যাপিত জীবন

মৎস মারিব খাইবো সুখে -২ | সুশীল কুমার পোদ্দার

মৎস মারিব খাইবো সুখে -২ | সুশীল কুমার পোদ্দার

মাছ ধরার নেশা বড় অপ্রতিরোধ্য নেশা। এ নেশা তাস বা আফিমের মতই উদগ্র। জীবন সংগ্রামে অবিরাম ঠোকর খাওয়া মানুষেরা অতি সহজে এই নেশায় আটকে পড়ে। এ নেশার মধ্যে খুঁজে পায় হতাশা থেকে বেঁচে থাকার রসদ। দীর্ঘ সময় একাগ্র চিত্তে বড়শি ফেলে মাছের জন্য প্রতীক্ষার মাঝে খুঁজে পায় জীবনের অভীষ্ট লক্ষে পৌছার অনুপ্রেরণা। এক ঘেয়েমী জীবনে প্রতি মুহূর্তে এনে দেয় বৈচিত্র্য , প্রতি মুহূর্তে প্রাপ্তির সম্ভাবনা। এ মাছ ধরার খেলা শুধু যে সংগ্রামী মানুষের জীবনেই বৈচিত্র্য এনে দেয় তাই নয়, অনেক শৌখিন মানুষের জীবনেও এনে দেয় ক্ষণিক আনন্দ। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ আনন্দের উৎস জীনগত। আমাদের পূর্বসূরীদের মধ্যে যে শিকার করার প্রবৃত্তি ছিল, বড় শিকার পেলে নিজের সক্ষমতা প্রদর্শন করার যে প্রবৃত্তি ছিল, হয়তো সেই প্রবৃত্তিই পরম্পরাগত ভাবে এসেছে আমাদের মধ্যে। তাই তো অনেকে নিষ্ঠুর ভাবে মাছ ধরেও বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হয়। নিজের সক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য মাছ টিকে নিয়ে ছবি তোলে কারোকে দেখানোর জন্য; কারোর চোখে একটু ভিন্নতর মাত্রা পাবার জন্য। আমরা অনেকেই এ মাছ মারা নিয়ে করি কতো বালখিল্য আচরণ। নিজের ব্যক্তিত্বের উচ্চতা ভুলে ধরা পড়া মাছটিকে চুমো দিয়ে বলে উঠি মাই বেবি, মাই বয়, এমনি সব অবান্তর কথা।

কানাডায় এসে অনেকের মতো আমিও এ নেশায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। মাছ পাই বা না পাই এক অপ্রতিরোধ্য নেশার টানে প্রতি বিকেলে নানা ওজুহাত দিয়ে চলে যাই দূর দূরান্তে। আমার মৎস্যগুরু তার শিষ্যদের নিয়ে চলে যান আরও দূর দূরান্তে। সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের পর মাছদের ভেতর এক অজানা কারণে দেখা দেয় এক গভীর চাঞ্চল্য। এ সময় নাকি প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। আমারও যেতে ইচ্ছে করে নিশুতি রাতের অন্ধকারে। কিন্তু কেন যেন অজানা আতঙ্কে মনটা কেপে ওঠে।

এখানকার বনাঞ্চল প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে। মানুষ এখানে খুব প্রয়োজন না হলে হস্তক্ষেপ করে না। বড় বড় গাছপালা ঝড়ে উপরে পড়ে থাকে এখানে সেখানে।, কঠোর আইনের ভয়ে কেউ জ্বালানী কাঠ অথবা আসবাব পত্র বানানোর জন্য বাড়ীতে নিয়ে যাবার কথা চিন্তাও করে না। এখানকার স্বল্প দীর্ঘ বসন্ত ও গ্রীষ্মের কথা মনে রেখে শীত নিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকা শীর্ণদীর্ণ বনাঞ্চল মুহূর্তে নব কিশলয়ে ভরে ওঠে। মুহূর্তে বৃক্ষ-লতা বিহীন অঞ্চল দুর্ভেদ্য অরণ্যে পরিণত হয়।

আমার বাড়ির পাশে বহতা নদীটা বয়ে গেছে এমনি কিছু বনাঞ্চলের গা ঘেঁসে, আবার কখনো বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে। আমি সেই বনাঞ্চলের মাঝে রাস্তা করে, উপড়ানো গাছ গুলের নীচ দিয়ে কোন মতো শরীর গুলিয়ে, কর্দমাক্ত পিচ্ছিল জলাধার পেড়িয়ে পৌঁছে যাই এক অর্ধ নিমজ্জিত পাথরের কাছে। অতিকায় এক সুন্দর প্রাগৈতিহাসিক পাথর। নদীর তীব্র স্রোত পাথরের গায়ে আঘাত খেয়ে পথ ঘুরে ছুটে চলেছে অন্য দিকে। পাথরের অপর প্রান্তের জলরাশি অনেকটা শান্ত। এদিকটায় হয়তো কেউ তেমন আসে না। পাথরের গা ঘেঁষে বিভারের বসত বাড়ি চোখে পড়ে। হয়তো কদিন আগেও ওরা এখানে ছিল। ওদের ফেলে যাওয়া গাছের ডাল পালা দেখে এটাকে মাছ ধরার উপযুক্ত জায়গা বলে মনে হয়। আমি দীর্ঘ সময় বসে থাকি মাছের প্রত্যাশায়। বার বার মনে হয় ভুল জায়গায় এসেছি। মনের নিভৃত কোনে বসে থাকা ওল্ড ম্যান এন্ড সি এর সান্টিয়েগো বুড়ো পাশাপাশি বসে সাহস জোগায়। পিঠে চাপড় দিয়ে বলে ওঠে – দেখ জীবনে বার বার হেরে যাওয়া একটা সংখ্যা মাত্র। চুরাশি দিন ক্রমাগত ব্যার্থতার পর প্রতিটি মানুষের জীবনে পঁচাশিতম দিন আসবেই।

হঠাৎ করে দল বেঁধে কোথা থেকে চলে আশে অজস্র মাছ। মুহূর্তে আমার ছোট পাত্র ভর্তি হেয়ে যায় ব্যাস, সান, ক্রাপি আর ক্যাট ফিসে। অধিকাংশই আকারে ছোট। আকাশে ঘুরে বেড়ায় ছোট ছোট ধুসর মেঘ। সেই মেঘের ছায়া পড়ে জলে। আমি সেই ছায়াকে মাছ ভেবে বড়শি গেঁথে তোলার চেষ্টা করি। হঠাৎ করে নেমে আসে অন্ধকার। নদীর পরপারে বহু দূরে আলো চোখে পড়ে। কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে আমি জানিনা। একটা আতঙ্ক আমায় জড়িয়ে ধরে। মনে পড়ে ছোড়দার কথা। মাছ ধরার তার ছিল প্রবল নেশা। বিরাট পানা পুকুরের কালো জলে সে মাছ ধরতো। মা প্রতি মুহূর্তে বলতো তোকে কবে যে মেছো ভূত টেনে নিয়ে যাবে! আজ তেমনি এক আতঙ্ক আমায় পেয়ে বসে। কোথা থেকে ডানা ঝাপটিয়ে ঝুপ ঝুপ করে জলে নেমে আসে অজস্র হাস। কুলোয় ফেরে পাখিরা। নিকটবর্তি গাছটা মুহূর্তে পাখিতে পাখিতে ভর্তি হয়ে যায়। ওরা আমায় একা দেখে বিচিত্র শব্দে একে ওপরকে জানিয়ে দেয়। আমি কোনমতে মাছগুলোকে নিয়ে পালাতে চেষ্টা করি। বড় একটা রাজহাস আমায় তাড়া করে। আমি কাদা জলে নিজকে একাকার করে দৌড়ে চলি। গাছের ডাল আমায় টেনে ধরে। কুসংস্কারে বিশ্বাস নেই বলে যে এতদিন নিজের উপর গর্ব ছিল তা মুহূর্তে ঝড়ে পড়ে। আবারো মনে পড়ে সেই মেছো ভুতের কথা। মা বলতো ওরা কখনো বেড়াল বা অন্য কোণ প্রাণীর রূপ ধরে মাছগুলো কেড়ে নেয়। আমি গাছের ডালে আটকে পড়া মাছ ভর্তি পাত্র, ফিশিং রড সহ অনেক কিছু ফেলে দিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পালিয়ে আসি। পথে দেখা হয় শৌখিন নিশুতি রাতের মৎস্য শিকারিদের সাথে। নিজের উপর বড্ড রাগ হয়। ওদের দেখে মনে মনে বলি তোমার হল শুরু আমার হোল সাড়া… চলবে..

মৎস মারিব খাইবো সুখে -২ | সুশীল কুমার পোদ্দার,  ওয়াটারলু, কানাডা নিবাসী ।  ফলিত পদার্থ বিদ্যা ও ইলেকট্রনিক্স,  মাস্টার্স,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, পি, এইচ, ডি,   ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। সিস্টেম ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাস্টার্স,  ওয়াটারলু, বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ।।


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন