দ্বিতীয় পর্ব
ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ -২ ।। এবারের বিমান টিকিটি মোমিন সাহেব কয়েক মাস আগেই দিয়েছিলেন। মন্ট্রিয়ল-লন্ডন-জেদ্দা-ঢাকা এবং ফেরার পথও একই। আমি অবশ্য বলেছিলাম লন্ডন থেকে বাংলাদেশ বিমান ধরিয়ে দেয়ার জন্য। তিনি জানান এয়ার ক্যানাডার সাথে বিমানের কানেকশন পাওয়া কঠিন। আমিও তাই মেনে নিলাম। ভাবলাম তিনি আমাকে বেস্ট রুটটিই দিয়েছেন।
আমি আর অযথাই উদ্বিগ্ন হতে চাইলাম না। ১৩ নভেম্বর লন্ডনের পথে এয়ার ক্যানাডায় উঠতে গিয়ে সহকর্মি দিলীপ কর্মকারের সাথে দেখা হয়ে গেলো। তিনি জানালেন লন্ডন থেকে বাংলাদেশ বিমানে ঢাকায় যাচ্ছেন। ভাড়ার কথা জানালেন সাড়ে ১২ শো ডলার – আমার টিকেটের চেয়ে প্রায় পাঁচশো ডলার কম। কিন্তু আমি মনের দিক থেকে তিক্ত হতে চাইলাম না। ধরে নিলাম লন্ডনে যেহেতু একদিন থাকবো তাই হয়তো ভাড়ার এমন হাইজাম্প। তবে বাংলাদেশ বিমানের সাথে সংযোগ না থাকা নিয়ে আমার অস্বস্তি লেগেই থাকলো।
লন্ডনে একদিন থাকার পর ১৫ নভেম্বর ঢাকার পথে সৌদি এয়ার লাইনসের জেদ্দা ফ্লাইট ধরলাম। এই প্রথম সৌদিয়ায় উঠা। ভেতরের পরিবেশ ও সার্ভিস অন্য দুচারটি এয়ার লাইসনের চেয়ে উন্নত কিছু মনে হলো না। অপেক্ষায় থাকলাম কখন জেদ্দা এয়ারপোর্টে নেমে চারিপাশের মুক্ত হাওয়ায় নাক টানবো আর চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকবো বালু-তাবুর বর্বর মানুষগুলি কতোটা বদলেছে! প্রায় ৬ ঘণ্টা আকাশে থাকার পর বিমান গিয়ে থামলো জেদ্দা এয়ারপোর্টের এক বিরান ভূমিতে। কিন্তু মাটি স্পর্শ করতেই বিকট শব্দ করে উঠলো বিমানটি – পিলে চমকানো ঘষা খেয়ে। ক্রাশ ল্যান্ডিং হলো নাকি! যাত্রীরা সব সন্ত্রস্ত! অবশ্য দ্রুতই স্বাভাবিকতা ফিরে এলো। এর কয়েক মিনিট পর নামতে গিয়ে দেখলাম বিমান থেকে সিঁড়ি লাগিয়ে দেয়া হয়েছে টারম্যাকের শানবাঁধানো মাটি পর্যন্ত। আমার এক হাতে লাঠি যা আমার পায়ের ভারসাম্য রাখার জন্য প্রয়োজন। বাম হাতে হ্যান্ড ক্যারিয়ার আর কাঁধে ঝোলানো কম্পিউটার। দুপায়েই এঙ্কল ব্রেস (Ankle brace) জড়ানো। বেশ কষ্ট করে নামতে হলো। মোমিন সাহেবের দেয়া হুইলচেয়ার সুবিধা সৌদি বিমানের সিঁড়ির কাছে এসে অচল! তিনি কি আমার এখনকার অবস্থাটি অনুমান করতে পারছেন? এরপর বাসের দরোজা খুললে যাত্রীরা প্রায় হুড়মুড় করে উঠতে থাকলো। শেষে আমিও উঠলাম। কিন্তু আমার মতো হাতে লাঠি – কাঁধে ব্যাগ আর হ্যান্ডক্যারিয়ারের ভারে ন্যুব্জ মানুষকে দেখেও কেউ বসার জন্য কোনো সিট অফার করলেন না। বুঝতে দেরি হলো না যে এটি কানাডা নয়! এরপর অনেকদুর পর্যন্ত এবং অনেক সময় ধরে বাসে ওভাবে দাঁড়িয়েই যেতে হলো কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার আন্তর্জাতিক লাউঞ্জের দিকে। এখানে এসে হলো নতুন অভিজ্ঞতা।
প্রথমে সিকিউরিটি চেক ও ইমিগ্রেশনের কাজ করতে হলো। কর্মিদের আচার-ব্যবহার খুব বেশি খারাপ নয়। আন্তর্জাতিক লাউঞ্জ নামক চিহ্নিত স্থানটি আয়তনে কম এবং খুব বেশি মানুষের বসার ব্যবস্থাই নেই। এখান খেকেই এশিয়ার বিভিন্ন শহরে যাওয়ার জন্য যাত্রীরা ফ্লাইট ধরে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে আরো কয়েক শো যাত্রী ওই লাউঞ্জে এসে জড়ো হলো। বসার জায়গা তো নেই-ই; এখন দাঁড়িয়ে থাকাও কঠিন – গাঁয়ের সাথে গাঁ লেগে যায়! লাউঞ্জের এক কোণায় ওয়াশরুম – পাশাপাশি ৫টি দরোজা – দুটি ফ্লাট আর তিনটি হাইকমোড। একটি দরোজার উপর ‘পঙ্গু মানুষের জন্য নির্ধারিত’ সাইন থাকলেও তার দরজো কখনো খোলা পাওয়া গেলো না। ভয়ানক চাপের মধ্যে থাকতে হলো। প্রতিটি দরোজার সামনেই ভেজা ফ্লোরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছেন ৪/৫ জন করে যাত্রী। শৌচকর্ম শেষ করে তাঁদের অধিকাংশই আবার পাশের স্বল্পস্থানে হাতমুখ ধুয়ার জায়গায় অজু করে নেন বিশেষ ভঙ্গিমায় (কেউ কেউ) বেসিনের উপর পা তুলে দিয়ে। তখনো তাঁদেরকে পেছন থেকে অন্যের তাগিদ সয়ে যেতে হয়। অজু শেষে নামাজ পড়বেন কোখায়? এক কোণায় নামাজের জন্য ছোটোখাটো একটি কক্ষ থাকলেও আগে যারা নামাজ পড়েছেন তাঁদের কেউ কেউ আবার গা এলিয়ে দিয়েছেন এখানে ওখানে। নামাজের জায়গা কমে গেছে। কিছু মানুষকে দেখা গেলো যে জায়গা দিয়ে যাত্রীদের আসা যাওয়া করার কথা সেখানেও তাঁরা নামাজ পড়তে বসে গেছেন ময়লাযুক্ত খালি ফ্লোরের উপর। যাত্রীদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, ফিলিপিনস, ইণ্ডিয়া, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে ওমরাহ করতে আসার মানুষের সংখ্যাও এখানে প্রচুর। বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা হতে থাকলো। গভীর রাতের ৬ ঘণ্টাব্যাপী ট্রানজিট শেষে করে ১৬ নভেম্বর ভোর সোয়া ৩টায় আবার ঢাকার পথে বিমান ধরার জন্য বাসে উঠতে হলো। এবারে সিঁড়ি দিয়ে নামা নয়; সিঁড়ি বেয়ে বিমানে উঠা! মোমিন সাহেবের দেয়া হুইলচেয়ার দেয়ার বিশেষ সুবিধাটি অধরাই রয়ে গেলো!
আর পড়ুনঃ ভয়াবহ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ ঃ প্রথম পর্ব
ঢাকায় পৌঁছলাম ৬ ঘণ্টা পর ১৬ নভেম্বর অপরাহ্নে। এরপরের সময়গুলি দ্রুত কাটলো। আগের মতো এবারেও অধিকাংশ সময় জ্বর নিয়ে কাটালাম – বিছানায় শুয়ে থাকলাম দিনের পর দিন। আগে তৈরি করা সময়সুচী আর ঠিক রাখা গেলো না। এর মাঝেও যতোটা সম্ভব কাজে যুক্ত থাকলে হলো। কারণ, আমি জানতাম এবার কাজ শেষ না করতে পারলে আর কখনোই তা করা যাবে না। —– চলবে।
লেখকঃ সভাপতি ভিএজি,বি, মন্ট্রিয়ল, কানাডা
23 Dec/2019