একগুচ্ছ মে দিবসের কবিতা ।।।।।। বিচিত্র কুমার
(০১)
এক ফোঁটা ঘামের মতো সত্য
সব ইতিহাসই এক ফোঁটা ঘামের মতো সত্য—
যেটা পড়লে চামড়ায় লেগে থাকে,
কিন্তু ধুয়ে দিলে লুকিয়ে পড়ে স্মৃতির নিচে।
এই ঘাম শুধু পরিশ্রম নয়,
এটা হলো একটি নামহীন সময়ের সাক্ষর,
যেখানে দুপুর কেটে যায় জলপানের আগেই,
আর সন্ধ্যা নামে
ভাঙা জুতোর তলায় শব্দ রেখে।
শ্রমিকদের কোনো বায়োগ্রাফি হয় না,
তাদের জীবনের হরফগুলো
লিখে রাখা হয় দালানের ইটের মাঝে,
আর একদিন সেই দালানেই
চেষ্টা করে বসতে অন্য কেউ—
যে ঘাম বোঝে না, বোঝে শুধু আয়।
(০২)
মিস্ত্রির হাত
সে বলে না কিছু,
তবু তার হাতে লেখা থাকে—
প্রতিটি কাঠামোর ইতিহাস,
যেন ইটের মধ্যেও হৃদস্পন্দন থাকে
যদি মিস্ত্রির হাত ছোঁয়।
তার হাত আর হাতুড়ির মাঝে
একটি গান জন্মায়,
যা কেউ শোনে না—
তবু প্রতিদিন সেই সুরে দাঁড়িয়ে যায় ভবিষ্যতের দালান।
রাত শেষে ক্লান্তি নামে,
তবুও হাতদুটো যেন জানে
কি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ভেঙে না পড়ে,
যেন তারা নয় হাত—
মানুষের সবচেয়ে পুরনো ঈশ্বর।
(০৩)
শ্রমিকের রোদে পোড়া ছায়া
রোদের নিচে সে দাঁড়িয়ে থাকে,
কিন্তু তার ছায়াটাও গলে যায়
ঘামের মতো মাটি ছুঁয়ে।
কারণ তার ছায়াও জানে—
এ জীবনে বিশ্রাম মানে বিলাসিতা,
আর স্বপ্ন মানে অতিরিক্ত শিফট।
কেউ ছায়ার মাপ নেয় না,
তবে সে জানে—
এই পোড়া ছায়ার মাঝেই লুকিয়ে আছে
একটা মেয়ের স্কুলফি,
একটা স্ত্রীর হারিয়ে যাওয়া হাসি,
আর একটা বুড়ো বাবার ওষুধের বিল।
(০৪)
ধুলোর স্বপ্ন
আমি প্রতিদিন গড়ে তুলি ভবিষ্যৎ,
কিন্তু আমার নিজের ঘরের ছাদ নেই।
ধুলোর ভিতর দাঁড়িয়ে থাকা এই কংক্রিটের দেয়াল,
যেন আমার না-পাওয়া স্বপ্নের প্রতিলিপি—
যা আমি বানিয়েছি,
তবে যার ভিতর আমি থাকি না।
আমার চোখে ধুলো ঢোকে,
তবুও আমি স্বপ্ন দেখি—
একদিন আমার ছেলেও স্কুল যাবে,
যেখানে তার ইউনিফর্মে থাকবে না
ইটের গুঁড়ো, থাকবে আলোর গন্ধ।
(০৫)
প্রবাসী শ্রমিকের চিঠি
মা, আমি ভালো আছি বলি,
কিন্তু এই মরুভূমির বুকে
রাতগুলো এমন নীরব যে
নিজের নিঃশ্বাস শুনলেও ভয়ে জেগে উঠি।
এখানে সূর্য এত কাছে,
যেন প্রতিদিন পিঠে আগুন মেখে ঘুরি।
তবুও তোমার পাঠানো আলুর ভর্তা আর
ছোট ভাইয়ের আঁকা ছবি
আমার রুমের এক কোণে ঝুলে থাকে
অদৃশ্য ঈশ্বরের মতো।
আমি মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে
আল্লাহর চেয়ে তোমার মুখ মনে করি বেশি,
আর টাকা পাঠানোর সময় মনে হয়
আমি না খেয়ে খাইয়ে দিচ্ছি স্বপ্নকে।
মে দিবসে আমাকে কেউ ফুল দেয় না,
তবে একেকটা রেমিট্যান্স যেন হয়ে ওঠে
আমার আত্মার কবিতা।
(০৬)
যন্ত্রের দেশে শ্রমিক
আজকাল মেশিন জানে কিভাবে হাসতে হয়,
আর শ্রমিক ভুলে গেছে কিভাবে কাঁদতে হয়।
তারা দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি
প্রোডাকশনের নিচে,
যেন মানুষের শরীর নয়—
একটা সফটওয়্যারের পার্টস মাত্র।
যন্ত্র বিশ্রাম নেয়,
তবে শ্রমিকদের ছুটি মানে অপমান,
তাদের নামে নেই লোন, নেই লাইসেন্স, নেই লিগ্যাসি—
শুধু একেকটা সংখ্যায় বন্দী হয়ে
তারা হারিয়ে যায় মাস শেষে বেতনস্লিপে।
তবু তারাই গড়ে এই সভ্যতা—
যন্ত্রের ভিতর ঢুকে পড়ে
আর মেটালের ভেতর খুঁজে ফেরে মানবতা।
(০৭)
শ্রমিকের ঈশ্বর
আমাদের ঈশ্বর আছে কি?
নাকি ঈশ্বরও ওভারটাইমে ব্যস্ত?
আমরা শুধু দেখি—
তাঁর নাম লেখা থাকে মন্দিরের গম্বুজে,
তবু আমাদের রুটির কনুইয়ের পাশে
তিনি বসেন না কখনো।
আমরা প্রার্থনা করি,
কিন্তু প্রার্থনা শেষ হওয়ার আগেই
জেগে ওঠে বাসের হর্ণ,
আর হাতে চাপা পড়ে ঈশ্বরের নাম।
তবুও আমরা বিশ্বাস করি—
একদিন হয়তো ঈশ্বর নিজেই এসে বলবে,
“আজ তোমার ছুটি,
চলো একটা গল্প করি
ঘামের নয়, হাসির।”
(০৮)
শ্রমিকের হাত
শ্রমিকের হাত মানে শুধু মাটি ছোঁয়া নয়,
এ হাত হলো ভূমির প্রথম প্রেমিক,
যে আঙুলে ঘাম জমে, সেখানে ভোরের আলো জন্ম নেয়—
জন্ম দেয় কারখানা, কামারশালা, ঘরবাড়ি, শিশুর হাসি।
এই হাতই জানে কিভাবে লোহার ভাষা বোঝাতে হয় ইটকে,
জানে কেমন করে ইচ্ছেগুলোকে ঠেলে দিতে হয়
কোনো যন্ত্রের বুকে ঠাসা দুপুরে,
যেন অন্তহীন ক্লান্তি নিজেই হয়ে ওঠে উৎপাদনের ছন্দ।
একজন শ্রমিকের নখের নিচে জমে থাকে
সেইসব স্বপ্ন, যা দালানকোঠার মালিকও দেখেন না।
ওদের চোখে থাকে আগুন,
যা জ্বলে একেকটা বেতনচেক না পেলে।
তবু তারা হাসে, ঠিক যেমন রোদ হাসে কুয়াশার ভিতর,
কারণ শ্রমিকের হাসি হলো প্রতিরোধের সবচেয়ে প্রাচীন কবচ।
(০৯)
মে দিবসের দিনটি
মে মাসের এই দিনটা ঠিক যেন
শুধু একটা তারিখ নয়,
এটা একটা সজীব ক্যালেন্ডার পাতা,
যেখানে লাল কালি দিয়ে লেখা থাকে
গর্জে ওঠা কণ্ঠস্বরের পদচিহ্ন।
এই দিনটা কুয়াশায় মোড়া সকাল না,
এটা এক রক্তমাখা দুপুর,
যেখানে একটা চাকা ঘুরে না
তাকেই বলে উঠে “আমিও মানুষ!”
মে দিবস মানে হাজারো পায়ের শব্দ,
যা ক্লান্ত হলেও হারে না,
এই দিবস হলো এক অদৃশ্য পতাকা,
যেটা ওড়ে প্রতিটি বাঁশির শব্দে,
কারখানার গেটে, দোকানের ঝাঁপে,
টিনের ছাউনির নিচে ছোট ঘুমে।
শ্রমিকের গল্প বলা হয় কম,
কারণ তাদের কষ্ট অত সহজে কবিতায় আসে না—
তবুও মে দিবস যেন এক কবিতার জন্মদাতা,
যার প্রতিটি চরণ লেখা হয়েছে রক্তে আর ঘামে।
(১০)
ঘামের মতো পবিত্র
ঘাম একমাত্র তরল যা প্রার্থনার মতো পবিত্র।
এটা কখনো দল বেঁধে নামে,
কখনো একা,
ঠিক যেমন শ্রমিকেরা উঠে পড়ে ভোরের ট্রেন ধরে—
নিঃশব্দে, নিরবধি, অবিরাম।
একজন শ্রমিক যখন হাত তুলেন,
তার ছায়া পড়ে খাদের গায়ে,
যেখানে লুকিয়ে থাকে সমাজের মুখোশ—
তার হাসি হয়ে ওঠে প্রতিবাদের সবচেয়ে নরম গান।
তারা যখন হাঁটে, পৃথিবী তার তাল মিলিয়ে কাঁপে,
যেন এই পদক্ষেপে জেগে ওঠে
সমস্ত ঘুমন্ত শহর,
আর দালানগুলো নতুন করে বুঝে ফেলে
কে আসল নির্মাতা!
ঘামের মতো পবিত্র কিছুই নেই—
না প্রেম, না কবিতা, না ঈশ্বর,
কারণ ঈশ্বরকেও গড়েছে যে শ্রমিক,
সে ঈশ্বরের চেয়ে বড়ই হয়তো।
(১১)
নারীকর্মীর করতল
নারীকর্মীর করতল মানে যেন একটি নদী—
যার তীরে তীরে জমে আছে চুড়ির শব্দ,
আর ভেতরে প্রবাহিত হয়
অজস্র না বলা কথা, অবহেলার গল্প,
সেইসব রাত, যেখানে শিশুর জ্বর আর ওভারটাইম
একই নিঃশ্বাসে বাঁধা পড়ে।
সে যখন মেশিন চালায়,
তার আঙুলে জড়িয়ে থাকে রান্নার ধোঁয়া,
আর মন বয়ে চলে
স্কুলে ফেলে আসা সন্তানের চোখ।
এই দুই জগৎ সে বয়ে বেড়ায় পিঠে,
যেন নিজের শরীরটাই একটা রেলগাড়ি—
ঘামে ভেজা, অথচ ছুটে চলে নিরবধি।
কেউ বলে না,
যে মেয়েটা সেলাই মেশিনে আট ঘণ্টা কাটায়,
সে আসলে একটা অদৃশ্য জাদুকরী,
যে সমাজের বেহুলার সাজও তৈরি করে,
আর নিজের শরীর ঢাকে পুরনো শাড়িতে।
(১২)
বেতন-বিহীন স্বপ্ন
স্বপ্ন যদি বাজারে বিক্রি হতো,
তবে একেকজন শ্রমিক হয়তো
তাদের ঘামে ভেজা দুপুরগুলো দিয়ে কিনে ফেলত
এক টুকরো সায়া,
যেখানে ছেলের স্কুলের বেতন আর
বাড়িভাড়ার মাঝে কোনো সংঘর্ষ নেই।
তারা যেসব স্বপ্ন দেখে,
তা নেমে আসে ফ্যাক্টরির ছাদ থেকে,
কারখানার ফ্যান ঘুরতে ঘুরতে যেন বলে ওঠে—
“আবার কাল আসবে, আবার ঘামবে,
তবু তোমার নামে কোনো ছুটি নেই।”
বেতন না পেলে যা হারায়,
তা শুধু পকেটের টাকা নয়,
তা হলো আত্মসম্মান, সন্তানের চোখের চাহনি,
স্ত্রীর মুখে উঠে আসা সেই চাপা দীর্ঘশ্বাস,
যেটা কখনো ঝগড়া হয় না,
কিন্তু দেয়ালে দাগ ফেলে রাখে।
(১৩)
জুতার তলার চিৎকার
শহরের প্রতিটি পিচঢালা রাস্তায়
লেগে আছে জুতার তলার চিৎকার—
যেখানে একজন দিনমজুর হাঁটে
ছয়টা ইট মাথায় নিয়ে,
আর তার পদক্ষেপ হয়ে ওঠে
একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রের সিগনেচার।
এই চিৎকার শোনা যায় না,
কারণ তা মোবাইলের স্ক্রিনে থাকে না,
থাকে না পত্রিকার হেডলাইনে—
এটা কেবল বোঝে সেই শিশু,
যার বাবার হাঁটু বেঁকে গেছে সিঁড়ি ওঠতে ওঠতে।
জুতোর নিচে চাপা পড়ে যায় স্বপ্নের কঙ্কাল,
তবুও সেই জুতো দিয়েই একদিন
হেঁটে যায় তারা—
চাকরি খুঁজতে, মর্যাদা খুঁজতে,
আর যদি কিছু না পায়,
তবে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে এক ফালি চাঁদের নিচে।
(১৪)
আমার বাবা একজন শ্রমিক
আমার বাবা একজন শ্রমিক,
সে নায়কের মতো হাঁটে না,
তবে তার পিঠে যদি হাত রাখো—
তবে বুঝবে সে পাহাড় বয়ে নিয়ে আসে প্রতিদিন।
তার শরীর থেকে উঠে আসে তেল, ধুলো, রোদ আর ক্লান্তির গন্ধ,
যেটা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ সুগন্ধি।
সে বলে না “ভালোবাসি”—
তবে প্রতিদিন বাজার থেকে নিয়ে আসে আধা কেজি আলু,
যেখানে আমি খুঁজে পাই অপার মমতা।
বাবা রাতে টেবিলের পাশে বসে ঘুমিয়ে পড়ে,
কলম হাতে নিয়ে ছেলের নাম লেখে কাগজে,
আর তার স্বপ্নে ঢুকে পড়ে
বাড়ির ছাদে শুকাতে দেওয়া জামাকাপড়—
যেখানে সাফল্য কখনোই ঝোলে না।
বিচিত্র কুমার: খিহালী পশ্চিম পাড়া, আলতাফনগর, দুপচাঁচিয়া, বগুড়া,