বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ, প্রসঙ্গ:বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য |||| সৈয়দ মাসুম
গুহাবাসী মানুষ তাদের জীবনমানের বিভিন্নমুখী বিবর্তনের মাধ্যমে যেমন আজকের অবস্থানে এসে পৌছেছে ঠিক তদ্রূপ তাদের মুখের ভাষাও বিবর্তিত হয়েছে। সভ্যতার আদিতে আকার ও ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করলেও(অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্নমতও আছে ) এক পর্যায়ে এসে এই আকার,ইঙ্গিত ও দুর্ভেদ্য বুলির সময় অতিক্রম করে মানুষ সৃষ্টি করে সকলের নিকট গ্রহনযোগ্য ও সহজবোধ্য শব্দ সম্ভার। এই গ্রহনযোগ্য শব্দ সম্ভারের প্রকাশরূপটি হচ্ছে ভাষা।
ভাষা ও সাহিত্য দুটি ভিন্ন বিষয় যদিও একটি অন্যটির পরিপূরক। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন সপ্তম শতাব্দীর চর্যাপদকে ধরা হলে এই ভাষার সাহিত্য ইতিহাস এখনও দেড় হাজার বছর হয়নি। তবে সাহিত্যপূর্ব বাংলাভাষার বিকাশ ও বিস্তারের ইতিহাস অনেক পুরনো।
বাংলা ভাষার উত্পত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে আমাদের চলে যেথে হবে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০অব্দে অর্থাৎ ৭০০০বছর পূর্বে। সেই সময়ে সকল মানুষের নিকট সহজবোধ্য শব্দ সমন্বয়ে ইন্দো -ইউরোপীয় ভাষার সৃষ্টি। যে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করত একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষ। যে অঞ্চল থেকে মানুষের বিস্তৃতি ঘটে এশিয়া ইউরোপ ও ভারতে। জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ক্রমান্বয়ে মানুষ বিশ্বের দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ায় পরবর্তী দেড় হাজার বছরের মধ্যে এই ভাষা দুটি ভিন্ন রূপ লাভ করে,এর একটি শতম আরেকটি কেস্তম। কেস্তম ভাষাভাষীরা পশ্চিমমুখী আর শতমরা হয় পূর্বমুখী।
ইংলিশ ,ইতালীয়,জার্মান ও স্পেনিশ ভাষা হচ্ছে বিবর্তিত কেস্তম ভাষার বর্তমান রূপ।
বাংলার যোগসুত্র শতমের সাথে। সময়ের পরিক্রমায় ১০০০বছরের মধ্যে অর্থাত ৪৫০০বছর আগে শতম চার ভাগে বিভক্ত হয়। ইরান ,আফগানিস্তান ,তুর্কি অঞ্চলের আর্যগন ভারতে প্রবেশ করে ইন্দো আর্য ভাষার প্রচলন ঘটায়। ভারতীয় কথ্যভাষা ও ইন্দো আর্য ভাষার সমন্বয়ে প্রাচীন ভারতীয় ভাষার জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০সালে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সালে এসে আমাদের নিকট প্রাচীন ভারতীয় ভাষার আবার দুটিরূপ পরিলক্ষিত হয়।
১)বৈদিক /সংস্কৃত
২)প্রাচীন প্রাচ্য ভারতীয় আর্য
বৈদিক ভাষায় মূলত বেদ ,উপনিষদ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থাদি রচিত হয়। বৈদিক ভাষা ব্যবহারে ধর্মীয় বিধিনিষেধ থাকায় দ্বিতীয়রূপটি সাধারনের কথ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
পরবর্তী ২০০বছরের মধ্যে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০অব্দে প্রাচীন প্রাচ্য ভারতীয় আর্য ভাষার তিনটি রূপ দেখা যায় ,যার একটি হচ্ছে প্রাচীন প্রাচ্য। যেটাকে প্রাকৃত ভাষার ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। এটি নিখাদ মুখের ভাষা। কথ্য ভাষার নানামুখী বিবর্তনের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি অপভ্রংশের সৃষ্টি হয়। এইরূপ কোন একটি অপভ্রংশ থেকেই উত্পত্তি বাংলা ভাষার।
উম্মেষ ঘটে বাঙালী জাতি গুষ্টির। আর্য জাতির এতদ অঞ্চলে আগমন ও স্থায়ী বসতি স্থাপন জনিত কারণে আর্য ও অনার্য সম্মিলন হয়। বাংলা ভাষার মূল উত্পত্তি মূলত অনার্যদের হাতে। আর্যদের নিকট অনার্যরা ছিল নমশুদ্র শ্রেণীভুক্ত। এরা আর্যদের নিকট অসভ্য বলে বিবেচিত হত। বৈদিক গ্রন্থাদিতে অনার্যদের অস্পৃশ্য বলে উল্লেখ আছে।
ওই সময়ে আর্য ও অনার্য সমন্বয়ে গঠিত বাঙালী সমাজ ছিল স্পষ্টত দুইভাগে বিভক্ত।
১)উচ্চ বংশীয় বা আর্য জাতিগোষ্টি
২)নমশুদ্র বা অনার্য জাতি গোষ্টি।
সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি নীতি জনিত কারনে উভয় সম্প্রদায়ের দেহজ সমন্বয় না ঘটলেও আত্মজ সম্পর্ক ঘটে ভাষায়।
বাংলা সাহিত্যের সুচনাপর্ব শুরু হয় আর্য ও অনার্য সমন্বয়ের পর। ফলে বৈদিক সাহিত্যের ব্যপক প্রভাব বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন সমূহে দেখতে পাওয়া যায়।
১৯০৭সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে একটি পুঁথির খন্ডিত অংশ উদ্ধার করেন। আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষনের মাধ্যমে বাংলার সাথে এর যুগসুত্র খুঁজে পান।
প্রাপ্ত এই পুঁথির রচনাকাল নিয়ে উভয় তাত্ত্বিকের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। সুনীতি কুমার এই আদি নিদর্শনের রচনাকাল খ্রিষ্টিয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মনে করেন। আবার শহীদুল্লাহ এর রচনা শুরু ৬৫০সালে অর্থাৎ রচনা কালের ব্যপ্তি সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে উল্লেখ করেন।
নেপালের রাজদরবারে প্রাপ্ত এই পুঁথি আমাদের নিকট চর্যাপদ নামে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসাবে এই চর্যাপদকেই বিশ্লেষকেরা মনে করে থাকেন।
দ্বাদশ শতাব্দীর পরবর্তীকাল অর্থাৎ দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালকে আমরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যযুগ বলে বিবেচনা করে থাকি। ১২০১সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয় বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশমান ধারাকে অনেকটা স্তিমিত করে দেয়। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারন এই বন্ধ সময়ের জন্য দায়ী বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। আবার অনেক ঐতিহাসিকেরা ১২০১ থেকে ১৩৫০সালের এই সময়টাকে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলেও উল্লেখ করেছেন।
মধ্যযুগের প্রথমার্ধে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের ব্যাপক ব্যবহার ঘটে। চৈতন্য দেবের আবির্ভাব বাংলা ভাষায় নতুন ধারার সৃষ্টি করে। উদ্ভব হয় জীবনী সাহিত্যের। কাব্যের ভাষায় উন্নীত হয় ‘ শ্রী কৃষ্ণকীর্তন ‘। রচিত হয় মঙ্গল কাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলী।
মধ্যযুগের দ্বিতীয়ার্ধে এসে বঙ্গীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে মুসলিম একাধিপত্য দেখা যায়। আর্য আগমনের ন্যায় ইরান ,আফগানিস্তান ,মধ্যপ্রাচ্য ও তুর্কি থেকে ব্যাপকভাবে মুসলিম আগমন ঘটে এতদঅঞ্চলে। আরবি,ফার্সি ও তুর্কি শব্দ বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তুলে।মার্জিত রূপ লাভ করে বাংলা ভাষা। অনুবাদ সাহিত্য এ সময় ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।
সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে মুসলিম শায়েরগণ রচনা করেন ভিন্ন আঙ্গিকের মহাকাব্য। বৈচিত্রময় এই সব মহাকাব্য সাধারণের নিকট ‘পুঁথি সাহিত্য’ নামে পরিচিত ছিল।
কারবালার বেদনাদায়ক ঘটনার উপর লিখিত ‘মর্সিয়া সাহিত্য’ওএই যুগে রচিত হয়।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্য ছিল ব্যক্তি কেন্দ্রিক। রাজা মহারাজাদের স্তূতি ও অর্চনাই ছিল এর বৈশিষ্ট। মধ্যযুগে এসে এটি ধর্ম ,বিশ্বাস ও লৌকিকতা কেন্দ্রিক হয়ে উঠে। বাংলায় ইংরেজ আগমন ,ইংরেজ শাসন প্রতিষ্টা ও ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তন বাঙালী জনসমাজকে সমাজ ও সময়ের প্রয়োজনে জীবনমুখী করে তুলে। চিন্তা ও চেতনায় ঘটে আমূল পরিবর্তন। কবি সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের কর্ম পরিধিরও ঘটে বিস্তৃতি। মানবিকতা ,ব্যক্তি চেতনা ,সমাজ চেতনা ,জাতীয়তাবোধ ,গণ অধিকার ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা এই সকল বৈশিষ্টের স্বতন্ত্র গৌরব নিয়ে শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের আরও একটি অধ্যায়,আমরা যাকে আধুনিক যুগ বলে থাকি।অবশ্য মধ্যযুগের শেষ ও আধুনিক যুগের শুরুর সময়টাকে অর্থাৎ ১৭৬১ থেকে ১৮৬০সালের এই সময়টাকে বাংলা সাহিত্যের যুগসন্ধিক্ষন বলেছেন অনেক বিশ্লেষক। এই যুগের প্রধান কবি হচ্ছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। মধ্যযুগ ও আধুনিকযুগ উভয় ধ্যান ধারনার সমন্বয় দেখতে পাওয়া যায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায়।
আধুনিক যুগপূর্ব বাংলা ভাষায় আমরা সাহিত্যগুন সম্পন্ন কোন গদ্য সাহিত্যের অস্তিত্ব দেখতে পাই না। যদিও বাঙালীর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ কর্মে কথ্য ভাষার ব্যবহার ছিল গদ্যাকৃতি। কাব্য ব্যতীত ভাষার লিখিত রূপ দলিল দস্তাবেজ ,চিঠিপত্র ,বংশ তালিকা ও খ্রিষ্টান মিশনারী কর্তৃক রচিত ধর্মবিষয়ক গ্রন্থের সঙ্কীর্ণ সীমার মধ্যে আবদ্ধ ছিল।
১৮০০সালে প্রতিষ্টিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ১৮০১সালে এই কলেজে বাংলা বিভাগ খোলার প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে এক যুগান্তকারী সময় সূচিত হয়।
শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাশাপাশি রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশ লাভ করে।
ক্রমান্বয়ে গদ্য নির্ভর সাহিত্য গল্প ,উপন্যাস ,প্রবন্ধ ,নাটক ও প্রহসন বাংলা ভাষাকে বিচিত্র থেকে করে তুলে বৈচিত্রময়।
১৮০১থেকে ১৮৬০সালে বাংলা আধুনিক সাহিত্য ধারা হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে চলে। ১৮৫৭সালের পর এর গতি তীব্রতা পায়। আমরা পূর্বোক্ত সময়টাকে আধুনিক সাহিত্যের উম্মেষ পর্ব হিসাবে ধরে নিলে ১৮৬০ পরবর্তী সময়টাকে বিকাশ পর্ব বলে আখ্যায়িত করতে পারি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ,বঙ্কিমচন্দ্র,বিহারীলাল চক্রবর্তী কিংবা শরৎচন্দ্র কে বিকাশ পর্বের সূচনায় অন্যতম প্রতিভা ধরা যায়।
বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে পৌছে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৩সালে এশিয়দের মধ্যে সাহিত্যে সর্বপ্রথম নোবেল পুরুস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে তিনি জানিয়ে দেন বাংলা শুধুমাত্র একটি ভাষাই নয়,এই ভাষার সাহিত্য ও সাহিত্যিকেরা বিশ্বে বড় বড় প্রতিভাধারীদের সমকক্ষতা অর্জনেও সক্ষম। ১৮৬১থেকে ১৯৪১ এই সময় বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠে রবীন্দ্র প্রতিভায় উজ্জ্বল। এই সময়টাকে বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রযুগ বলা হয় । রবীন্দ্র যুগে জন্ম নিয়ে অনেকেই রবীন্দ্র নাথকে অনুস্মরণ করেছেন আবার জীবনান্দ দাশ,দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের ন্যায় অনেকেই স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেছেন।
সার্বিক বিবেচনায় আধুনিক সাহিত্যের বিকাশ পর্বকে তিনটি সময় পর্বে ভাগ করা যায়।
১)রবীন্দ্র পূর্ব সময় পর্ব
২)রবীন্দ্র সময় পর্ব এবং
৩)রবীন্দ্রোত্তর সময় পর্ব।
রবীন্দ্রোত্তর সময়ে এসে বাংলা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ঢাকা ও কলকাতা কেন্দ্রিক দুটি ভিন্ন ধারার বাংলা সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চায় নতুন মাত্রা যুগ করে ১৯৫২সালের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন। ১৯৭১সালে বাংলা ভাষাভাষীদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্টা এই মাত্রাকে স্থিতি দেয়। বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে এসে ইউনেস্কো কর্তৃক বাঙালীর ভাষা আন্দোলনের তারিখ ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত বাংলা ভাষা ,বাংলা সাহিত্য ও বাঙালীকে বিশ্বসভায় স্থায়ী আসনে করে অধিষ্টিত ।বাংলা এখন শুধু বাঙালীর নয়। বিশ্বের অন্যতম একটি সমাদৃত ও স্বীকৃত ভাষা।
বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ, প্রসঙ্গ:বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য |||| সৈয়দ মাসুম , সাবেক বিভাগীয় প্রধান,অর্থনীতি বিভাগ,ইয়াকুব তাজুল মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, কুলাউড়া,মৌলভীবাজার। যুক্তরাজ্য প্রবাসী কবি, লেখক,গবেষক, ফ্রিলেন্স সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা মেইলের লিটারেরি এডিটর।