বাবার রেখে যাওয়া রিকশা চালিয়ে চলছে সজিবের খাওয়া-পড়ালেখা
সোহেল হোসেন, মানিকগঞ্জ ।। কোমলমতি হাতে এখন বই-খাতা আর কলম থাকার কথা। সহপাঠীদের সঙ্গে আনন্দ উল্লাসে দিন কাটানোর কথা। কিন্তু সেই হাতে ধরতে হয়েছে রিকশার শক্ত হ্যান্ডেল। জীবন-জীবিকার তাগিদে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার রেখে যাওয়া রিকশা চালিয়ে মায়ের সংসারে জোগান দিচ্ছে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সজিব মিয়া (১৪)।
সজিব মিয়া মানিকগঞ্জ মত্ত হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা চাঁন মিয়া মারা গেছেন ৮ মাস আগে। পেশায় তিনি ছিলেন রিকশাচালক। বাবা, মা, বোন নিয়ে চার সদস্যের পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন বাবা। দীর্ঘদিন হৃদরোগ আর হাঁপানিতে (শ্বাসকষ্ট) আক্রান্ত ছিলেন তিনি। বাবার চিকিৎসার খরচ জোগাতে মা ও বেরিয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। সাধ্যমতো চিকিৎসা করিয়েও সুস্থ করে তুলতে পারেননি স্বামীকে। অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান রিকশাচালক চাঁন মিয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের বকজুরী গ্রামের মৃত চাঁন মিয়ার একমাত্র ছেলে সজিব মিয়া। নিজেদের সম্পদ বলতে দোচালা ঘর আর বাবার রেখে যাওয়া একটি রিকশা। এর বাইরে কোনো জমিজমা নেই তাদের। বাবার চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে বেশ কিছু টাকা ঋণও হয়েছে তার মা।
বাবা মারা যাওয়া কিছু দিন পর বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তারপর থেকে মা-ছেলের সংসার। মা ৮ বছর আগে থেকেই বাসা বাড়িতে কাজ করে আর সজিব এখন একবেলা করে রিকশা চালায়। মা-ছেলের এই কাজে যা আয় হয় তা দিয়েই সংসার চলে আর ঋণের টাকা পরিশোধ হয়।
সজিবের প্রতিবেশী আয়শা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওর বাবা (সজিবের) ছিল রিকশাচালক, শ্বাসকষ্ঠের রোগী। বাবা মারা গেছে। অনেক ঋণ হইছে। মা বাসায় বাসায় কাজ করতো। এখন এক মেসে রান্না করে। তাতে ওদের সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়।
আরেক প্রতিবেশী বলেন, কিছুদিন আগে ওর বাবা (সজিবের) মারা গেছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। সম্বল বলতে ওর বাবার রেখে যাওয়া একটি রিকশা। ওদের (সজিব) এমনি কোনো জায়গা জমি নেই। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে সজিব রিকশা চালিয়ে সংসারে জোগান দেয়। সরকারিভাবে ওদের (সজিব) সাহায্য সহযোগিতা করার দাবি করেন তিনি।
সজিবের মা হালিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বামী অসুস্থ থাকার কারণে গত আট বছর ধরে বাসায় বাসায় কাজ করি। গত বছর আগস্টে তিনি মারা যান। তারপর থেকে এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আছি। মেয়েকে বিয়ে দিছি, আর ছেলে (সজিব) অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বাপে (বাবা) রিকশা চালাইতো, এহন ছেলেও বাপের (বাবার) রিকশা চালায়। তাতে মা-ছেলের যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। তবুও কষ্ট করে দিন পার করছি। স্বামী মারা যাওয়ার পর রেশন কার্ড দিয়ে দুইবার ৩০ কেজি চাল পাইছি। তাছাড়া সরকারিভাবে কোন সাহায্য সহযোগিতা পায়নি। তবে সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে অনেক উপকার হতো বলে জানান এই সংগ্রামী মা।
মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সাবেক প্যানেল মেয়র মো. আরশেদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাঁন মিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিল। হাসপাতালে ভর্তি হলেই আমাকে জানাইতো। আমি ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু পারতাম সহযোগিতা করতাম। তাছাড়া পৌরসভা থেকেও অনেক সহযোগিতা করা হয়েছে। তবে কিছুদিন আগে সে মারা গেছে। তার স্ত্রী বাসা বাড়িতে কাজ করে আর শুনেছি ছেলেটি (সজিব) রিকশা চালিয়ে লেখাপড়ার খরচ আর সংসারে জোগান দিচ্ছে। চাঁন মিয়ার স্ত্রীর বয়স কম থাকায় বয়স্ক ভাতা কার্ড করে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সামনে পৌরসভার মাধ্যমে একটি বিধবা কার্ড করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সজিবদের পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ। আমাদের সমাজের বিত্তশালী, দানশীল ব্যক্তি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে তাদের অনেক উপকার হবে এবং সজিব লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে। সূত্রঃ ঢাকা পোস্ট