ইবনে সিনার বিস্ময়কর জীবন |||| সাইফ ইমন
ইতিহাসের অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি ইবনে সিনা। তাঁর পুরো নাম আবু আলি হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাসান ইবনে আলি ইবনে সিনা। তাঁকে বলা হয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক। ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের বিজ্ঞজনরা এই মহৎপ্রাণ দার্শনিককে তাঁদের জাতীয় জ্ঞানবীর হিসেবে দাবি করেন। অসম্ভব মেধাবী এ মানুষটিকে নিয়ে আজকের রকমারি-
শিশুকাল থেকেই অনন্য মেধাবী
পুরো নাম আবু আলি ইবনে সিনা। জন্মগ্রহণ করেন আনুমানিক ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি বাস করতেন উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে লুকিয়ে ছিল অসামান্য মেধা ও প্রতিভা। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্থ করে ফেলেন। তাঁর তিনজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ইসমাইল সুফি তাঁকে শিক্ষা দিতেন ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহশাস্ত্র আর তাফসির। মাহমুদ মসসাহ শিক্ষা দিতেন গণিতশাস্ত্র এবং বিখ্যাত দার্শনিক আল না তেলি শিক্ষা দিতেন দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি, টলেমির আল মাজেস্ট, জাওয়াহির মানতিক প্রভৃতি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রভূত জ্ঞান তিনি লাভ করে ফেলেন। বিখ্যাত এ দার্শনিকের কাছে এমন কোনো জ্ঞান আর অবশিষ্ট ছিল না, যা তিনি ইবনে সিনাকে শিক্ষা দিতে পারবেন। এরপর ইবনে সিনা নিজেই এবার নিজের শিক্ষক বনে যান। এ সময় চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে তাঁর মৌলিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। এরিস্টটলের দর্শন সম্পূর্ণ ধাতস্থ করেন এ সময়েই। নতুন বই না পেয়ে আগের বইগুলোই আবার পড়তে লাগলেন। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে পড়তে আসত, তরুণ বয়সেই তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। এবার তিনি চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত কিতাব সংগ্রহ করে গবেষণা করতে শুরু করেন। ইবনে সিনা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, এমন বহু দিন-রাত অতিবাহিত হয়েছে যার মধ্যে তিনি ক্ষণিকের জন্যও ঘুমাননি। কেবল জ্ঞান সাধনার মধ্যেই ছিল তাঁর মনোনিবেশ। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তিনি গবেষণা করতেন। ক্লান্তিতে যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো স্বপ্নের ন্যায় তাঁর মনের মধ্যে চলে আসত। জ্ঞানের দরজা যেন খুলে যেত। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠেই সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে যেতেন। এ সময় বোখারার বাদশাহ নুহ বিন মনসুর এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। সব চিকিৎসক এ চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়। ততদিনে সিনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। ইবনে সিনা বাদশাহকে সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলেন। তাঁর খ্যাতি এ সময় দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আরোগ্য লাভের পর বাদশাহ ইবনে সিনাকে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেন। এ সময় সিনা চাইলে বিপুল সম্পদ ও উচ্চপদ লাভ করতে পারতেন। কিন্তু ইবনে সিনা কেবল বাদশাহর দরবারের গ্রন্থাগারে প্রবেশ করে পড়াশোনার অনুমতি প্রার্থনা করেন। বাদশাহ তাঁর এ প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এভাবেই ইবনে সিনা শাহী গ্রন্থাগারে প্রবেশের সুযোগ পান। গ্রন্থাগারের ভিতরে গিয়ে অবাক হয়েছিলেন সিনা। কারণ এমন সব বইয়ের সন্ধান তিনি সেখানে পেয়েছিলেন যেগুলো এর আগে কোনো দিনও দেখেননি এবং এরপরেও কখনো দেখেননি। প্রাচীন থেকে শুরু করে সব লেখকের বইয়ের অমূল্য ভা-ার ছিল এ গ্রন্থাগার। সব লেখকের নাম তাদের রচনাসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা তৈরির পর তিনি সেগুলো অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। তিনি এ গ্রন্থাগারে এমনই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন যে, নাওয়া-খাওয়ার কথা তাঁর মনেই থাকত না। মজার বিষয় হলো, মাত্র অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ইবনে সিনা অসীম ধৈর্য ও একাগ্রতার সঙ্গে কুতুবখানার সব কিতাব মুখস্থ করে ফেলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোনো বিষয় ছিল না যা তিনি জানতেন না।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, কাব্য, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন। ২১ বছর বয়সে ‘আল মজমুয়া’ নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন। শুধু গণিতশাস্ত্র ছাড়া প্রায় সব বিষয় লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে ইবনে সিনা খাওয়ারিজমে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এ সময় খাওয়ারিজমের বাদশাহ ছিলেন মামুন বিন মাহমুদ। সেখানে তিনি পন্ডিত আল বেরুনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। স্বাধীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন সিনা। ১০০৪ থেকে ১০১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি খাওয়ারিজমে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করন। ইবনে সিনার সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে গজনির সুলতান মাহমুদ তাঁকে পেতে চাইলেন। তাদের দেশ-বিদেশ থেকে ডেকে এনে তিনি তার শাহী দরবারের গৌরব বৃদ্ধি করতেন এবং তাদের মণি-মুক্তা উপহার দিতেন। এ উদ্দেশ্যে সুলতান মাহমুদ তার প্রধান শিল্পী আবু নসরের মাধ্যমে ইবনে সিনার ৪০টি প্রতিকৃতি তৈরি করে আসল সিনাকে খুঁজে বের করার জন্য দেশে-বিদেশে সুলতান মাহমুদ লোক পাঠিয়ে দিলেন। এ ছাড়া তিনি খাওয়ারিজমের বাদশাহ মামুন বিন মাহমুদকে পরোক্ষভাবে এ নির্দেশ দিয়ে একটি পত্র পাঠালেন যে, তিনি যেন তার দরবারের জ্ঞানী ব্যক্তিদের সুলতান মাহমুদের দরবারে পাঠিয়ে দেন। আসলে অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের সঙ্গে ইবনে সিনাকে পাওয়াই ছিল তার আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু ইবনে সিনা পালিয়ে চলে যান ইরানের দিকে হামাদান শহরে। হামাদানের সুলতান অসুস্থ হলে ইবনে সিনা তার চিকিৎসা করেন। এতে সম্রাট আরোগ্য লাভ করেন। এ চিকিৎসায় খুশি হয়ে সম্রাট তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি বরাবরের মতোই ছিলেন অপরিপক্ব। তাই এ পদপ্রাপ্তি তাঁর জীবনে নতুন বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। তাছাড়া হামাদানের সেনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিদেশি ইবনে সিনাকে সহ্য করতে পারছিলেন না। তাদের সঙ্গে ইবনে সিনার বিরোধ হয়। সেনাধ্যক্ষ সিনাকে গ্রেফতার করার জন্য সম্রাটের কাছে আবেদন জানাতে থাকেন। সৈন্যবাহিনীর প্রধানের অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য সম্রাটের ছিল না। তাই তিনি ইবনে সিনাকে নির্বাসন দ- দিয়ে অন্য এক স্থানে কারাবন্দী করে রাখেন। হামাদানে বসেই ইবনে সিনা গ্রন্থ কিতাব আল ইশারাৎ রচনা করেন।
প্রতিভাধর পরিব্রাজক
ইবনে সিনা অনেক দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিও ছিল সমৃদ্ধ। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী খোয়ারিজমে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে পন্ডিত আল বেরুনির সাক্ষাৎ হয়। আল বেরুনির উৎসাহ ছিল ভারতবর্ষ নিয়ে। কিন্তু ইবনে সিনা কখনো ভারত অভিমুখে আসেননি। তিনি যাত্রা করেছিলেন ভারতবর্ষের উল্টোদিকে অর্থাৎ পশ্চিমদিকে। তাঁর মূল উৎসাহও ছিল পশ্চিমের দিকে।
এদিকে ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইবনে সিনার চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত বইগুলো প্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য জগতে স্থায়ী অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিল। খোয়ারিজম শহর থেকে বিদায় নিয়ে তিনি রাজধানী শহর গুরুগঞ্জে উপস্থিত হন। এ শহরে ইবনে সিনা তাঁর জীবনের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন। বলে রাখা দরকার যে, এখানে অবস্থানকালেই চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে তাঁর অমর গ্রন্থ কানুন ফিত-থিব রচনা করেন। তাই এ সফর ইবনে সিনার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর তিনি যান পূর্ব পারস্যের অন্তর্গত খোরাসান শহরে।
এ সময় সুলতান মাহমুদ ইবনে সিনার গুণের কথা শুনতে পেয়ে তাঁকে তার দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিকে দিকে দূত প্রেরণ করেন। নিজ দরবার নয়, সুলতান মাহমুদের ইচ্ছা ছিল তার জামাতা খোয়ারিজম অধিপতির দরবারকে তিনি জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের দ্বারা সুশোভিত করবেন। ইবনে সিনাকে তিনি চেয়েছিলেন সভাসদ হিসেবে। কিন্তু কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় সুলতানের সঙ্গে ইবনে সিনার। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। সিনা জর্জন নামক স্থানে পালিয়ে যান। সুলতান মাহমুদ এ খবর জানতে পেরে জর্জনের অধিপতিকে ফরমান পাঠান যেন ইবনে সিনাকে হস্তান্তর করা হয়। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে ইবনে সিনা এবার জর্জন থেকে পালিয়ে আবার নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। এবার তাঁর যাত্রার দিক ছিল ইরান বরাবর।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক
বিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞান। আর এ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইবনে সিনা সারা বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর লেখা চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থ আল কানুন ফিত-থিবকে অনেককাল ইউরোপে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতো। মানবদেহের অঙ্গ সংস্থান ও শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে তিনি যেসব তথ্য প্রদান করেছিলেন সেগুলো সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশের চিকিৎসকরা অনুসরণ করেছিলেন। বলা যায়, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের তিনিই জনক।
ইবনে সিনা পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় শতাধিক কিতাব রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে আল কানুন, আশ শেফা, আরযুযা ফিত-থিব, লিসানুল আরব, আল মজনু, আল মুবাদাউন মায়াদা, আল মুখতাসারুল আওসাত, আল আরসাদুল কলিয়া উল্লেখযোগ্য। এসবের মধ্যে আল কানুন কিতাবটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। এ গ্রন্থ চিকিৎসাশাস্ত্রের মূল অপতিদ্বন্দ্বী পাঠ্যপুস্তক হিসেবে গণ্য ছিল প্রায় পাঁচ শতক ধরে। আল কানুন কিতাবটি ল্যাটিন, ইংরেজি, হিব্র“ প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয় এবং তৎকালীন ইউরোপের চিকিৎসা বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আল কানুন পাঁচটি বিশাল খন্ডে বিভক্ত, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা চার লক্ষাধিক। কিতাবটিতে শতাধিক জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ, পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। ইবনে সিনা ফার্মাকোলজি ও ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের উন্নয়ন করেন। তবে তাঁর মূল অবদান ছিল চিকিৎসাশাস্ত্রে। তিনি হলিস্টিক মেডিসিনের প্রণেতা। যেখানে একই সঙ্গে শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক যোগসূত্রকে বিবেচনায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তিনি মানুষের চোখের সঠিক এনাটমি বর্ণনা করেন। তিনি বলে যান যক্ষ্মা একটি ছোঁয়াচে রোগ। যা আরও পরে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।
ইরান ও শেষ জীবন
সারা দিন চিকিৎসা পেশার পর রাতে তিনি অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। গম্ভীর মূর্তিতে বসে থাকা তাঁর স্বভাবে ছিল না। ইবনে সিনা ছিলেন একজন জ্ঞানপিপাসু এবং জ্ঞানচর্চাই ছিল তাঁর মুখ্য কাজ
খোরাসান শহর থেকে ইরানে যাওয়ার পথে ইবনে সিনা তাঁর সমসাময়িক কবি ফেরদৌসীর জন্মস্থান বিখ্যাত তুস নগরী পরিদর্শন করেন। এখান থেকে তিনি ইরানের সুপ্রাচীন শহর হামাদানে গমন করেন। ঐশ্বর্যশালী এবং ঐতিহাসিক নগরী ছিল শহর হামাদান।
তাই ভালো লেগে গিয়েছিল ইবনে সিনার। তিনি এই শহরে অনেক দিন ছিলেন। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এদিকে তাঁর বয়সও হয়েছিল অনেক। তাই তিনি মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি খুঁজছিলেন। আর এই হামাদান শহরই ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। তিনি এই শহরেই প্রশান্তি খুঁজে পান। এখানে তিনি ধীর-স্থির মনে চিন্তা করার সময় ও সুযোগ পান। হামাদানের সম্রাটও ইবনে সিনাকে সমাদরে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর থাকা-খাওয়া ও নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি তখন চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে স্বাধীন জীবিকা উপার্জন করতেন।
কথিত আছে চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণার পাশাপাশি তিনি ধ্যান করতেন অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের মৌলিক বিষয়ে। এখানেই তিনি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ কিতাব আল শিফা রচনা করেন। সারা দিন চিকিৎসা পেশার পর রাতে তিনি অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। গম্ভীর মূর্তিতে বসে থাকা তাঁর স্বভাবে ছিল না। ইবনে সিনা ছিলেন একজন জ্ঞানপিপাসু এবং জ্ঞানচর্চাই ছিল তাঁর মুখ্য কাজ। একবার ইস্পাহান শহরে অবস্থানকালে তৎকালীন সম্রাট হামাদানের বিরুদ্ধে অভিযান প্রস্তুত করেন।
এ সময় সম্রাট ইবনে সিনাকে সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। চিকিৎসাসেবা প্রদানের কারণেই তাঁকে নেওয়ার ব্যাপারে সম্রাট মনস্থির করেন। নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সম্রাটের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করেতে পারেননি। ইস্পাহানের সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে হামাদানের পথে রওনা করেন। হামাদানের সঙ্গে সিনার অনেক স্মৃতিজড়িত ছিল। আর এখানে এসেই তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর এই অসুখ আর সারেনি। হামাদানের যুদ্ধশিবিরে অবস্থানকালে ইবনে সিনা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
অসামান্য মেধাবী একজন
মাত্র ১০ বছর বয়সেই শিশু ইবনে সিনা পবিত্র কোরআন শরিফ মুখস্থ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইবনে সিনা লাইব্রেরিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে রীতিমতো অধ্যয়ন শুরু করলেন এবং লাইব্রেরির সব বই মুখস্থ করে ফেললেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিত, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কাব্য ও সাহিত্য বিষয়ে অসামান্য পান্ডিত্য অর্জন করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি আল মজমুয়া নামে একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন। এতে তিনি গণিত ছাড়া সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেন। ইবনে সিনা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘যে কোনো সমস্যার সমাধান ওস্তাদ যেরূপ করতেন আমি তাঁর চেয়ে ভালোভাবে করতে পারতাম। তাঁর কাছে জাওয়াহির মানতিক বা তর্কশাস্ত্রের খনি নামক বইটি পড়ে মুখস্থ করার পর বুঝলাম, আমাকে শেখানোর মতো কিছু নতুন আর তাঁর কাছে নেই। তখন বইগুলো আর একবার পড়তে শুরু করলাম। ফলে সব বিষয়ে আমি বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠলাম। ইউক্লিডের জ্যামিতির প্রথম কয়েকটি সম্পাদ্যের সমাধানে ওস্তাদের সাহায্য নিয়ে বাকিগুলোর সমাধান আমি নিজেই করলাম। টলেমির ১৩ খন্ডের আল মাজেস্ট বইটি শুরু করে সমস্যার সম্মুখীন হলে ওস্তাদ বললেন, তুমি নিজে সমাধান করতে চেষ্টা কর, যা ফল দাঁড়ায় এনে আমাকে দেখাও। আমি বিচার করে রায় দেব। একে একে সব সমস্যার সমাধান করে ওস্তাদের সম্মুখে হাজির করলাম। তিনি দেখেশুনে বললেন, ঠিক হয়েছে, সবকটিই নির্ভুল সমাধান হয়েছে। আমি বেশ বুঝতে পারলাম, এ ব্যাপারে ওস্তাদ আমার কাছ থেকে কিছু নতুন তথ্য শিখে নিলেন।’
ছিলেন রাজচিকিৎসক
সুলতান মাহমুদ এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বহু নামকরা চিকিৎসক আসেন তাকে চিকিৎসা করতে। সবাই যখন তার রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন তখন তরুণ ইবনে সিনা স্বেচ্ছায় রাজদরবারে গিয়ে রাজার চিকিৎসার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। সহসাই তিনি অনুমতি পেলেন। ইবনে সিনার চিকিৎসা-গুণে অতি অল্প দিনের মধ্যে সুলতান আরোগ্য লাভ করেন। সুলতানও তাঁর প্রতি খুশি হলেন এবং চাইলেন তাঁকে পুরস্কৃত করতে। এ সময় ইবনে সিনা সুলতানের প্রিয় এক বিরাট গ্রন্থাগারে এসে পড়াশোনা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। বরং সুলতান তাঁর ওপর সমগ্র গ্রন্থাগারের ভার অর্পণ করেন। হঠাৎ এক দিন এই গ্রন্থাগারে আগুন লেগে সব বই নষ্ট হয়ে যায়। ইবনে সিনার বিরোধীরা সুলতানের কাছে প্রকাশ করলেন এটি ইবনে সিনার কাজ। তাদের অনেকেই ইবনে সিনার ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলেন। বললেন, ইবনে সিনা বইগুলো কণ্ঠস্থ করে নিয়ে ইচ্ছা করেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। বোকা সুলতান এমন অদ্ভুত কথায় বিশ্বাস করলেন এবং ইবনে সিনাকে বিতাড়িত করলেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজারা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহশীল হয়ে উঠেছিলেন। আর এসব রাজ্যের রাজারা চাইতেন রাজসভায় বড় বড় পন্ডিত রাখতে। ইবনে সিনার তেমন অসুবিধা হলো না। তিনি বোখারা পরিত্যাগ করে খোয়ারিজমে গেলে সেখানকার সুলতান তাঁকে রাজচিকিৎসক নিয়োগ করেন। খোয়ারিজমের রাজসভায় বহু নামিদামি ব্যক্তি ছিলেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আল বেরুনি যিনি সুলতান মাহমুদের সঙ্গে ভারতবর্ষে এসেছিলেন এবং তৎকালীন ভারতের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এক দিন সুলতান মাহমুদের কর্ণগোচর হয় ইবনে সিনা, আল বেরুনি প্রভৃতি পন্ডিতের পান্ডিত্যের খ্যাতি। তিনি খোয়ারিজমের সুলতানের কাছে নিজ সভায় ইবনে সিনাকে প্রেরণের জন্য দাবি করেন। তাই প্রতাপশালী সুলতান মাহমুদের দাবিকে উপেক্ষা করতে পারলেন না খোয়ারিজমের শাসক। তিনি পন্ডিতদের সেখানে প্রেরণ করেন। কিন্তু ইবনে সিনা স্বাধীনচেতা ছিলেন। তাই সুকৌশলে নিজেকে মুক্ত করে পালিয়ে যান সেখান থেকে।
এস এস/সিএ