ছোট গল্প ||| মনে প্রশ্ন থেকে গেল ||| আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস
পৌষ মাস মানে এমনিতেই রোদ কম হয়। যে রোদ টুকু বা হয় গনগনে হয় না। গায়ে তাত লাগেনা। তার উপর আবার উঠোন জুড়ে নানা রকম গাছপালার আলিঙ্গন। যারদরুন বাড়িতে একদম রোদ নেই। ধান সেদ্ধ করে আফসানা তাই বড় চিন্তায় পড়ে গেল। হায়! এই ধান সে শুকাবে কোথায়?
আফসানার স্বামী মুহিবুর। গায়ে চাদর জড়িয়ে সে চুপটি করে বসে আছে। আফসানার উঠোন ঝাঁট দেওয়া দেখছে।
আফসানা উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে আর মুহিবুরের প্রতি রাগে জ্বলছে। কিন্তু রাগ সে তৎক্ষণাৎ প্রকাশ না করে একটু পরে প্রকাশ করল। অর্থাৎ উঠোন ঝাঁট দেওয়া শেষ করে আবর্জনা গুলো বাইরে ফেলে এসে। প্রকাশ করল সে এইভাবে,”আমি নেহাতই ভালো মেয়ে তাই তোমার মতো স্বামীর ভাত খেয়ে গেলাম,তোমার সংসার করে গেলাম। অন্য মেয়ে হলে কবে তোমার মাথায় লাথি মেরে চলে যেত। আবার ভাতার ধরত।”
আফসানার কথায় মুহিবুর এবার নড়ে বসল, “তোরও কি তাহলে ভাতার ধরার শখ হয়েছে নাকি? যদি হয় তুইও ভাতার ধরতে পারিস। অসুবিধা নেই।”
আফসানা অমনি বলতে লাগল, “শখ হলে কি আর তোমার মতো ভাতারের ঘাড়ে পড়ে থাকতাম? কবেই তোমাকে ইয়ে করে আবার নতুন ভাতার ধরতাম। শখ হয়নি বলেই তো আজও তোমার ঘাড়ে পড়ে রয়েছি।”
মুহিবুর তার উত্তরে তখন বলল, “তাহলে আর বকবি না,চুপ করে থাক।”
আফসানা মুহিবুরের কথা শুনল না। সে বকেই গেল, “চুপ করে থাকতে তো এখন বলবেই। তোমার আর কী! যত মরণ হয়েছে আমার।”
তার মরণ হওয়ার কথা শুনে মুহিবুর বলল,”তোর মরণ হয়েছে মানে! তোর আবার কী মরণ হল? বলতে পারিস,যত মরণ হয়েছে তোকে নিয়ে আমার।”
মুহিবুর এই কথা বলায় আফসানা তার উপর ভীষণ চটে গেল, “কেন,আমি কি তোমার বুকে রোজ ভাত রাঁধি? যে….”
মুহিবুর বলল,”আমার ঘাড়ে বসে খাচ্ছিস, আবার আমার সাথেই ঝামেলা করছিস।”
আফসানা সঙ্গে সঙ্গে কথা কাটল, “খাবোনা তো বিয়ে করে এনেছে কেন? বিয়ে করে না আনলেই পারতে।”
“ওটাই তো ভুল করেছি রে! ওই ভুল আর শুধরাতে পারছিনা। “মুহিবুর বলল।
আফসানা বলল,”বাড়ির গাছপালা তাহলে কাটছ না কেন? কাটলেই তো ঝামেলা করতাম না। বাড়িতে একটু রোদ আছে? ধান শুকাব কোথায়? তোমার মাথায়? বলছ তো!”
মুহিবুর তাকে তখন বোঝানোর চেষ্টা করল, “এখন না হয় শীতকাল তাই রোদ নেই। কিন্তু গরমকালে? তখন কী আরাম একবার ভেবে দেখেছিস? গরমে মানুষ যখন ছটফট করে আমরা তখন কত আরামে থাকি। ফ্যান না হলেও চলে যায়। আর শীতের এই একটা দুটো মাস একটু সহ্য করতে পারছিস না? তোকে নিয়ে আর পারিনা রে!”
আফসানা মুহিবুরের কথা বুঝল। আর বুঝল বলে সে আর কথা বাড়াল না। বরং মুহিবুরের দিকে তাকিয়ে ‘ফিক’ করে হাসল। আর তার সেই হাসি থেকে প্রচুর প্রেম ঝরে পড়ল।
মুহিবুর বলল, “তোর আসলে লজ্জা নেই রে! লজ্জা থাকলে তুই….”
আফসানা তখন ফের হাসল, “তুমি আমার ভালো স্বামী না! খুব ভালো স্বামী। তোমাকে আমি কত ভালোবাসি। তাই…” বলে আফসানা মুহিবুরের দুই গালে টপাটপ দুটো চুমো খেয়ে নিল,”তোমাকে আমি চুমো খেলাম, তুমি আমাকে খেলে না?”
মুহিবুর আফসানার দিকে তাকিয়ে তখন বলল, “খাবো তো খাবো কোথায়,শুনি!”
“কেন,গালে।তুমি তো গালেই….”
মুহিবুর তখন উত্তরে বলল, “তোর গালে চুমো খাওয়ার চাইতে তুই যে হাঁড়িটায় ধান সেদ্ধ করলি তার তলায় চুমো খাওয়া অনেক ভালো।”
শুনে আফসানার তো চরম রাগ হয়ে গেল, “কী বললে!”
মুহিবুর বলল, “তোর গালে…”
আফসানা তখন মেজাজ হারিয়ে ফেলে মেয়েলি বচন শুরু করে দিল, “আমার থেকে কোন মাগীর গাল এত সুন্দর শুনি!”
মুহিবুর হাসল, “খামোখা তুই মুখ খারাপ করছিস কেন?”
“কেন করব না শুনি! কত বড় কথা তুমি আমাকে বললে!”
মুহিবুর বলল, “কেন বললাম ঘর থেকে আয়নায় একবার মুখটা দেখে আয়। তারপর বলিস।”
আফসানা সত্যি সত্যি আয়নায় মুখ দেখতে ঘরে চলে গেল এবং বিয়েতে তার বাবার দেওয়া বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা দেখে খিলখিল করে হাসল। তার দুই গালে যে হাঁড়ির কালি লেগে রয়েছে। কখন লেগে গেছে সে কিছুই বুঝতে পারেনি। এরপর শাড়ির আঁচল দিয়ে গালের কালি মুছে আফসানা যখন ঘর থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল মুহিবুর তার পাওনাটা পূরণ করল।
পরে আফসানা মুহিবরকে বলল, “তুমি একটা কাজ করো এখন,সুফিয়া বুবুর কাছ থেকে একবার ঘুরে আসো। তাদের ছাদটা পাওয়া যাবে কি দেখে আসো।”
সুফিয়া বিবির বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। মাত্র কয়েকটা বাড়ির পরে। মুহিবুর গিয়ে শুধাল, “ছাদটা পাওয়া যাবে,বুবু?”
মুহিবুর ছাদের কথা বলতেই সুফিয়া বিবি বুঝে নিল যে,আফসানা নিশ্চয়ই ধান সেদ্ধ করেছে। না হলে ছাদের কথা শুধাবে কেন?
তবু সে শুধাল,”কী শুকাতে দিবি?”
মুহিবুর বলল,”ধান শুকাতে দিব।”
“সেদ্ধ ধান নাকি?”
“হ্যাঁ।পাওয়া যাবে?”
সুফিয়া বিবি বলল,”ছাদ তো পড়েই আছে। পাওয়া যাবে না কেন?”
মুহিবুর ফিরে এসে আফসানাকে সে কথা বললে পরে আফসানা উঠোন ঝাঁট দেওয়া ঝাঁটাটা নিয়ে ছাদ ঝাঁট দিতে চলে গেল এবং যাওয়ার সময় মুহিবুরকে বলে গেল যে,ধান গুলো সে যেন এক জায়গায় জড়ো করে রাখে।
আফসানা হাঁড়ি হাঁডি ধান সেদ্ধ করেছে আর উঠোনে জায়গা জায়গা ঢেলে রেখেছে। যাতে ধানের ভিতরকার গরম ভাপ বেরিয়ে যায়। কিন্তু মুহিবুর আফসানার কথা মতো সব ধান এক জায়গায় জড়ো করল না। সে হিসেব করে দেখল যে,সব ধান যদি সে এক জায়গায় জড়ো করতে যায় তাহলে সময় বেশি লাগবে এবং খাটতে বেশি হবে। তার থেকে সে যেখানে যেমন ধান আছে বস্তায় ভরতে লাগল। ভরতে ভরতে কিছু ধান ভরতে বাকি থাকতেই আফসানা চলে এল। এসে সে-ও হাত লাগাল। তারপর সব ধান বস্তায় ভরা হয়ে গেলে আফসানা সেই বস্তা ধরে ধরে মুহিবুরের মাথায় তুলে দিল। আর মুহিবুর ছাদে রেখে রেখে এল। সর্বমোট পাঁচ বস্তা ধান হল। মুহিবুরকে তাই ছাদে পাঁচবার যাওয়া-আসা করতে হল। তাতে মুহিবুরের ঘাড় কিছুটা ধরে গেলে ঘাড় ঠিক করতে ছাদে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ ঘাড়ের ব্যায়াম করল। তারপর ঘাড় ঠিক হয়ে গেলে ছাদ থেকে নিচে নেমে এল। আর আফসানা ছাদে খুব পাতলা করে ধান মেলে দিল। যাতে ধান খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। কিন্তু ধান তা-ও অত তাড়াতাড়ি শুকাল না। শুকাতে পুরো চার দিন লেগে গেল। রোদের তাপ না থাকলে অত তাড়াতাড়ি ধান শুকায়? তার উপর আবার ছোট দিনের বেলা। দেখতে দেখতে চলে গেল। তাই,ধান শুকাতে চার দিন লেগে গেল। শেষ দিন আফসানা সুফিয়া বিবিকে বলল যে,ধান সেদ্ধ করে তার জানের জ্বলন হয়েছে।
সুফিয়া বিবি তখন এর উত্তরে যা বলল:এই জন্যই তো সে পৌষ মাসে ধান সেদ্ধ করে না। ছোট দিনের বেলা দেখতে দেখতে চলে যায়। তিন চার দিনের কমে ধান শুকায় না।
আফসানাও তখন বলল যে,এবার থেকে সে-ও তাই করবে। পৌষ মাসে আর কোনদিন ধান সেদ্ধ করবে না।…
এক ঘণ্টা পর পর আফসানা ধান নেড়ে দিল। ধান যাতে একপিঠে হয়ে না যায়। একপিঠে অর্থাৎ ধানের একদিক।একপিঠে হয়ে গেলে যে সেই ধানের চাল ভেঙে যায়। ফলে খুদের ভাগ বেশি হয়।সেই চালের ভাত খেতে মজা লাগেনা। আফসানা তাই এক ঘণ্টা পর পর ধান নেড়ে দিল। আর প্রত্যেকবার চারটে করে ধান ডলন দিয়ে চাল বের করে দাঁতে দিয়ে ধান হয়েছে কিনা দেখল। বারবার দেখলেও ধান হয়েছে কিনা সে বুঝতে পারল না। দুপুরের দিকে তাই চারটে ধান ডলন দিয়ে চাল বের করে সেই চাল গুলো হাতের তালুতে করে নিয়ে নিচে নেমে এসে সুফিয়া বিবিকে বলল,”বুবু,ধান হয়েছে কিনা আমি বুঝতে পারছি না। চাল গুলো তুমি একবার দাঁতে দিয়ে দ্যাখো তো।”
সুফিয়া বিবি চালগুলো হাত পেতে নিলেও দাঁতে দিল না। দাঁতে দিতে গিয়ে থেমে গেল,”আমার দেখা যাবেনা,বোন।”
আফসানা জিজ্ঞেস করল,”কেন,বুবু?”
সুফিয়া বিবি তখন বলল যে, সে আজ রোযা রেখেছে এবং আগামীকালও রোযা রাখবে। ধান হয়েছে কিনা তাই তার দেখা যাবেনা। তাহলে যে তার রোযা ভেঙে যাবে। বলে সুফিয়া বিবি চাল গুলো ফিরিয়ে দিল।
আফসানা চাল গুলো নিয়ে তখন চিন্তা করতে করতে বলল, “তাহলে কী হবে,বুবু!”
সুফিয়া বিবি বলল, তুই দাঁতে দে।”
আফসানা বলল,”আমি দাঁতে দিয়েছি বুবু,বুঝতে পারিনি।”
“এবার দে তো।”
সুফিয়া বিবির কথা মতো আফসানা চাল গুলো দাঁতে দিল। দিয়ে দাঁতের চাপ দিল। আর অমনি ‘কট’ করে শব্দ হল।সুফিয়া বিবি তখন পাশ থেকে সেই শব্দ শুনতে পেয়ে বলল,”ধান হয়ে গেছে।”
আফসানার মনে তখন একটাই প্রশ্ন জাগল যে,এখন তো রোযা নয়,সুফিয়া বুবু তাহলে এখন কীসের রোযা রেখেছে? প্রশ্নটা সে সুফিয়া বিবিকে করলও এক সময়,”আচ্ছা, বুবু?”
“বল।”
“বলছি,এখন তো রোযা নয়,কীসের রোযা রেখেছে তুমি তাহলে?”
সুফিয়া বিবি তার উত্তরে তখন এই কথা গুলো বলল যে,তারা যাতে দেশ ছাড়া না হয় এবং পূর্বপুরুষদের মতো তারাও যাতে এই দেশেই থাকতে পারে এবং এই দেশেই বাঁচতে পারে।আর এই দেশকেই ভালোবাসতে পারে। তার জন্য সে রোযা রেখেছে।
সঙ্গে সঙ্গে আফসানাও মুখ ফুটে বলে ফেলল যে,কাল থেকে সে-ও তাহলে রোযা রাখবে। সে-ও এদেশেই থাকতে চায়,এদেশেই বাঁচতে চায়। আর এদেশ ছেড়ে সে-ও কোত্থাও যেতে চায় না,কোত্থাও না.…
মানুষ সব হারালেও যে দেশ হারাতে চায়না। দেশকে ভালোবেসে খেয়ে না খেয়ে সুখে-দুঃখে দেশেই থাকতে চায়। সুফিয়া বিবি ও আফসানাকে দেখে সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল।এখন সময়ই বলবে যে,তাদের উপোস ভবিষ্যতে কতটা ফলপ্রসূ হবে।নাকি আদৌ হবেনা?মনে প্রশ্ন থেকে গেল।
লেখকঃ গল্পকার, পশ্চিমবঙ্গ,ভারত
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান