পূর্ব প্রকাশের পর…
মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১, শৈশবের চোখে দেখা দিনগুলো |||| সদেরা সুজন || পর্ব ২
বলছিলাম ১৯৭১ সালের কথা! সত্যি কথা বলতে কি তখনো সঠিকভাবে বুঝতে পারিনি সেটা কিসের যুদ্ধ কিংবা কা’র সাথে যুদ্ধ? ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান আর শেখ মুজিবের নাম তখন শুনেনি এমন শিশু খুব কমই পাওয়া যাবে। সেই সময়ের কয়েকটি গান আজো ভুলতে পারছি না, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাউল শিল্পী সন্ধীপের মো. শাহ বাঙালির কন্ঠে গাওয়া গানটি শহর-বন্দর গ্রাম গ্রামান্তরে বিশেষ করে রাখালের কন্ঠে মেঠোপথে গরুর পাল নিয়ে যেতে যেতে সেই আবেগ আর প্রাণের ছোঁয়া গানের কলি মুখরিত হয়েছে ‘মুজিব বাইয়া যাওরে/ নির্যাতিত দেশের মাঝে/ জনগণের নাও ওরে মুজিব/ বাইয়া যাওরে কিংবা মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি/ মোরা একটি হাসির জন্য অস্ত্র ধরি…।
একাত্তরে আমরা খেলার ছলে কতো হাজারবার যে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়েছি তার কোন হিসেব নেই। গ্রামের ১০/১২ জন শিশুকে নিয়ে আমরা মিছিল করতাম বড়দের মতো ‘জ..য় বা..ং..লা’ ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ ‘ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ভূট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ বলে। এসব শ্লোগানের কোনো মানেই বুঝতাম না, কিন্তু দিতে ভালো লাগতো। এসব শ্লোগানের শিক্ষক ছিলেন আমার বড় ভাই বাবুল। তিনি গ্রামের সব শিশু আর আমাদের সব ভাই-বোনদেরকে লজেন্স দিয়ে এসব শ্লোগান শিখাতেন। পুরানো সবুজ কাপড়ের মধ্যে লাল রংগের কাপড় গোল করে কেটে সুঁচ দিয়ে সেলাই করে লাল কাপড়ের মধ্যে কাঁচা হলুদ দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র এঁকে পতাকা বানাতাম আর সেই পতাকা বাঁশের সিংলার (কঞ্চি) মধ্যে সেফটিপিন দিয়ে গেঁথে আমরা মিছিল করতাম আকাশপানে হাত তুলে ‘জ য় বা ং লা’ বলে। এই মিছিলের কারণ কি তাও সঠিকভাবে বুঝতাম না। বাংলাদেশের নতুন পতাকা আমাদের বাড়িতে ছিল। আমার বড় ভাই শ্রীমঙ্গল কলেজ ছাত্রলীগ এর নেতা ছিলেন। শ্রীমঙ্গল যে বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন সেই বাড়ির মালিক ছিলে দর্জি পেশায় কাজ করতেন এবং তিনিই বানিয়ে দিয়েছিলেন এই পতাকাটি এবং যুদ্ধ শুরুর পূর্বে বাড়িতে এসেছিলেন আর যাওয়া হয়নি ফলে পতাকাটি সাইকেলের সামনে লাগিয়ে বিভিন্ন জায়গা ঘুরতেন কখনোবা মুলি বাঁশের উপরে লাগিয়ে বাড়ির সামনে রেখে দিতেন, আর বাতাসে তা ফৎফৎ করে উড়তো তা আমরা মুগ্ধ হয়ে তন্ময়ে চেয়ে থাকতাম। ভাবতাম কী সুন্দর পতাকাটি, এ নিয়ে গ্রামের মানুষের যে কত কথা শুনতে হয়েছে। অবশ্য এটার কারণ গ্রামের মানুষ ছিলো ভয়ে ভীত। আমাদের বাড়ির পাশ্বেই ছিলো রেল লাইন, সেখানে দেখেছি ছোট বড় ব্রিজের মধ্যে রাজাকারদের টহল, পথচারীদেরকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্নবান আর তল্লাশি আবার কোন কোন সময় নির্যাতনও করতে দেখা যেত, তবে নির্যাতনের শিকার হতো হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বেশী। রাতে টচ্ লাইটের আলো আমাদের বাড়িতে এসে পড়লেই সবাই ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো, এই বুঝি কিছু ঘটে যাচ্ছে। কখনো কখনো গুলির শব্দ শোনা যেত ফলে সন্ধ্যা হবার সঙ্গে সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘরের সমস্ত হারিকেন নিভু নিভু করে নিঃশব্দে আতঙ্কে থাকতে হতো কোন সময় না-কি কি হয়ে যায়। রাতে গুলির শব্দে আতঙ্কে থর থর করে কাঁপতাম। গ্রামের বড়রা মাঝে মধ্যে খুব নীচু গলায় বাবাকে ডাকতে শুনেছি, বাবাও পরিচিত গলা বুঝলে দরোজা খুলে দিতেন এবং একসঙ্গে তখন তাঁরা খুবই কম সাউন্ডে বিবিসি শোনতেন।
ডএদিকে আমাদের এলাকার সর্বত্র পাক জানোয়াররা সাঁজোয়া বহর নিয়ে প্রদক্ষিণ করছে, স্থানীয় রাজাকার আলবদর আর আলশামস বাহিনীর হায়েনারা প্রতিটি গ্রাম চষে বেড়াচ্ছে, প্রতিদিনই কোন না কোন গ্রামের মানুষকে পাক জানোয়াররা হত্যা করছে, এলাকার সর্বত্র পাকি সৈনিক আর রাজাকারদের বর্বরতার সংবাদ পাওয়া যেত ফলে গ্রামের মানুষ সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে বিশেষ করে ভারতের দিকে চলে যাচ্ছে জীবন বাঁচাতে। আমাদের গ্রামেরও প্রায় সবাই ভারতে চলে যায় একমাত্র আমরা আর পাশের বাড়ীর দু’টি পরিবার ছাড়া। কিন্তু না, বেশীদিন থাকা সম্ভব হয়নি ২/৩ দিন পরই আমাদের আত্মীয় জ্যাটামহাশয় শ্রীনাথপুরের নীরোদ বাবু আমাদের বাড়ি থেকে তাঁর নিজ বাড়িতে ফেরার পথে স্থানীয় কুখ্যাত রাজাকারের সহযোগিতায় পাকি সৈনিকরা হত্যা করে শমসের নগর-ভানুগাছ সড়কের জালালিয়া গ্রামের পাশের রাস্তায় ফেলে রাখে, ফলে বাবা আর স্থির থাকতে পারেননি। সেই রাতগভীরে শত বর্ষের স্মৃতিঘেরা বাড়ির সব কিছু ফেলেই ভারতের উদ্দেশ্যে ঠিকানাবিহীন গন্তব্যে আমরা রওয়ানা হই। কষ্ট-বেদনাকে নিত্যসঙ্গী করেই উদ্বাস্তু জীবনের যাত্রা শুরু হয়। বাড়িতে শুধু বাবা আর ঠাকুরমা রয়ে যান। অন্ধাকারাচ্ছন রাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর শিয়ালের ডাক শোনে শোনে আমরা সবাই ধানক্ষেতের সরু আইল ধরে পিপিলিকার মত চা বাগানের আঁকা বাঁকা উচু নিচু সরু পথে নীরবে প্রায় ৮/১০ ঘন্টা হেঁটে ভারতে পৌঁছি।
আমাদের সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছিলো আমাদের পালিত কুকুর। কুকুরটির নাম ছিল টমটম। পথে ঘাটে ঘাটে কত ভয় আর শংকা নিয়ে যেতে হয়েছে। পাহাড় আর ছোট ছোট টিলার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে গভীর অন্ধকার রাতে শরীর শির শির করছিল ভয়ে আর আতঙ্কে। আমার কাছে তখন যুদ্ধের ভয়ের চেয়ে বেশি ভয় ছিলো ভূত-পেত্নী-দৈত্য-দানব- বিষধর সাপ আর শিয়ালের। সম্পূর্ণ পরিবেশটা আমার কাছে ছিলো ভৌতিক। একটি শব্দ হলেই শিউরে উঠতাম আর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের সঙ্গী শিশির কাকাকে জড়িয়ে ধরতাম। আমাদের দলে মোট ২৫/৩০ জন পুরুষ মহিলা আর শিশু কিশোর ছিলো। লাইনের সামনে ও পিছনে ছিলো টর্স লাইট হাতে পুরুষরা আর মধ্যখানে সব নারী আর শিশুরা। ছোট বড় সবার হাতেই ব্যাগ নতুবা পুটলী ছিলো যার মধ্যে সামান্য খাদ্য চিঁড়া-মুরি কিংবা কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কাপড়-চোপড়। দীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে আমরা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যখন ভারতের সীমান্ত নদীটি পেরিয়ে কৈলাশহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই তখন সূর্যের উদ্ভাসিত আলোয় পৃথিবী আলোকিত করেছে। আমাদেরকে ভারতে পৌঁছে দিয়ে আমাদের কুকুর ‘টমটম’টি আবার বাড়িতে ফিরে আসে, বাবা আর ঠাকুরমা তখনো বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। চলবে…
সদেরা সুজনঃ প্রধান নির্বাহী, কানাডা-বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি সিবিএনএ, কানাডা
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন