মুক্তিযুদ্ধে পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারির হামলা!
শিব্বীর আহমেদঃ ৭ মার্চ ১৯৭১। রমনার রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে উঠার ঠিক সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন জালাল আহমেদ এমএলএ এমসিএ, আবদুল আউয়াল এমএলএ এমসিএ, আওয়ামী লীগ নেতা আনু মিয়া মজুমদার সহ লাকসামের আরো অনেক নেতা কর্মীবৃন্দ। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত রমনার রেসকোর্স ময়দান। আসন্ন যুদ্ধের উন্মাদনা আর দেশ স্বাধীন করার নেশায় উন্মুখ হয়ে আছে সবাই। সভা শুরু হয়েছে। বক্তৃতা স্লোগান চলছে। বঙ্গবন্ধু যেকোন সময় সভায় এসে পৌঁছাবেন। সবার অপেক্ষা শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্য। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বঙ্গবন্ধু নির্দেশনা দিবেন আজ।
কিছুক্ষণ পর সাদা গাড়িতে চড়ে সভাস্থলে এসে হাজির হলেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় সভামঞ্চে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করলেন লাকসাম আওয়ামী লীগ নেতা এবং সংসদ সদস্য জালাল আহমেদ এমএলএ এমসিএ। সভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি জাতিকে দিক নির্দেশনা দিলেন, ‘… ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই শক্রর মোকাবেলা করো। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ সভাশেষে তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে বৈঠক করলেন। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সবাইকে সর্বাতœক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে বললেন, ‘দেশ স্বাধীন করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার জন্য প্রস্তুতি নাও।’
ইতিমধ্যেই লাকসামে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা এমএলএ আবদুল আউয়াল এবং এমএলএ জালাল আহমেদ এর তত্ত্বাবধানে লাকসামের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধের ট্রেনিং চলছে ফেব্রুয়ারি থেকেই। বাগমারা, লালমাই, দারোগা বাড়ি, আজগরা, পাঁচপুকুরিয়া, মুদাফ্ফর গঞ্জ সহ বিভিন্ন স্থানে বাঁশের লাঠি, দা কুড়াল যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং ট্রেনিং চলছিল। ধীরে ধীরে এর সাথে যুক্ত হতে থাকল অস্ত্র আর গোলাবারুদ। সাতই মার্চের ভাষণের পর সেই ট্রেনিং আরো জোরালো হয়ে উঠল। গ্রামে গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল গ্রামের যুবক-যুবতি থেকে শুরু বয়স্কজনেরা। বাদ যায়নি জালাল আহমেদ এর গ্রাম পাঁচপুকুরিয়া।
২৫শে মার্চের কাল রাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট এবং অপারেশন বিগবার্ড শুরু হবার সাথে সাথেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ওয়ারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় বাঙালির মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রাম, স্বাধীনতার যুদ্ধ। ২৬ মার্চ থেকেই পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান থেকে লাকসামের বিভিন্ন অঞ্চলে গোলা শেল ফেলা শুরু হয়। এতে লাকসামের বহু মানুষ হতাহত হয়।
পাঁচপুকুরিয়া গ্রামের আশেপাশেও পাকিস্তানি বিমান থেকে দফায় দফায় শেল এবং গোলা-বারুদ বর্ষণ করা হয়। ভৌগলিক দৃষ্টিকোন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য লাকসাম অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। বিশেষ করে লাকসাম জংশন এবং জংশনে কর্মচারিদের বেশির ভাগই পশ্চিম পাকিস্তানি ছিল। ফলে এপ্রিলের প্রথম দিকে পাকিস্তান বাহিনী লাকসাম দখলের পরিকল্পনা নেয়। এই পরিকল্পনার ফলে লাকসামের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর গোলা বর্ষণ বেড়ে যায়। আর এরই ফলশ্রুতিতে সংঘটিত হয় আজগরা গণহত্যা।
১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে লাকসামের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। মুক্তিযুদ্ধে লাকসামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সহ স্বাধীনতাকামী স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষক ও পলাতক সৈনিকরা সক্রিয় অংশ গ্রহন করেন। আবদুল আউয়াল, জালাল আহমেদ, আনু মিয়া মজুমদার, আলতাফ আলি সহ লাকসাম আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধাদের সু-সংগঠিত করা এবং সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য লাকসাম অঞ্চলকে ৪টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। ১নং, ২নং, ৩নং, ৪নং সেক্টর ছিল যৌথ কমান্ডের অধিন। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ চার দিকের যেকোন দু’দিকের ত্রিভূজ সীমা নিয়ে গঠিত ৪টি জোনের কমান্ডের সাথে একাধিক প্লাটুন গেরিলা যুদ্ধে অংশ গ্রহন করে।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে লাকসামের ১৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লা এয়ারপোর্টে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তাঁরা বিমানযোগে ঢাকা থেকে আগত পাকসেনাদের প্রতিরোধ ও বিমানবন্দর ধ্বংস করে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে মুক্তিসেনারা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি। কুমিল্লা এয়ারপোর্ট প্রতিরোধযুদ্ধ-এ দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এরপর থেকেই লালমাই, বাগমারা আলিশ^র বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। প্রাথমিক ভাবে এই যুদ্ধ চলে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। পনের এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী লাকসাম দখল করে নেয় এবং থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরিকে হেডকোয়ার্টার হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করে।
পাকিস্তানি মিলিটারি কর্তৃক লাকসাম দখলের খবর বিদ্যুতের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে লাকসামের এমপি আবদুল আউয়াল, জালাল আহমেদ, আনু মজুমদার, আলতাফ আলীসহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। সন্ধ্যাবেলায় এমপি জালাল তাঁর নিজের গ্রাম পাঁচপুকুরিয়ায় পৌঁছেন। ইতিমধ্যেই পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক লাকসাম দখলের খবর গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিল। সবাই পাঁচপুকুরিয়ার সাহেব বাড়িতে এমপি জালালের জন্য অপেক্ষা করছিল। এমপি জালাল বাড়িতে পৌঁছতেই সবার সাথে বৈঠকে বসলেন।
বৈঠকে জালাল আহমেদ বললেন, ‘পাকিস্তানি আর্মি লাকসাম দখল করে নিয়েছে। তারা চারিদিকে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। মানুষকে বিশেষ করে মহিলা ও নারীদেরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষ দিশেহারা হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে জান নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আপনারা সবাই নিরাপদ স্থানে চলে যান। বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদেরকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দিতে হবে এখনই। আমাকে এবং আমার সঙ্গীদেরকে পাকিস্তানিরা হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করেছে। আমি আর আমার সঙ্গীরা আজ রাতেই ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাব। সেখানে যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং আর অস্ত্র সংগ্রহ করে আপনাদের জন্য পাঠাবো। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ফিরব না। যুদ্ধ ময়দান থেকে যদি বেঁচে ফিরে আসতে পারি তাহলে আপনাদের সাথে আবার দেখা হবে। আপনারা যেকোনো মূল্যে গ্রামকে রক্ষা করবেন। গ্রামের মানুষদেরকে রক্ষা করবেন। তপুর (তোফায়েল আহমেদ) মাধ্যমে আমি আমার যাবতীয় খবরাখবর আপনাদেরকে জানাবো। জয় আমাদের হবেই। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সবার সহায়ক হবেন। জয় বাংলা।’
পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক লাকসাম দখল করার পর পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেটে পরিনত হয় লাকসামের তৎকালীন দুই আওয়ামী লীগ নেতা ও বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী আবদুল আউয়াল এমএলএ এমসিএ এবং জালাল আহমেদ এমএলএ এমসিএ। পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে জালাল আহমেদ এর স্ত্রী পুত্র-কন্যা সহ নয় সন্তান এবং দশম সন্তান স্ত্রীর গর্ভে তখন। এমতাবস্থায় দেশকে শক্রু মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গোলা-বারুদ, অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সবার পরামর্শে কুমিল্লা দিয়ে ভারতের আগরতলা চলে যান। স্ত্রীর গর্ভের সন্তান সহ দশ সন্তানকে রেখেই ভারতের পূর্ণিয়া জেলার চাকুলিয়া বিমানবন্দরে সামরিক ট্রেনিং শুরু করেন। সামরিক ট্রেনিং গ্রহণ করে ২ নং সেক্টরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে জড়িয়ে পড়েন।
এছাড়াও তিনি এলাকা থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেণিং এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন বলে জানায় মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম চৌধুরী এবং পিস্তল বশর খ্যাত মুক্তিযোদ্ধা আবুল বশর। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে তিনি লাকসামের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতেন যুদ্ধের জন্য। ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আসত পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে তোফায়েল আহেমদ এর কাছে। তোফায়েল আহমেদ মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন গ্রামে। তারপর তাঁরা অপারেশনে চলে যেত।
এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী এলাকায় জালাল আহমেদ, আবদুল আউয়াল সহ অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের না পেয়ে নির্যাতন জুলুম শুরু করে। দফায় দফায় পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে এসে জালাল আহমেদ এর খোঁজ করতে থাকে পাকিস্তানি মিলিটারি। ১৯৭১ সালের জুন জুলাই এর কোন একদিন পাকিস্তানি মিলিটারি আবারো পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে এসে হাজির হয়। গ্রামে জালাল আহমেদকে খুঁজে না পেয়ে গ্রেনেড দিয়ে জালাল আহমেদ এর বাড়িঘর উড়িয়ে দেয়। জানালেন জালাল আহমেদ এর বাড়ির আবদুল খালেক। পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারির উপস্থিতি নিজ চোখে দেখেছেন তিনি। একই কথা বললেন, বিএসসি মোজহারুল ইসলাম ফারুক, যিনি ফারুক বিএসসি নামেই অধিক পরিচিত। সঠিক দিনক্ষণ না বলতে পারলেও এই দুজন বলেন, ‘পাকিস্তানিরা পাগল কুত্তার মত এমপি সাহেবকে খুঁজতে থাকে। দফায় দফায় ঘাগৈর খালের নৌপথে এবং হাঁটা পথে আর্তকিতে এসে উপস্থিত হত গ্রামে। মিলিটারির উপস্থিতিতে আতংক ছড়িয়ে পড়ত চারিদিকে। ভয়ে মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে যেত।’
‘বর্ষাকাল। জুন-জুলাই মাসের এক দুপুরে এমপি সাহেবের সন্ধানে পাকিস্তানি মিলিটারি গ্রামে এসে হাজির হয়। সারাগ্রাম তল্লাশী চালায়। কিন্তু সাহেবকে না পেয়ে সাহেব বাড়ি গ্রেনেড দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এতে সাহেব বাড়ির বিল্ডিং ধ্বংস হয়ে যায়। ঘরের টিন উড়ে যায় প্রায় আধা মাইল দূরে।’- বললেন, আবদুল খালেক। ‘পরে সেই ঘরের টিন কুড়িয়ে এনে তপু চেয়ারম্যানের বাড়ির উঠোনে মাচাং এর মত করে ঘর বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বিভিন্ন জায়গা থেকে রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধারা এই গ্রামে আসত। গ্রামের মানুষ তাদের থাকা-খাওয়া ব্যবস্থা করত। তারপর আবার মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারেই চলে যেতে পরবর্তী গন্তব্যে বা অপারেশনে।’
১১ ডিসেম্বর লাকসাম মুক্ত হবার পর গ্রামে ফিরে আসেন জালাল আহমেদ এমএলএ এমসিএ। গায়ে খাকি পোষাক, পায়ে বুট কাঁধে রাইফেল নিয়ে খিলা বাজারে পৌঁছালে হাজার হাজার নেতাকর্মীরা তাঁকে কাঁধে নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে পাঁচপুকুরিয়া গ্রামে নিয়ে আসেন। ২০০৯ সালের ১৪ জানুয়ারি গণমানুষের এই নেতা ইন্তেকাল করেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক তাঁর গ্রামের ভেঙ্গে ফেলা বাড়ি মেরামত করতে সক্ষম হননি।
তাঁর মৃত্যুর পর ২০০৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার গঠন করলে সংসদের প্রথম অধিবেশনে এই নেতার উপর শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
– কথাসাহিত্যিক ঔপন্যাসিক, পাঁচপুকুরিয়া, মনোহরগঞ্জ, কুমিল্লা।
এসএস/সিএ