ফিচার্ড মত-মতান্তর

“মাতৃভাষায় যার ভক্তি নাই সে মানুষ নহে”

বাংলাদেশের-ভবিষ্যৎ-কি

“মাতৃভাষায় যার ভক্তি নাই সে মানুষ নহে”

শিতাংশু গুহ, ফেব্রুয়ারি ২০২৪, নিউইয়র্ক।। মীর মশারারফ হোসেন বলেছিলেন, মাতৃভাষায় যার ভক্তি নাই সে মানুষ নহে’। বাঙালির মাতৃভাষা ‘বাংলা’, পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী মুসলমান উর্দূতে কথা বলে, মাত্র ক’দিন আগে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘ইনশাল্লাহ, পশ্চিমবঙ্গে নিকট ভবিষ্যতে ৫০%মানুষ উর্দূতে কথা বলবে’। মেয়র বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে ৫০% মুসলমান হবে, তারা তো ঊর্দুতেই কথা বলেন। বাংলাদেশে বিরাট সংখ্যক মানুষ ‘আরবী’ পছন্দ করেন। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই) ব্যবহারের মাধ্যমে মীর মশারারফ হোসেনকে ‘জিন্দা’ করে কি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, তিনি এদের কি বলবেন?

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের সাথে বাংলাদেশের মুসলমানের বিস্তর ফারাক। বাংলাদেশের মুসলমান বাংলায় কথা বলে, উর্দুতে নয়। তবে অধুনা আরবী-র ব্যবহার দৃষ্টিকটূভাবে বেড়েছে। ভাষার কোন ধর্ম হয়না। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, এখনো তাঁরা এন্টি-বঙ্গবন্ধু, এন্টি-শেখ হাসিনা। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে তারা কলকাতায় বিশাল মিছিল করেছিলো। বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমান যদি কলকাতা বেড়াতে যান, যদি হোটেলে না ওঠেন, তবে তিনি হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে ওঠেন। বাংলাদেশের মুসলমানের কলকাতায় হিন্দু বন্ধু আছে, থাকাটা স্বাভাবিক, মুসলমান বন্ধু খুব একটা নেই? হুজুরদের কথা আমার জানা নাই?

কলকাতার ওপর তলার হিন্দুরা বাংলাদেশ গেলে যদি হোটেলে না থাকেন, তবে মুসলমানের বাড়িতে ওঠেন। সাধারণ হিন্দুরা তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে উঠতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এসব কথা বলার অর্থ হচ্ছে, ধর্ম ভিন্ন হলেও ভাষা ও সাংস্কৃতিক মিল এর অন্যতম কারণ। আমি প্রায়শ: বলি, ‘মুসলমান-মুসলমান’ বা ‘হিন্দু-হিন্দু’ ভাই-ভাই, একথা সত্য নয়। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান বাংলাদেশের মুসলমানের ভাই নয়, আরবের মুসলমান বাংলাদেশের মুসলমানের ভাই নয়, অথবা কাশ্মীরের হিন্দু বাংলাদেশের হিন্দুর ভাই নয়? অর্থাৎ ধর্মীয় মিলের চেয়ে ভাষা ও সংস্কৃতি’র মিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য।

ক’দিন আগে ফেইসবুকে এক মোল্লা লিখেন যে, কবি নজরুলের বউ প্রমীলাদেবী হিন্দু, এটি ষড়যন্ত্র। প্রমীলা দেবী নজরুলের কবিতা চুরি করে রবীন্দ্রনাথকে দিতেন, তাই দিয়ে কবিগুরু সাহিত্যে ‘নোবেল’ প্রাইজ পেয়েছেন। এগুলো হলো চটুল সাম্প্রদায়িকতা। রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পান (১৯১৩), তখন নজরুলের বয়স ছিলো ১৪। এরাই কিন্তু মরার পর নজরুলকে মুসলমান বানিয়ে ফেলেছেন। জীবদ্দশায় নজরুলকে এরাই ‘কাফের’ উপাধি দিয়েছিলো। আমরা আসলে এমন এক দেশের মানুষ, যেখানে পীর অসুস্থ হলে ইউরোপ, আমেরিকা অথবা সিঙ্গাপুর যায়, আর মুরিদ অসুস্থ হলে পীরের কাছে যায় তাবিজ বা পানিপড়া আনতে।

বাংলাদেশ ভাষাভিত্তিক দেশ বলে অনেকে বাহবা নিতে চান। এ কথাটিও সত্য নয়? বাংলাদেশে ভাষার উন্নতি কতটা হচ্ছে তা বোঝা মুশকিল, কিন্তু ধর্মের ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে বটে! বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো ৬-দফার ভিত্তিতে, এটি ছিলো অর্থনৈতিক দফা, ভাষার কোন কথা সেখানে নেই। এটি ঠিক ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে ৬দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশ ভাষাভিত্তিক দেশ হলে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণীয়-বরণীয় থাকতেন। তিনি কোথাও নেই, কিছু ব্যক্তি হঠাৎ হঠাৎ তাকে স্মরণ করে বটে? বাংলাদেশের ভাষা এখন বাংলা নয়, ‘আলহামুলিল্লাহ’। বাংলাদেশে এখন বাঙ্গালীর সংখ্যা কমে গেছে, অনেকেই ‘বাঙ্গালী মুসলমান’।

বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখনো মনে করে বাংলা হিন্দুদের ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান হয়তো এ কারণেই ‘উর্দু’ বলে, অথবা একই কারণে বাংলাদেশে আরবীর কদর বাড়ছে? না. আরবীর কদর বাড়ার ধর্মীয় কারণও আছে। যতই বলেন না কেন ভাষার কোন ধর্ম হয়না, হয়? ভাষা দিয়ে কোন জাতি গঠিত হয়না, তাহলে ইংরেজি ভাষা দিয়ে আমেরিকা-ইংল্যান্ডের সবাই ইংরেজ হয়ে যেতো, তা হয়নি। তাই বাংলাদেশের বাঙ্গালী মুসলমান এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী হিন্দু সবাই বাঙ্গালী নন, বাঙ্গালী হবার প্রধান শর্তই হচ্ছে, বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে ধারণ করতে হবে? ইউনিস্কো স্বীকৃত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ না মানলে আপনি বাঙ্গালী হ’ন কিভাবে? বাংলা ভাষা বঙ্গ সংস্কৃতি’র ধারক-বাহক, এ ভাষার প্রতি আপনার ভালবাসা না থাকলে আপনি বাঙ্গালী নন!

মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা। ‘বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা’? যতই বাংলা ছেড়ে উর্দু বা আরবি’ ভালোবাসুন না কেন, মাইকেল মধুসূদনের মত ফিরে আসতে হবে বটে। ‘আবার আসিব ফিরে এই বাংলার —-’। নজরুলের উর্দু বা আরবি প্রীতি ছিলো বলে শোনা যায়না, সৈয়দ মুজতবা আলী মনেপ্রাণে বাঙ্গালী ছিলেন। বাংলাদেশের মুসলমানের আরবি’র প্রতি ভীমরতি বা কলকাতার মুসলমানের উর্দূ প্রীতি কবে যাবে কেজানে? [email protected];

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন