১. ‘আমার মানুষটা যেনো সুস্থ হয়ে ওঠে। সবাই আশির্বাদ ও দোয়া করবেন। ‘ সকলের উদ্দেশ্যে মৌরি’র শেষ আকুতি ছিল এটি। আমি জানার পর থেকে গত দুদিন আমার প্রতিদিনের নিয়মিত প্রার্থনায় মৌরিকে রেখেছিলাম। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার প্রার্থনা ছিল এটাই – ‘সৃষ্টিকর্তা যেন অভিকে মৌরি’র কাছ থেকে সারাজীবনের জন্য কেড়ে না নেয়।’ কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন না। শেষ পর্যন্ত মৌরি’কে এক অনিশ্চিত জীবন বরণ করে নিতে হলো।
১৬ তারিখ (বৃহস্পতিবার) রাতে কল আসলো মৌরি’র বরকে মুমূর্ষু অবস্থায় ওমেন্স মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। লাইফ সাপোর্টে আছে। সাথে সাথে যে যার মতো করে নিজেদের পরিচিত মানুষ খুঁজে বের করার চেষ্টা শুরু করলাম। যাতে সাথে সাথে হাসপাতালে ছুটে গিয়ে সাপোর্ট দেওয়া যায়। রাত শেষে ১৭ তারিখ। হাসপাতালে ভর্তির ২য় দিন শুরু। ডাক্তারের পক্ষ থেকে ৪৮ ঘন্টার সময় বেঁধে দেওয়া হলো। এসবের সবকিছুই গুটিকয়েকের মধ্যে গোপন রাখা হলো। নিজেদের মনকে শান্তনা দেবার জন্য বিকেলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলো।
২. শেষ খবরটি পাওয়া মাত্রই দুই বন্ধু স্টেশনের দিকে ছুটলাম। যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে কালনী ঢুকলো। মামা আমাদেরকে ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন। সুমিত আর আমি তখন পর্যন্ত বুঝতে পারছিলাম না আমাদেরকে কি পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। দুজনের মনে শুধু একই প্রশ্ন- ‘মৌরিকে কি বলে শান্তনা দেবো?’ যেখানে নিজেরাই নিজেদেরকে শান্তনা দিতে পারছিলাম না। মাথায় শুধু এটাই ঘুরছে ‘মৌরি’র কি হবে’!!
৩. সিলেট পৌঁছে তন্বী, প্রতীকসহ বাকিদের সাথে ঠান্ডা মাথায় পরামর্শ শুরু করলাম কিভাবে মৌরিকে বিষয়টি জানানো যায়। তার আগে চিন্তা করলাম মৌরিকে জানানোর পর কি কি সম্মুখীন হতে হবে। কেননা, মৌরি ২ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। প্রথমে চিন্তা করলাম সাথে যেহেতু প্রতীক আছে সেহেতু ডাক্তারের সাপোর্টটা গাড়িতে পাওয়া যাবে। জানার পর মৌরির সিরিয়াস কিছু হলে সেখানে (গোয়াইনঘাট) উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে কিরকম সময় লাগতে পারে। সেখানে আমরা কি ধরনের সাপোর্ট পেতে পারি। সেই সাথে গাড়িতে পানিসহ কি কি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র রাখা দরকার সবকিছু আগাম চিন্তা করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হলো।
এর মধ্যে বাঁধনরা ফ্রিজিংভ্যানে করে লাশ নিয়ে প্রায় ব্রাহ্মনবাড়িয়া পর্যন্ত পৌঁছে গেলো।
আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে ৩ টার আগে তারা সিলেট পৌঁছাতে পারবেনা। শেরপুর চলে আসার পর আমাকে আর সুমিতকে আড়ালে রেখে তন্বী, পার্থরা উপরে গেল মৌরিকে বের করে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসার জন্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী মৌরিকে বলা হলো ‘ঢাকায় যেতে হবে’। এর মধ্যে লাশবাহী গাড়ি নিয়ে বাঁধনরা সিলেট পৌঁছে গেল। আরেকটি গাড়িসহ ইবনে সিনার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের যাওয়ার অপেক্ষা করলো। আমরা সেখানে চলে গেলাম। সারা রাস্তা বাঁধন নিজেকে শক্ত করে রাখতে পারলেও সিলেট পৌঁছে কাছের সব মানুষকে কাছে পেয়ে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলোনা। মনকে হালকা করতে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলো।
৪. জীবনে এরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করা এটাই ছিল প্রথম। যেখানে নিজেকেই সামাল দিতে পারছিনা, সেখানে অন্যদের সামাল দিবো কি। আমি, সুমিত দুজনের মনের কথাগুলো ওই মুহূর্ত এরকমই ছিল। একদিকে বাঁধনরা, অন্য দিকে মৌরিসহ তার বাসার মানুষ। অপরদিকে অভি’র মা,বাবা, বোন।
তন্বী পার্থসহ যারা প্রকৃত সত্যটা জানে তারা সবাই সিদ্ধান্ত নিলো যে নিজেদেরকে শক্ত হতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনে পাথর হয়ে যেতে হবে। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করা হলো সবাইকে এক গাড়িতে দেওয়া যাবেনা। সামাল দেবার জন্য প্রত্যেককে ভাগ করে দেওয়া হবে। যেমন- মৌরিকে যে গাড়িতে রাখা হবে সেই গাড়িতে অভি’র মা, বাবা আর বোনকে দেওয়া যাবেনা। এভাবে ভাগ করে ৩ টা গাড়ি রেডি করা হলো। এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়িকে অনেক দূরত্ব রাখা হলো। ঢাকার কথা বলে প্রথমে মৌরি’কে উঠানো গাড়িটা এয়ারপোর্টের দিকে ছেড়ে গেলো। ড্রাইভারকে বলে দেওয়া হলো যেন শহরের বিভিন্ন রাস্তা ঘুরিয়ে তারপর পরিচিত রাস্তায় যায়। যাতে মৌরি রাস্তা দেখে বুঝতে না পারে ‘ঢাকা নয়, তার চিরচেনা শ্বশুর বাড়ি’র দিকেই তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই গাড়ির অনেক পরে অভি’র পরিবারের মানুষদের বহনকারী গাড়ি ছাড়া হলো। তারপর ‘লাশবাহী গাড়ির মধ্যে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে থাকা অভি’র গাড়িকে আমাদের পেছনে রেখে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। শেষবারের মতো শহরের পাড়াপ্রতিবেশীদেরকে অভি’র মুখটা দেখানোর জন্য কিছু সময় গাড়ি থামানো হলো। তারপর আস্তে আস্তে করে অভি’কে নিয়ে আমরা চললাম তার গ্রামের বাড়ি গোয়ানঘাটের দিকে। এর মধ্যে ফোনে খবর এলো মৌরি গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছে। আমরা একটু টেনশনমুক্ত হলাম এই ভেবে যে- রাস্তা দেখে চেনার ভয়টা আপাতত নেয়। তবে ঘুম ভাঙ্গার পর মৌরি কিছুটা আঁচ করে ফেলেছিল। তখন আর লুকানো সম্ভব হয়নি। পার্থ আর তন্বী মৌরিকে শক্ত করে ধরে জানিয়ে দিলো যে -‘তোর অভি আর নেই মৌরি’। অনেক চেষ্টা করেও তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হলোনা’।
তারপর?
শোকে স্তব্ধ হওয়া কোনটাকে বলে সেটা মৌরিকে দেখে বুঝতে পারলাম। প্রথম জানার পর গাড়িতে কান্না করলেও বাড়িতে পৌঁছে সে যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। সকলে মিলে কাকে রেখে কাকে সামাল দেবো সেটা চিন্তা করার মতো অবস্থা ছিলনা। একদিকে জীবনসঙ্গীকে হারানের বেদনায় মৌরি শোকে স্তব্ধ, অন্যদিকে বড় ছেলেকে হারিয়ে বাবা-মায়ের আর্তনাদ, বড় ভাইকে হারিয়ে ছোট ভাই-বোনের আর্তনাদ। দুলাভাইকে হারিয়ে শালক-শালিকার আর্তনাদ, বন্ধুকে হারিয়ে বন্ধুদের আর্তনাদ। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীর আর্তনাদ তো আছেই। যেখানে নিজেরাই নিজেদের শান্তনা দিতে পারছিনা, অন্যদের দেবো কি?
৫. ২১ জানুয়ারী মৌরি বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করে। তার মানে বিয়ের ১১৯ দিন পর সে তার জীবনসঙ্গীকে পৃথিবী থেকে হারিয়ে ফেললো। আর বিয়ের ১ বছর আগে হারায় তার বাবাকে। এদিকে মৌরি ২ মাসের অন্ত:সত্বা। তার মানে জন্মের আগেই অনাগত সন্তানটি তার বাবাকে হারিয়ে ফেললো। অন্যদিকে মৌরির অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলমান। চলন্ত ট্রেনে বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছি ঠিকই, কিন্তু ভেসে বেড়াচ্ছে মৌরি’র পরবর্তী জীবনটার প্রতিচ্ছবি।
এই মুহূর্তে মৌরির জন্য মানসিক সাপোর্ট দরকার। দরকার মানসিক সুস্থতার। শোক কাটিয়ে উঠার জন্য সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার। যে সমাজ ব্যবস্থায় আমরা জীবন কাটাচ্ছি সেখানের কুসংস্কার আর খারাপ চিন্তার মানুষের কথার তোয়াক্কা না করে এড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারলে মৌরি আর যায় হোক, মানসিক অসুস্থতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে বলে আমি মনে করি। আর এর ব্যতিক্রম কিছু হলে মৌরি’র মানসিক সুস্থতার জন্য তার মা, ভাইয়ের সাথে শ্রীমঙ্গল থাকাটা ভাল সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করি। এতে করে তার অনাগত সন্তানের জন্যও ভাল হবে।
৬. ডাক্তারের ব্যাখ্যা ছিল এরকম- বাইক থেকে অভি সামনের দিকে না পড়ে পেছনের দিকে পড়ে। আঘাতটা মাথার কঙ্কালে না লেগে কঙ্কালের নিচের অংশে লাগে। যার ফলে ব্রেনের সেলগুলো ছিড়ে যায়। রক্ত জমাট বাঁধা শুরু করে। ব্রেন কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তবে ৩০ মিনিটের মধ্যে অক্সিজেন পেলে ঝুঁকি কম থাকতো। সার্জারি করার মতো অবস্থা থাকতো। অক্সিজেন না পাওয়াতে সেলগুলো অকেজো হওয়া শুরু করে দেয়।
দূর্ঘনার পর প্রায় ৩০-৪০ মিনিট শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ থাকে অভি’র। শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অক্সিজেন ব্রেনে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অক্সিজেন না পাওয়ার কারণে ব্রেনের সেলগুলো আস্তে আস্তে অকেজো হওয়া শুরু করে। যখন এক্সিডেন্ট হয় তখন ব্রেনের ঠিক নিচের জায়গা যেখানে স্পাইনাল নার্ভ থাকে সেগুলো সাথে সাথে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তখন ব্রেনের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হওয়া শুরু করে। সে রক্ত ব্রেনের সামনের দিকে চলে আসে। প্রি ফ্রন্টাল এরিয়ায় রক্তগুলো জমাট বেঁধে যায়। একদিকে অক্সিজেন পাচ্ছে না, অন্যদিকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে । রক্তক্ষরণ হওয়া মানে যেহেতু স্ট্রোক করা। এই অবস্থায় সাথে সাথে কয়েকবার স্ট্রোক করে। অক্সিজেন না পাওয়া, ব্রেনের সেলগুলো অকেজো হওয়ার প্রায় ১ ঘন্টা পর অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয়। এই কারণে তার ব্রেন সেলগুলো অকেজো হওয়া শুরু করেছে। যতক্ষণে তাকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করা হয় তার অনেক আগে থেকেই রোগীর অনেক অংশই ডেমেজ হয়ে যায়।
আর যেহেতু ব্রেন থেকে কোন অক্সিজেন যাচ্ছে না, রক্ত যাচ্ছে না সেকারণে রোগীর হার্টটাও আস্তে আস্তে ব্লক হয়ে যায়। সেটা প্রায় ৭-৮ ঘন্টা পর। ১৬ তারিখ রাতে সাড়ে ১১ টার দিকে এক্সিডেন্ট করার পর হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় ১৭ তারিখ সকাল বেলায় অভু’র কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়। এর কারণে হার্টবিট বন্ধ হয়ে যায়। পরে সিপিআর দেওয়া হয়। তারপর হার্টবিটটা মোটামুটি স্টাবল পর্যায়ে চলে আসে। সব মিলিয়ে রোগীর অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক ছিল।
ব্রেনে রক্তক্ষরণ, রক্তজমাট বাঁধা এবং ব্রেনের সমস্ত জায়গায় রক্ত ছড়িয়ে যাওয়ার মতো অবস্থার কারণে সার্জারী করার মতো পরিস্থিতি থাকেনা। ১% সুযোগ থাকলেও সার্জারী করা সম্ভব হতো। যেহেতু রক্তগুলোর সরানোর মতো কোন সুযোগ ছিলনা, সেক্ষেত্রে সার্জারী করে কোন লাভ হতো না। সেজন্য বাঁচার সম্ভাবনা ছিলনা।
মূলকথা- যেহেতু ব্রেন থেকে অক্সিজেন হার্টের দিকে যায়। ব্রেন থেকে অক্সিজেন যাচ্ছিলোনা, সেহেতু ব্রেনটা ডেমেজ হয়ে যায়।
পুরো শরীরটাকে যেহেতু ব্রেন কন্ট্রোল করে। সেখানে ব্রেনের শক্তি কমে যায়, গ্লাসগো কোমা স্কোর (জিসিএস) পয়েন্ট ৪ এ চলে যায়। আই রেসপন্স, ভার্বাল রেসপন্স, মোটর রেসপন্স ৩ টা পয়েন্টেই প্রায় একদম নিম্ন স্কিলে ছিলো। বলে রাখা ভাল মেডিকেল সায়েন্স এর মতে- সবচেয়ে ডিপেস্ট কোমায় ছিল অভি।
৭. ১৬ মে ( বৃহস্পতিবার) রাত আনুমানিক ১০ টা থেকে সাড়ে ১০ টার মধ্যে অভি’র মোটরসাইকেলটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কের ধোপাগুল এলাকাযর আশেপাশে এ দূর্ঘটনাটি ঘটে। প্রথমে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলেও ভাল চিকিৎসাসেবা পাওয়ার আশায় নয়াসড়কের মাউন্ট এডোরায় নেওয়া হয়। সেখানে আইসিইউ খালি না থাকায় ওমেন্স মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাত ১২ টা ৪৯ মিনিটে ইমার্জেন্সি রুম থেকে আইসিইউতে ভর্তি। ১৭ ও ১৮ তারিখ ওমেন্সে রাখার পর ১৮ তারিখ বিকেল ৫ টা ৫ মিনিটে ওসমানী মেডিকেলের মাঠ থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স এয়ারপোর্টে পৌছায় ৫ টা ৫০ মিনিটের দিকে। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে করে এভার কেয়ার হাসপাতালে। হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৬ টা ২০ মিনিট। ইসিজি করার পর সন্ধ্যা ৭ টা ১০ মিনিটে মৃত্যুর বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়া যায়।
লেখক: জীবন পাল, সাংবাদিক
এসএস/সিএ