। তুমি ঠিক বলেছো। স্বাধীনতা আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। ভালোবাসতে শিখিয়েছে। দিয়েছে আপন পরিচয়। হে জন্মভূমি তুমি ভালো থেক

স্বামী/স্ত্রী:

  • ‘ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
  • ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
  • ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল, …।
  • ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।’

(কৃতজ্ঞতা – ডঃ হুমায়ুন আজাদ)


সুশীল কুমার পোদ্দার, ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,  ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স, ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।



সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন