বিলেতে কমলগঞ্জের শতজনঃ ডাক্তার কামাল আহমেদ।। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ কমলগঞ্জের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে যে দু ‘একটি পরিবারের দান ও অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ ডাক্তার কামাল আহমদের পরিবার হচ্ছে তাদের একটি। শিক্ষা ও জনহিতৈষী কাজে এই পরিবারটির সুনাম শুধু এলাকায়ই নয় একসময় ছিলো দেশ জোড়া।
জনাব আহমেদের জন্ম ৪ঠা মে ১৯৪৩সালে তৎকালীন দক্ষিণ সিলেট মহকুমার কমলগঞ্জ থানাধীন গোবর্দ্ধন পুর গ্রামে। পিতার নাম ডাক্তার চেরাগ উদ্দিন আহমেদ।
চৌদ্দ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি ডাক্তার কামাল আহমেদ।
জনাব আহমদের পিতা ডাক্তার চেরাগ উদ্দিন আহমদ ছিলেন একাধারে ভূ -স্বামী ,রাজনীতিবিদ ,চিকিৎসক,মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সমাজকর্মী। শিলচর বোর্ডিং স্কুল ও কলিকাতা হোমিও প্যাথিক মেডিক্যাল কলেজে লেখাপড়া সম্পন্ন করে জনাব চেরাগ উদ্দিন ১৯১৪ সালে হোমিও প্যাথিক চিকিৎসা সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
কমলগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলকে এম ই স্কুল থেকে হাই স্কুলে উন্নীতকরনে তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন,তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় ও কর্ম দক্ষতায় এই স্কুলটি ১৯৩৪ সালে হাই স্কুলে উন্নীত হয়।সুদীর্ঘকাল কমলগঞ্জ হাই স্কুল ম্যানেজিং কমিটির তিনি সেক্রেটারী ছাড়াও এক সময় লোকেল বোর্ডের চেয়ারম্যানেরও দায়িত্বে ছিলেন যার অধীনে থানার সকল প্রাইমারী স্কুল পরিচালিত হতো।হাজী কাশী ওয়াকফ ষ্টেট এর মোতাওয়াল্লী জনাব চেরাগ উদ্দিন সাহেবের হাতেই কমলগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের জন্ম। প্রতিষ্ঠাতা থানা সভাপতি হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে ১৯৭২সাল পর্যন্ত। আধুনিক কমলগঞ্জের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা আমাদের স্বাধিকার,স্বাধীনতা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের এই অকুতোভয় সংগঠকের সুযোগ্য উত্তরসূরী হচ্ছেন ডাক্তার কামাল আহমেদ।
জনাব ডাক্তার কামাল আহমদের বড় ভাই নূর উদ্দিন আহমেদ ১৯৪৩সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সিলেট এম সি কলেজ থেকে গ্রেজুয়েশন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি রাজধানী করাচিতে স্থানান্তরিত হন এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল এল বি সম্পন্ন করে পাকিস্তান ট্যাক্সেশন সার্ভিসে যোগ দেন।বাংলাদেশে তিনি ইনকাম টেক্স কমিশনারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। কমলগঞ্জ গার্লস হাই স্কুল এই নূর উদ্দিন সাহেবের দানকৃত ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত আর স্কুল সম্মুখস্থ তাঁর মালিকানাধীন বাড়ী যেটি স্থানীয় ভাবে নাগ বাড়ী নামে পরিচিত সেটি ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে থানা আওয়ামীলীগের অফিস।
জনাব ডাক্তার কামাল আহমেদের অন্যান্য ভাইদের মধ্যে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলে সামরিক কর্মকর্তা। একজন জুনিয়র কমিশন অফিসার হিসাবে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।
নওয়াব উদ্দিন আহমেদ বিশিষ্ট কবি ,মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,মুক্তিযুদ্ধা ও যুদ্ধ চলাকালীন থানা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক।
ফারুক উদ্দিন আহমেদ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ যিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেন্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে একই বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে পাকিস্তান ষ্টেট ব্যাংকের রিসার্স ডিপার্টমেন্টে যোগদান করেন। বর্ণাঢ্য পেশাগত ক্যারিয়ার নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ উপদেষ্টা থাকা অবস্থায় তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
বাবা ডাক্তার চেরাগ উদ্দিন আহমদের মতো রাজনীতি কিংবা সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে ডাক্তার ফারুক আহমেদের সম্পৃক্ততা না থাকলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব ,শিক্ষা ও পেশা তাঁকে এমন একটি সু উচ্চতায় নিয়ে পৌঁছায় যে তাঁর কর্মদক্ষতা ও পরিচিতি সমাজ ও এলাকার গন্ডি ছাড়িয়ে বিস্তৃতি পায় আন্তর্জাতিক দুনিয়ায়।
ডাক্তার কামাল আহমেদের শৈশব ও কৈশোরকাল কাটে নিজ গ্রাম গোবর্দ্ধন পুরে। এখানেই বড় হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৫৮সাল পর্যন্ত কমলগঞ্জ হাই স্কুলে লেখাপড়া করে উচ্চতর পড়াশুনার জন্য বড় ভাই জনাব নূর উদ্দিন আহমেদের হাত ধরে চলে যান তৎকালীন পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে।
করাচির জ্যাকব লাইনস সরকারি হাই স্কুলে ভর্তি হন। বড় ভাই নুরুদ্দিন আহমেদের স্ত্রী জেবুন্নেছা আহমদ ঐ স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। জ্যাকব লাইন সরকারি হাই স্কুল থেকেই তিনি কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন আর করাচির ডি যে সাইন্স কলেজ থেকে ১৯৬২সালে পাশ করেন আই এস সি। ভর্তি হন করাচির বিখ্যাত দোও মেডিক্যাল কলেজে। ১৯৬৭সালে সম্পন্ন করেন এম বি বি এস। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত করাচি সিভিল হাসপাতালে কাজ করেন। ১৯৬৯সালে সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশন তাঁকে করাচির জিন্নাহ পোষ্ট গ্রেজুয়েট মেডিক্যাল ইনিষ্টিউট এ নিয়োগ প্রদান করে। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত জনাব ডাক্তার কামাল আহমেদ এই ইনিষ্টিউটে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি ডাক্তার পারভীন কাওসারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন যিনি দোও মেডিক্যাল কলেজে তাঁর দু‘বছর জুনিয়র ছিলেন।
১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময় অনেকটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি ।তাঁর বাবা ও ভাইয়েরা যুদ্ধে। একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশে আসতে পারেননি। ১৯৭২সালে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে চলে যান আফগানিস্তানে। সৌভাগ্যক্রমে ওই সময়ে এক বছরের চাকুরীসহ লিভারপুল ইউনিভার্সিটির পেয়ে যান একটি স্কলারশীপ এরপর প্যারিস হয়ে পাড়ি দেন লন্ডনে।
১৯৭৭সালে Royal college of surgeons and physicians লন্ডন থেকেDLO(diploma otolaryngology)সম্পন্ন করেন এরপর FRCS (fellow royal college of surgeons)করেন ১৯৮৩সালে।
১৯৭২সালেই তিনি জুনিয়র ডাক্তার ও নাক ,কান গলার রেজিষ্টার হিসাবে ব্রিটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস(NHS) এ নিয়োগ প্রাপ্ত হন। সত্তরের দশকে ব্রিটিশ এন এইচ এসে কাজ করা ভারত উপমহাদেশীয় হাতে গোনা কয়েক জনের মধ্যে তিনি একজন। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এন এইচ এস এ কাজ করে নাক কান ও গলা রোগের কনসালটেন্ট ও সিনিয়র লেকচারার হিসাবে কাজ নিয়ে চলে যান ইউনিভার্সিটি সাইন্স মালয়েশিয়ায় যেটি মালয়েশিয়ার পেনাং আইল্যান্ডে অবস্থিত। ১৯৮৮সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় থেকে আবারও ফিরে আসেন কনসালটেন্ট হিসাবে ব্রিটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে। ১৯৯১সাল থেকে ১৯৯৮সাল পর্যন্ত ডাক্তার কামাল আহমেদ সৌদি আরবের নর্থ ওয়েস্ট আর্ম ফোর্সেস হসপিটালে নাক ,কান গলার সিনিয়র কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯৮সালে আবারও ব্রিটিশ এন এইচ এসে ফিরে আসেন এবং ২০০৮ সালে এসে বর্ণাঢ্যময় কর্মজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান।
জনাব ডাক্তার কামাল আহমদের স্ত্রীও একজন চিকিৎসক ও জিপি হিসাবে কর্মরত।
তাঁর একমাত্র ছেলে শাহরিয়ার আহমেদ ফিনেন্স ও একাউন্টেন্সি তে বি এ (অনার্স )এবং একমাত্র মেয়ে সাজিয়া আহমেদ বায়োটেকনোলজিতে এম এস সি। শাহরিয়ার ২০০০সালে এবং সাজিয়া ২০০১ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শাহরিয়ার কাজ করছেন নিউইয়র্ক ইনভেষ্টমেন্ট ব্যাংকে আর সাজিয়া কর্মরত একটি জার্মান বহুজাতিক কোম্পানিতে।
জনাব ডাক্তার কামাল আহমেদ বর্তমানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন কেন্টের রাইনহাম এলাকায়।
অত্যন্ত মেধাবী ,বিনয়ী,ধার্মিক ও পরিচ্ছন্ন এই মানুষটি তাঁর বাবা ও ভাইদের মতো দেশের কথা ভাবেন। দেশের দুস্থ ও অসহায় মানুষদের দিকে হাত বাড়ান অহরহ।প্রায় প্রতি বছরই দেশের মাটিকে তিনি স্পর্শ করেন।
শিক্ষা আর কর্মজীবনের প্রায় পুরোটা বিদেশে কাটালেও আচার ও আচরনে ডাক্তার কামাল আহমদ একজন খাঁটি বাঙালী,নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক একজন বাংলাদেশের মানুষ।
-সৈয়দ মাসুম- লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক, যুক্তরাজ্য