মুনিয়ার মৃত্যু! যাদের নাম এসেছে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে: পুলিশ
সিবিএনএ অনলাইন ডেস্ক/ ২৯ এপ্রিল ২০২১ | গুলশানে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার ‘আত্মহত্যার প্ররোচনা’র মামলায় যাদের নাম এসেছে তাদের প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। তাদের জবানবন্দিসহ তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে মামলার তদন্ত সম্পন্ন করা হবে। প্রাথমিকভাবে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী। গতকাল নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ইতিমধ্যে অনেকের নাম এসেছে। এজাহারেও অনেকের নাম রয়েছে। এই ঘটনায় তাদের কী ধরনের কর্মকাণ্ড ছিল তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। যাদের নাম এসেছে তাদেরকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। আমরা প্রাথমিকভাবে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি।
তথ্য নিচ্ছি। ১৬১ বা প্রাসঙ্গিক বক্তব্য আদালতে ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করার ব্যবস্থা করবো।
এই মামলায় পুলিশ তৎপর রয়েছে জানিয়ে উপ-কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, পুলিশের তৎপরতার কারণেই মামলাটি এই পর্যায়ে এসেছে। এটি অপমৃত্যু মামলা হতে পারতো। একটি প্রতিশ্রুতিশীল মেয়ে যার বয়স মাত্র ২১ বছর, সে কোনো কারণ ছাড়াই এভাবে আত্মহত্যা করতে পারে না। সেদিন খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সেখানে ছুটে যাই। দেয়ালে অভিযুক্তের সঙ্গে মেয়েটির ছবি দেখে আমরা মনে করেছি, এর মধ্যে বড় ধরনের কোনো প্ররোচনা রয়েছে। এই আশঙ্কা থেকেই মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা নেয় পুলিশ। মোসারাতের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পুলিশ সপ্রণোদিত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছে। ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে, ভিকটিমের পরিবারকে নিরাপত্তা যদি দিতে হয় এক্ষেত্রে যা যা করা দরকার পুলিশ তা করবে।
মুনিয়ার লাশ উদ্ধার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মৃতদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। পরে বিছানায় শুয়ে রাখা হয়। সুরতহাল করার সময় তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমাদের নারী পুলিশের সহযোগিতায় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। রশির কারণে তার গলায় ক্ষত চিহ্ন ছিল। দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকার কারণে হাতের তালু, পায়ের তালু কালো বর্ণ ধারণ করে। এর বাইরে আমরা কিছু বলতে পারি না। যারা ময়ানতদন্ত করছেন তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করবো।
ঘটনার কয়েকদিন আগে অভিযুক্ত ব্যক্তি ওই বাসায় গিয়েছিলেন জানিয়ে সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। ঘটনার দিন বা আগের দিন অভিযুক্তের কোনো দৃশ্য সেখানে পাইনি। ওই বাসায় যাওয়ার প্রমাণ পেয়েছি তবে সেটা ২৬শে এপ্রিলের আগে।
গুলশানের ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা ছয়টি ডায়েরি সম্পর্কে তিনি বলেন, মানসিক কষ্ট, হতাশা থেকে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা ডায়েরিতে লেখা রয়েছে। পরের দিন তাকে দেখে অভিযুক্ত ব্যক্তি ভুল বুঝতে পারবে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। মানসিক বিপর্যয়ের কারণে সে আত্মহত্যার মতো কাজটা বেছে নেয়। এতে গভীর পরিণতির কথা লিখেছে সে। সেখানে সে একটা ইঙ্গিত দিয়েছে। অভিযুক্ত বিবাহিত, তার স্ত্রী রয়েছে, সন্তান রয়েছে। সবমিলিয়ে সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে ভিকটিমের মনে কষ্ট ছিল।
মুনিয়ার ছয়টি ডায়েরির লেখা সম্পর্কে উপ-কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, তাদের সম্পর্ক নিয়ে অভিযুক্তের পরিবারের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন সময়ে তাদের সম্পর্কের যে টানাপড়েন, সম্পর্কের স্বীকৃতির যে বিষয়গুলো, যেভাবে তারা চলছিল, স্বীকৃতির প্রতি মুনিয়ার যে প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন ধরনের হতাশা বা বিভিন্ন ধরনের মনোকষ্ট, আমরা ডায়েরির লেখায় লক্ষ্য করেছি।
সরাসরি সু্সাইডাল নোটে যে রকম বর্ণনা থাকে এখানে কিন্তু সেভাবে নেই। বিভিন্ন দিনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে সৃষ্ট আনন্দ, বেদনা, কষ্ট সবই কিন্তু এখানে লেখা রয়েছে। ডায়েরির লেখা তদন্ত সহায়ক হবে। আমরা ডায়েরি উদ্ধার করে ঘটনার সঙ্গে যা প্রাসঙ্গকি তা খুঁজে বের করেছি। ডায়েরির পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে। এসব বিষয় আমরা পর্যালোচনা করছি। হস্তরেখা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে তার লেখা যাচাই করা হবে বলে জানান তিনি।
উপ-কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, ভাইরাল হওয়া একটি ভয়েসে ৫০ লাখ টাকার যে প্রসঙ্গ এসেছে তা অনেক টাকা। এ বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদের হিসাব নেয়া হবে। আমরা লেনদেন দেখছি। অভিযুক্ত বর্তমানে দেশেই রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, অভিযুক্তের দুটি পাসপোর্ট রয়েছে। ইমিগ্রেশনের যে ডাটাবেজ সিস্টেম রয়েছে তা থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে দুটি পাসপোর্ট ব্যবহার করে ২৬ বা ২৭শে এপ্রিলে কেউ দেশ ত্যাগ করেনি।
বসুন্ধরা এমডি’র জামিন আবেদনের শুনানি হয়নি
কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়াকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলার আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের আগাম জামিন আবেদনের শুনানি হয়নি। গতকাল বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চের কার্যতালিকায় বিষয়টি শুনানির জন্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে দিনের শুরুতে আদালতের দরজায় টাঙানো নোটিশে বলা হয়, ‘বর্তমান লকডাউন এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে অত্র কোর্ট আগাম জামিনের আবেদনপত্র পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত শুনানি গ্রহণ করিবেন না বলে অত্র আদালত অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন।’ অপরদিকে, করোনা পরিস্থিতিতে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আগাম জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হবে না বলে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
বেলা পৌনে ১১টার দিকে কয়েকজন আইনজীবী আগাম জামিন আবেদনের শুনানির বিষয়ে কথা বলেন। তখন আদালত আইনজীবীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাদের আরজির কারণে আমরা বুধবার বলেছিলাম, কিছু আগাম জামিন আবেদন শুনবো। তবে কবে শুনবো বলিনি। সুপ্রিম কোর্টের বিধি ও বর্তমান সর্বাত্মক লকডাউনে সরকারি বিধিনিষেধের কারণে এই মুহূর্তে কোনো ধরনের আগাম জামিন শোনা যাবে না। ১৩ থেকে ২৭ পর্যন্ত আইটেম (আগাম জামিনের আবেদন) ভুলভাবে এসেছে। নির্দেশনা ছিল ভবিষ্যতে আসবে, কিন্তু আজ ভুলক্রমে এসেছে। সুতরাং আগাম জামিন আবেদনের শুনানি হবে না। শুনানি না হওয়া প্রসঙ্গে সায়েম সোবহান আনভীরের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, শুনানিটা কেন হয়নি তা আদালত বলেননি। আদালত শুধু বলেছেন এখন হবে না। তবে কবে হতে পারে সে ব্যাপারেও কিচ্ছু বলেনি। অপরদিকে, বসুন্ধরা এমডি’র জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে শুনানিতে অংশ নেয়ার জন্য যুক্ত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না সহ অর্ধশত মানবাধিকার আইনজীবী। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে দুর্বলের পক্ষে কথা বলার জন্য সংশ্লিষ্ট ভার্চ্যুয়াল আদালতে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু বসুন্ধরা এমডিসহ কারোর আগাম জামিন আবেদনের শুনানিই হয়নি।
এর আগে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় বুধবার জামিনের আবেদনটি করেন এডভোকেট মামুন চৌধুরী নামে এক আইনজীবী। এরপর এটি শুনানির জন্য গতকাল বিচারপতি মামনুন রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চের কার্যতালিকায় উঠে। এদিকে, করোনা পরিস্থিতিতে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আগাম জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হবে না বলে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। শুধু অতি জরুরি মামলার শুনানির জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শারীরিক উপস্থিতি ব্যতিরেকে ২৯শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০ এবং এই কোর্ট কর্তৃক জারিকৃত প্র্যাকটিস ডাইরেকশন অনুসরণ করে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকার্য পরিচালনার জন্য চারটি বেঞ্চ গঠন করা হলো।
বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, মানি লন্ডারিং আইন ও আগাম জামিনের আবেদনপত্র ছাড়া অতি জরুরি সব ধরনের ফৌজদারি মোশন গ্রহণ করবেন, ফৌজদারি আপিল মঞ্জুরির আবেদনপত্র এবং তৎসংক্রান্ত জামিনের আবেদনপত্র; হাইকোর্ট বিভাগ ও উহার অধীনস্থ আদালতসমূহের অবমাননার অভিযোগপত্র এবং একক ও ডিভিশন বেঞ্চ কর্তৃক প্রদেয় জামিনসহ যেকোনো আদেশ ও রায় সংশোধনীর আবেদনপত্রও গ্রহণ করবেন। এ ছাড়া, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের বেঞ্চ, বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ, বিচারপতি জে.বি.এম হাসান এবং বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চকেও একই এখতিয়ার প্রদান করা হয়।