অগ্নিঝরা মার্চ বাংলার আকাশে মানচিত্রখচিত পতাকা
একটি পতাকা অর্জনের জন্যই যুগে যুগে এত সংগ্রাম, আন্দোলন, আত্মদান। জাতীয় পতাকা একটি জাতিরাষ্ট্রের মুক্তি এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক। আজ ২ মার্চ জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিবস।
পাকিস্তান উপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত প্রথম জাতীয় পতাকা প্রথমবারের মতো উত্তোলন করা হয়।
সেখানে জনসমুদ্রের মধ্যে লাল, সবুজ, সোনালি-তিন রঙের পতাকাটি সেই যে বাংলার আকাশে উড়লো, তা আর কখনোই নামাতে পারেনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও সরকার। এদিনের ঢাকা ছিল হরতাল, মিছিল আর কারফিউর নগরী।
মার্চে বাংলার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হতো স্লোগানে স্লোগানে। ‘জয় বাংলা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা? ঢাকা ঢাকা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ তখন ছিল মুখে মুখে। এদিকে নানা জায়গায় শুরু হয় পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো। আর এই সময়টাকেই ছাত্রনেতারা বেছে নিলেন বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকে স্বাধীনতাসংগ্রামে পরিপূর্ণভাবে রূপান্তর করার মোক্ষম মুহূর্ত হিসাবে।
আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গোপনে একটি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠন করেছিলেন এই ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। এই কাজটি তারা করেছিলেন ১৯৬৯ সালে ১১ দফা আন্দোলন চলার সময়। এই বিপ্লবী পরিষদের সদস্যদের ভাবনায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশা ছিল।
১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ পাকিস্তানিদের বিশ্বাসঘাতক চেহারা আবারও উন্মোচিত হয় বাংলার মানুষের সামনে। এর প্রতিবাদে ছাত্রনেতারাও তার জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক জনসভা আহ্বান করা হয় ২ মার্চ। সেই বিশাল সভায় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি আ স ম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
এ প্রসঙ্গে নূরে আলম সিদ্দিকী তার ‘পহেলা থেকে ২৫ মার্চ’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক লেখায় বলেছেন, ‘২৫ মার্চের পর কিছু নেতা এবং উপনেতা আমাদের ওপর রুষ্ট হয়ে দীর্ঘ ন’মাস প্রচার করেছেন যে, আমরা ভাবাবেগে বা উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে স্বাধীনতার পতাকা তুলে নেতার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছি। আজ তারা বাস্তবতাকে আঁচ করতে পেরেছেন বলেই আমার মনে হয়। এই বেচারারা বড় অসহায়। এরা নেতাকে (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) উপলব্ধি করতে পারতেন না।
এদের দোষ নেই। সেদিন পল্টনে আসবার আগে নেতা আমাকে কি বলেছিলেন, আমাদের ওপর নেতার সার্বিক কি নির্দেশ ছিল-ওদের তা জানার কথা ছিল না। তবু এই অপপ্রচার বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দৃঢ়তায় এসব বিভ্রান্তি কেটে যায়। ২ তারিখে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে যে সভা হয়েছিল তা শুধু আয়তনের বিচারেই নয়, গুরুত্বের বিচারেও ঐতিহাসিক। ঐদিন স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়।’
সেদিন সচিবালয়েও পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা উড়ানো হয়। রাতে হঠাৎ করে বেতার মারফত ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। কারফিউ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা প্রবল স্লোগান তুলে কারফিউ ভেঙে মিছিল বের করে।
স্লোগান ছিল : ‘সান্ধ্য আইন মানি না’, ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। সারা শহরে কারফিউ ভঙ্গ করে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। ডিআইটি অ্যাভিনিউয়ের মোড়, মর্নিং নিউজ পত্রিকা (অধুনালুপ্ত) অফিসের সামনে রাত সাড়ে ৯টায় সামরিক বাহিনী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে।
মানুষের বিশাল মিছিল কারফিউ ভঙ্গ করে গভর্নর হাউজের দিকে এগিয়ে গেলে সেখানেও গুলি চালানো হয়। এ ছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকায় কারফিউ ভঙ্গকারীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চলে।