তালেবানের কথা-কাজে এখনই গরমিল
‘সহস্র নিরুপায়ের ভিড়ে দাঁড়িয়ে’ আতঙ্কিত আফগানরা। রবিঠাকুরের মরণযাত্রায় কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ওভাবে দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতার ‘একটা মোড়ে’। আর আফগানিস্তান ছাড়তে মরিয়া মানুষগুলো আটকা পড়ছেন কাবুলের মোড়ে মোড়ে।
‘তালেবান ২.০’ শাসনের শুরুতেই সশস্ত্র গোষ্ঠীটির কথা ও কাজে গরমিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশ ছেড়ে যারা যেতে চায়, তাদের বাধা না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে চিত্র উল্টো। কাবুলের বিমানবন্দর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সেই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেন না প্রাণ-শঙ্কায় থাকায় আফগানরা। তালেবানের সশস্ত্র সদস্যরা মোড়ে মোড়ে তল্লাশি চৌকিতে তাদের বাধা দিচ্ছে, ফেরত পাঠাচ্ছে, এমনকি নির্যাতন করছে বলেও স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও প্রতিনিধিদের বরাতে জানাচ্ছে বিবিসি, আল জাজিরা ও দ্য গার্ডিয়ান। জাতিসংঘের গোয়েন্দা ইউনিট বলছে, যারা আফগান যুদ্ধে আমেরিকা ও এর মিত্র সামরিক জোট ন্যাটোকে সহযোগিতা করেছে, তাদের তালিকা তৈরি করে ‘হত্যার জন্য ঘরে ঘরে কড়া নাড়ছে’ তালেবান।
এদিকে গতকাল আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে দেশি ও প্রবাসী আফগানরা স্বাধীন পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন বলে জানিয়েছে বিবিসি ও এএফপি। কেন্দ্রীয় রাজধানী কাবুলের রাজপথেও আফগান পতাকা নিয়ে ‘গৌরবের মিছিল’ করেছেন অনেকে। কুনার প্রদেশের রাজধানী আসাদাবাদেও বড় জনমিছিল হয়েছে। এ সময় তালেবানের গুলিতে অন্তত দুজন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আল জাজিরা। এর আগের দিন নঙ্গরহার প্রদেশের রাজধানী জালালাবাদে জাতীয় পতাকা সরিয়ে তালেবানের নতুন রাষ্ট্র ভাবনার পতাকা উড়ানোকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘাতে অন্তত তিনজনের প্রাণহানি হয়েছে।
আফগানিস্তান ১৯১৯ সালের ১৯ আগস্ট ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়। তখন থেকে প্রত্যেক বছর ১৯ আগস্টকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে দেশটি।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেনা সরানো শুরু করলে তালেবান এ মাসের শুরুর দিকে একে একে ২৫টি প্রদেশ দখল করে নেয়। ১৫ আগস্ট তারা কাবুল দখল করে, চূড়ান্ত পতন হয় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকারের।
এর আগে ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখল করেছিল। দেশজুড়ে চার বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা কাবুল দখল করার পর তালেবানের পতাকা উড়িয়েছিল সরকারি ভবনগুলো থেকে। ক্ষমতা জোর করে কেড়ে নেওয়ার পর তালেবান প্রথম যেসব কাজ করেছিল, তার মধ্যে ছিল তৎকালীন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহকে প্রকাশ্যে হত্যা। তালেবান নীতি ঠিক করে দিয়েছিল, নারীরা কাজে যেতে পারবেন না, মেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে না। নারীদের বাধ্যতামূলক মুখ ঢেকে রাখতে হবে এবং বাড়ির বাইরে গেলে অবশ্যই সঙ্গে পুরুষ স্বজন থাকতে হবে। পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা ও অঙ্গ ছেদÑ এ রকম কঠিন শাস্তির প্রচলনও করেছিল তালেবান।
কিন্তু এবার কৌশল বদল করার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল তালেবানের কথায়। মঙ্গলবার কাবুলে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তারা জানায়, যারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মানুষ, মিলিশিয়া, সেনা, পুলিশ এবং সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে, নিঃশর্ত সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছে। তারা তরুণদের ‘সম্পদ’ অভিহিত করে দেশ না ছাড়ার অনুরোধ জানায়; কিন্তু কেউ চলে যেতে চাইলে বাধা না দেওয়ার অঙ্গীকার করে। নারী অধিকার ও মেয়েদের শিক্ষার অধিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়, অবশ্য ‘যতটুকু শরিয়া আইন সমর্থন করে’। গণমাধ্যমকেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। আর একটি ‘সর্বদলীয়’ ধাঁচের সরকার গঠনের কথাও জানিয়েছে তালেবান।
কিন্তু দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, আল জাজিরা, রয়টার্স ও এএফপির প্রতিবেদনগুলোয় এসব প্রতিশ্রুতি এখনই ভঙ্গের ছাপ উঠে এসেছে। কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অনেক ফ্লাইট পর্যাপ্ত যাত্রী না নিয়েই ফিরে যাচ্ছে গন্তব্যে। এ অন্যতম কারণ, বিশেষত দেশত্যাগে ইচ্ছুক আফগানরা বিমানবন্দরেই যেতে পারছেন না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তালেবান সদস্যরা লোকজনকে বিমানবন্দরের ভেতরে যেতে বাধা দিচ্ছে, যাদের ভ্রমণসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে তাদেরও বাধা দেওয়া হচ্ছে। পাঁচ দিনে কাবুলের প্রধান বিমানবন্দরটিতে ১২ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে, তবে কারা দায়ী তা স্পষ্ট নয়।
জাতীয় পতাকা নিয়ে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে তালেবান। রক্তপাত হয়েছে, মানুষের প্রাণ গেছে।
এদিকে তাজিকিস্তানে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত জহির আগবর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তালেবানবিরোধীদের দুর্গ হবে আফগানিস্তানের পঞ্জশির প্রদেশ এবং এর নেতৃত্বে থাকবেন দেশটির স্বঘোষিত ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট আরুল্লাহ সালেহ।
রয়টার্স বলছে, সরু পঞ্জশির উপত্যকায় আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আশির দশকে মুজাহিদিন নেতা আহমদ শাহ মাসউদের বাহিনীর হাতে ধ্বংস হওয়া সোভিয়েত যুদ্ধযানগুলো। এলাকাটি এক সময় তালেবানবিরোধীদের অন্যতম ঘাঁটি হয়ে ওঠে। ২০০১ সালে তালেবান সরকারকে হটাতে পঞ্জশিরভিত্তিক জোটগুলোর সাহায্য নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রও।
আগবর বলেছেন, ‘আমি বলব না, তালেবান যুদ্ধে জিতেছে। যুদ্ধ এখনো বাকি।’
- আমাদেরসময়
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান