পরিণতি |||| আকতার হোসেন
ঘরে ঘরে মুখরোচক আলোচনা চলছে এই বলে যে জমিদার কন্যার অজানা এক রোগ হয়েছে। সে সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিন কাটায়। জমিদার কন্যার জন্য প্রতিদিন পথ্য নিয়ে আসে কবিরাজ মশাই। বহুদিন হয়ে গেল তবুও কবিরাজের পথ্য খেয়ে জমিদার কন্যার কোন উন্নতি হচ্ছে না। অথচ এই কবিরাজের পথ্য নিতে দূরদূরান্ত থেকে লোক আসে।
একবার কবিরাজ মশাইকে কিছুদিনের জন্য বাইরে যেত হলো। সে তার ছেলেকে বলে গেল কিভাবে কি দিয়ে পথ্য বানাতে হবে। ছেলেটি ছিল ভবঘুরে এবং কাজে অমনোযোগী। তবুও বাবার কথা মত বাগবাগিচা থেকে ঔষধি লতাপাতা নিয়ে এলো। পথের মাঝে সে একটি অচেনা ফুল দেখতে পেলো। ফুলটির মিষ্টি ঘ্রাণ তার খুব ভালো লেগে যায় তাই সে সেটা তুলে নিয়ে এলো। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার মনে হলো ধুত্তোরই ছাই, এভাবে ফুল হাতে নিয়ে কেউ হাঁটে নাকি। সে ফুলটি পকেটে লুকিয়ে রাখল।
জমিদার কন্যার জন্য বাড়ির লোকজন এখন তেমন ছুটাছুটি করে না। যতটুকু সেবা যত্ন হয় তা জমিদারের ভয়ে। শত হলেও একমাত্র মেয়ে তার। অসুস্থ হয়ে ঘর বন্দী হলে কী হবে, একদিন জমিদারের সব বিষয় সম্পত্তির মালিক হবে সে। তাই সামনাসামনি কেউ অবহেলাও করে না।
ছেলেটি এই প্রথম জমিদার বাড়ির ভেতরে এলো। কাজের মানুষগুলোর হাতের ইশারায় এদিক ওদিক করে শেষমেশ জমিদার কন্যার ঘরের নিকট এসে দাঁড়ালো। এ অব্দি আসতে তাকে শুধু একটি প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল। সে বলেছে বাবা এক মাসের জন্য দূর দেশে গেছে। এখন থেকে প্রতিদিন আমিই পথ্য নিয়ে আসবো।
যুবকটি বেশ লম্বা এবং ওর মাথার চুলও বেশ লম্বা। সারাদিন সূর্যের নিচে ঘোরাঘুরি করে তাই চুলের রঙ সামান্য তামাটে এবং আধা কোঁকড়ানো। হাসলে হয়তো দুই গালে টোল পড়তো কিন্তু এখন হাসছে না তাই টোলের বদলে টোল ছায়া পড়ে আছে।
ঘরে ঢুকতেই জমিদার কন্যা ছেলেটিকে চুল ঠিক করতে বললো। তা না হলে ওর হাতের পথ্য সে নেবে না বলে দিলো। সাথে এও বললো, এমন এলোমেলো চুল নিয়ে কি কেউ কারো সামনে আসে?
কবিরাজ পুত্র জীবনে অনেক বকুনি খেয়েছে কিন্তু এমন মিষ্টি শাসন এই প্রথম। হাতের আঙ্গুল দিয়ে সে এলোমেলো চুল সরিয়ে দিল। এরপর জমিদার কন্যার কাছে পথ্য নিয়ে এসে দাঁড়াতেই জমিদার কন্যা তার দাসীকে বললো, হে রে বিন্দুবালা ঘরে মধ্যে এত সুবাস এলো কোত্থেকে? বিন্দুবালা কোন জবাব দিতে পারলো না। জমিদার কন্যা বারবার সুঘ্রাণের কথাই বলতে থাকল। ছেলেটির হঠাৎ সন্দেহ হলো তার পকেটের ফুল নয় তো?
ছেলেটি আবারো পথ্য বানাল। পরেরদিন আরেকটি নতুন ফুল দেখতে পেলো এবং সেটাকেও সে তুলে নিলো। কিছু একটা পরীক্ষা করতে ফুলটি ইচ্ছে করে পকেটে পুরে নিলো। আবারো সেই একই প্রশ্ন। কবিরাজ পুত্র ঘরে এলেই এত ঘ্রাণ আসে কেন! কবিরাজ পুত্রের সন্দেহ দূর হলো। সে নিশ্চিত হলো জমিদার কন্যা তার ফুলের ঘ্রাণ খুব পছন্দ করেছে। কিন্তু আজও সে ফুলটি সম্পর্কে কাউকে কিছু বললো না। বাড়ি ফেরার পথে গতকালের মত দলে মুচরে যাওয়া ফুল দীঘিতে ফেলে দিল। আজও সামান্য বুদবুদি ছড়িয়ে নাম না জানা ফুল চোখের পলকে ডুবে গেল দীঘির ভেতর।
এভাবে মাস শেষ হয়ে যেতে লাগল। জমিদার কন্যা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। কবিরাজ এক বছরেও যা করতে পারেনি তার পুত্র এক মাসে সেটা কী করে করলো? ব্যাপারটা নিয়ে ছেলেটিও খুব ভেবেছে। বাবা ওকে যা যা বলেছে তা মিশিয়েই পথ্য বানিয়েছে। তবে সবকিছুর পরিমাণ একটু বেশি বেশি দিয়েছে। ছেলেটি ভাবল ওর বাবা তাহলে রোগ পুষে রেখেছিল! যে বাবাকে এত সৎ জানতো সে কিনা রোগীর সাথে প্রতারণা করেছে। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরার পথে পকেট থেকে যখন ফুল বের করলো তখন দেখতে পেল দীঘির কাছে দু-চারজন লোক নিচু হয়ে কি যেন শুঁকছে। তাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে সে ফুলটি ফেলে দিল। এবারও সামান্য বুদবুদি ছড়িয়ে নিমিষেই দীঘির অতলে ডুবে গেল একটি সাদা ফুল।
আর মাত্র তিনদিন গেলেই হবে। এর মধ্যে ওর বাবা চলে আসবে। কিন্তু ছেলেটি মনে মনে চাইছে ওর বাবা যেন সময় মত ফিরে না আসে। মেয়েটিও যখন বুঝতে পারলো তিনদিন পর ছেলেটি আর আসবে না তখন সে আগের ন্যায় অসুস্থ হবার ভাব করতে লাগলো। এদিকে হয়েছে আরেক মহা কাণ্ড। দীঘিটি ঘিরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা দীঘির পানি থেকে মন মাতানো একটি ঘ্রাণ পাচ্ছে। ছেলেটি দেখল আসলেও ব্যাপারটা সত্যি। কিন্তু সে অতিরিক্ত কোন কৌতূহল দেখল না। টুপুস করে ফুলটি ফেলে দিয়ে চলে এলো।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে কবিরাজ পুত্র তো অবাক। দীঘির পাড়ে প্রচুর লোকের ভিড়। কেউ কেউ দীঘির পানি বাটিতে ভরে নিচ্ছে। কেউ আবার দু’এক আঁজলা পানি দিয়ে কোলের শিশুর মাথা ধুয়ে দিচ্ছে। ছেলেটি এর কোন গূঢ় রহস্য খুঁজে পেল না। যে ফুল কেউ চেনে না, যে ফুল প্রতিদিন একটি করে ফোটে। সে ফুল কী করে এমন কাণ্ড করতে পারে?
যাইহোক পরের দিন মানুষের ভিড় আরও বেড়ে গেল। ভিড় ঠেকাতে কিছু স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে। জমিদার বাড়ির যাবার পথে সে দেখতে পেলো জমিদার বাবু লোকজন নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে দীঘির দিকে আসছেন। ছেলেটি চলে গেল তার নিত্যদিনের কাজ সম্পূর্ণ করতে। আজ সমাপ্তি দিন।
জমিদার কন্যা মস্ত বড় একটা খোপা করে বসে আছে। সুন্দর করে সাজ করেছে। কানে দুল, গলায় হীরের মালা। পায়ে জরির জুতো। বিন্দু বালা সিঁড়ির নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল সে আজ ছেলেটির সাথে সাথে উপরে উঠে এলো না। একবার জিজ্ঞেস করেছিল তুমি যাবে না? বিন্দু বালা মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিলো।
ছেলেটি জমিদার কন্যার ঘরে ঠুকতেই জমিদার কন্যা তার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। ছেলেটি বললো, বাড়িতে কেউ নেই তাই এতো সাহস। তবুও লোকে দেখলে দুর্নাম দেবে। আমাকে না, তোমাকে। মেয়েটি বললো চুপ কর তো। এদিকে এসো। এরপর সে ছেলেটির হাত ধরে জানালার কাছে নিয়ে গেল।
খোলা জানালার ভেতর দিয়ে হাত উঁচু করে জমিদার কন্যা বললো, ওই যে দুটো পাখি গাছের ওপর বসে আছে ওগুলো কে জানো? ছেলেটি বিন্দু বালার মতো মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিল। জমিদার কন্যা বললো, ওইটা তুমি পাখি আর পাশেরটি আমি পাখি। ছেলেটি কিছুই বুঝল না। জমিদার কন্যা এবার হাত উঁচু করে দান চাওয়ার মতো করে বললো ফুলটি দাও। ছেলেটি অবাক হয়ে গেল। ওর গলা শুকিয়ে এলো। যে ফুলের কথা সে কোনদিন জমিদার কন্যাকে বলে নি সে ফুলের কথা ও জানলো কী করে। এদিকে জমিদার কন্যার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে বললো কি হলো দাও। দুহাত দিয়ে চোখের জল মুছে বললো, ভাবছ আমি জানলাম কি করে? এরপর মুখটা কৌতূহলী করে বললো, নাহ বলবো না। তবে তুমি কি আমাকে বলবে, তুমি কী করে জানলে আমার কোন অসুখ ছিল না?
ছেলেটি মুগ্ধতা নিয়ে জমিদার কন্যাকে দেখছে। আজকের পর এ বাড়িতে তার আর আসা হবে না। প্রথম দিন থেকে জমিদার কন্যার আপন করে নেবার সমস্ত কথা তার মনে হতে লাগল। জমিদার কন্যা কতক্ষণ চুপ করে থেকে কোন উত্তর না পেয়ে বললো, থাক তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। সব সময় সব কথা বলতে হয় না। তবে একটি কথা জেনে রেখো, জলের আর্দ্রতা না পেলে ফুলের কোন আনন্দ নেই। মানুষ আর ফুলের মধ্যে এই একটাই মিল।
এরপর উভয়েই পুনরায় জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। ছেলেটি হলুদ পাখির দিকে চেয়ে থেকে জমিদার কন্যার সাথে একটি সাদৃশ্য খুঁজে পেলো। বিশাল আকাশ ছেড়ে গাছের ছোট্ট ডালের উপর সে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। হোক ছোট তবুও এটাই পাখিটির অভয়ারণ্য।
জমিদার কন্যা নীরবতা ভেঙ্গে বললো, এসো পাখি দুটোকে আমরা বিদায় বলে দেই। প্রথমে তুমি, আমি পাখিটাকে চলে যেত বলো। ছেলেটি গলা চড়িয়ে বললো, নন্দিতা চৌধুরী তুমি যেয়ো না। মেয়েটি বললো, শ্রীকান্ত – তুমিও যেওনা।
লেখকঃ গল্পকার ও কথা সাহিত্যিক। টরন্টো, কানাডা।