গল্প# আজগারের অপূর্ণ ইচ্ছে ও রূপসীর কপাল ।।। আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস
এক.
বাথরুম থেকে বেরিয়ে রেবেকা দেখল, পাশের বাড়ির রূপসী। গলায় একটা ফোন ঝুলিয়ে নিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনটা তার গলায় সবসময়ই ঝুলানো থাকে। না হলে তার আজগার ফোন করে তাকে যে পাবেনা। বাইরে কাজে যাওয়ার দিন আজগার ফোনটা তাকে দিয়ে গেছে।
মোট চার সন্তানের জন্মদাত্রী হল রূপসী। কিন্তু বেঁচে থাকা বলতে তার এখন ওই আজগারই আছে। বাকিরা সব গোরস্থানে শুয়ে। রোজ হাশর ছাড়া তাদের কারও সাথেই তার আর দেখা হবেনা। অতএব আজগারই তার এখন জানের জান, হৃদয়ের ধন। আর এই জন্যই কোনদিন সে তাকে বাইরে যেতে দেয়নি। যেমন-কেরালা, মুম্বাই ও গুজরাটে।অর্থ উপার্জন করতে। কিন্তু আজগার যেতে চেয়েছে অনেকবার। আর রূপসী তার হাত ধরে প্রত্যেকবারই তাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছে—-তুই বাইরে যাসনে খোকা, তুই বাইরে গেলে আমি যে থাকতে পারব না। তার থেকে তুই গ্রামে কাজ করছিস, গ্রামেই কাজ কর।
আজগার তার উত্তরে বলেছে—–গ্রামে কাজ করে কী হবে, মা? ও টাকা তো খেতেই ফুরিয়ে যাবে। ঘরবাড়ি কিছুই হবেনা। আজকাল মানুষ বাইরে কাজ করে কত জনে কত কিছু করছে। কেউ বাড়ি করছে, কেউ গাড়ি করছে, কেউবা ভবিষ্যতের জন্য বাড়ি করার জায়গা কিনে রাখছে। যার যেটার প্রয়োজন সে সেটা করছে। কিন্তু আমরা? কবেকার সেই মাটির দেওয়ালে বাড়িতেই বাস করছি। তারপরও তুমি বলছ, বাইরে যেতে হবেনা?
সান্ত্বনা বাক্যে রূপসী বলেছে—-ধৈর্য ধর, আপনি হবে।
—-আপনি কবে হবে?
—-আল্লাহ পাক যেদিন করাবে সেদিনই হবে। আর তাছাড়া, আল্লাহ পাকের সাহায্য নিতে গেলে মানুষকে একটু ধৈর্যই ধরতে হয়, বুঝলি? তুইও ধৈর্য ধর, তোরও হবে। রূপসী এইভাবেই তার যাওয়ার পথ আটকে দিয়েছে বারবার।
দুই.
পাড়ার রহিদুলের মেয়ে লিলি, আজগারের সম্পর্ক ছিল তার সাথে। কিন্তু কিছুদিন থেকে আজগারকে সে আর পাত্তা দিতে চায় না। আজগার ফোন করলে ফোন ধরে না পর্যন্ত। সদ্য কেরালা খেটে আসা সুজনকে সে বিয়ে করতে চায়। সুজনের সাথে তার এখন লাইন চলছে। কথাটা আজগার সুজনের এক বন্ধুর মুখ থেকে শুনেছে। সুজন তার সেই বন্ধুর সামনে গল্পটা করেছে।
আজগার একটা নতুন নম্বর থেকে এরপর লিলিকে ফোন করে।
—-হ্যালো,কে? লিলি ফোনটা রিসিভ করে।
আজগার বলে—-আমি আজগার বলছি।
লিলি জিজ্ঞেস করে—-কী হল?
—-ফোন করলে ফোন ধরো না কেন?
—-প্রয়োজন মনে করিনা বলে।
—-মানে!
—-মানে আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না।
—-ভালোবাসো না!
—-না, বাসি না।
—-কিন্তু তুমি যে একদিন খোদার কসম খেয়ে আমাকে বলেছিলে, আমাকে ছাড়া তুমি কাউকে ভালোবাসবে না!
—-ওটা মিথ্যা কথা ছিল, এমনি বলেছিলাম।
—-বেশ, তুমি তাহলে কাকে ভালোবাসো?
—-আমি সুজনকে ভালোবাসি এবং বিয়েও আমি সুজনকেই করব।
—-কী বললে!
—-হ্যাঁ।
—-কিন্তু সুজন তো দেখতে ভালো নয়, কালো এবং বেঁটে। লেখাপড়াও ভালো জানেনা।সুজনকে তোমার সাথে মানাবে?
—-তাও আমি সুজনকেই বিয়ে করব। কারণ, সুজন দেখতে ভালো না হলে কী হবে? তার অনেক টাকা আছে। তোমার মতো ছেলেকে যখন তখন কেনাবেচা করতে পারবে। কেরালায় সে ঠিকাদারি করে এবং মাস গেলে মোটা টাকা রোজগার করে। গাড়ি, বাড়ি, টাকা পয়সা সব কিছুই তার আছে। তোমার মতো মাটির একটা দেওয়ালে বাড়িতে বাস করে না। যেখানে সাপখোপ, ব্যাঙ, পোকামাকড় বাস করে। কিছুদিন হল সে আমাকে একটা নেকলেস কিনে দিয়েছে। আবার সামনে মাসে আমাকে নিয়ে দিঘা বেড়াতে যাবে বলেছে। কিন্তু তুমি? দু-বছর ধরে তোমার সাথে প্রেম করেছি। কোনদিন শখ করে তুমি আমাকে একটা জিনিস কিনে দিয়েছ? না কোথাও বেড়াতে নিয়ে গিয়েছ? তাহলে তোমার সাথে প্রেম করব কেন বলতে পারো? তাই,তোমাকে বাদ দিয়ে আমার লাইফ পার্টনার হিসেবে আমি সুজনকেই বেছে নিয়েছি। যাইহোক, তুমি আমাকে আর কক্ষনো ফোন করবেনা। হ্যাঁ,তোমার সাথে আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই।….
তিন.
এরপরই আজগার একদিন ব্যাগ পত্তর গোছাতে শুরু করে। না,সে আর বাড়িতে থাকবে না। কেরালা চলে যাবে। গিয়ে সেখানে সে প্রচুর টাকা রোজগার করে বাড়ি,গাড়ি ও আরও অনেক কিছু করবে। ও লিলিকে পরে একদিন দেখিয়ে দেবে যে, সুজনের চাইতে সে কোন অংশে কম নয়। টাকা তারও আছে এবং রোজগার সেও করে। বরং সুজনের চাইতে সে চেহারা আর যোগ্যতার দিক থেকে এগিয়ে আছে। সে মাধ্যমিক পাশ আর সুজন হল নিম্ন-প্রাথমিক। একে ক অক্ষর গো-মাংস ছাড়া আর কী বলা চলে? হিসেবের জন্য তাকে টাকা দিয়ে লোক পুষতে হয়।
কিন্তু ব্যাগ পত্তর গোছাতে রূপসী দেখে ফেলে তাকে জিজ্ঞেস করে—-কী রে খোকা,ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে কোথায় যাবি?
আজগার বলে—-কেরালা।
রূপসী তার সেই একই কথা তখন বলতে শুরু করে—-তুই কেরালা যাসনে খোকা, তুই কেরালা গেলে আমি যে থাকতে পারব না।…
আজগার তখন এই বলে হুমকি দেয় যে, এবার কেরালা যেতে না পারলে সে আত্মহত্যা করবে।
—–না খোকা না, তুই আত্মহত্যা করবিনা।
—–আমাকে কেরালা যেতে হুকুম দাও তাহলে।
রূপসী তখনই আজগারকে কেরালা যাওয়ার হুকুম দেয়—–তুই কেরালা যা খোকা, মোটা টাকা রোজগার কর গে!
আজগার এরপর কেরালা যায় এবং যাওয়ার সময় একটা ফোন দিয়ে যায়। প্রতিদিন সে তিন-চারবার করে ফোন করবে বলে।তাছাড়া মোবাইলে তার অনেক গুলো ছবি লোড করা আছে। তার জন্য যখন মন খারাপ করবে তখনই সে ছবি গুলো দেখতে পারবে।
।।চার।।
রেবেকা বলল—-কে, রূপসী?
রূপসী বলল—-হ্যাঁ, আমি রূপসী।
—-কী হল,বলো।
রূপসী বলল—-একটা ছেঁড়া শাড়ি নিয়ে এসেছি, সেলাই করে দাও।
রেবেকার সেলাই মেশিন আছে। বাড়িতে ছেঁড়া,ফাটা সেলাইয়ের কাজ করে। পাড়ার মেয়েরা ছেঁড়া, ফাটা সেলাই করাতে তার কাছে আসে।
—-বসো, করে দিচ্ছি। রেবেকা তাকে বসতে বললে রূপসী বসল।—–দেরি হবে?
—-না, এক্ষুনি করে দিচ্ছি। কী সেলাই করতে হবে দেখাও।
রূপসী তার শাড়ির ছেঁড়া জায়গাগুলো তাকে দেখাল। যাতে সেলাই করার সময় একটাও ছেঁড়া জায়গা তার দৃষ্টি এড়িয়ে বাদ পড়ে না যায়। শাড়ির যে অংশটাকে মেয়েরা মেঝে বলে সেখানে দু-জায়গা, আঁচলের কাছে এক জায়গা আর বুকের কাছে এক জায়গা—–মোট চার জায়গা ছেঁড়া আছে শাড়িতে।দেখিয়ে দিয়ে রূপসী বলল—-ভালো করে সেলাই করে দিও,সেলাই যেন পরে খসে না যায়।
—–খসে যাবেনা,ভালো করেই সেলাই করে দিচ্ছি। বলে শাড়িটা হাতে নিয়ে দেখে রেবেকা বলল—-তোমার এ শাড়ি সেলাই না করাই ভালো। শাড়ির অবস্থা মোটেও ভালো নেই। পচে গেছে। খুব বেশি দিন চলবে না। তার থেকে শাড়িটা বাদ দিয়ে তুমি একটা নতুন শাড়ি কিনে নিও।
রূপসী বলল—-নতুন শাড়ি কেনার মতো এখন পয়সা নেই। যা চলে চলবে,তুমি সেলাই করে দাও।
—–কেন, আজগার গিয়ে টাকা পাঠাইনি?
—-এই তো সেদিন গেল,আরো কিছুদিন যাক, তবে তো পাঠাবে।
—–ঠিক আছে, আমি তাহলে সেলাই করে দিচ্ছি?
—–হ্যাঁ, দাও।
রেবেকা এরপর শাড়িটা সেলাই করেই দিল।
রূপসী তাকে জিজ্ঞেস করল—-কত টাকা লাগবে?
—-দশ টাকা দাও।
রূপসী তাকে দশ টাকা দিয়ে উঠে চলে আসতে যাবে এমন সময় তার গলায় ঝুলানো ফোনটা বাজতে লাগল। নিশ্চয়ই তার আজগার ফোন করেছে। রূপসী তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল—-হ্যালো! কে,খোকা?
—–না খালাম্মা,আমি আজগার নই। আজগারের বন্ধু। আমার নাম আনোয়ার। আমরা এক সাথে কাজ করি।
—–ও,বলো।
—–বলছি, আজগার আর নেই খালাম্মা,মারা গেছে। উঁচু ছাদের উপর পাটা মারতে মারতে পাটা ভেঙে নিচে পড়ে গিয়ে। আমরা এখন সবাই হাসপাতালে তার লাশের কাছে আছি।…
—–না আ আ আ আ আ…..অমনি বিকট চিৎকার করে কেঁদে উঠে রূপসী ওখানেই পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।পৃথিবীতে একটাও ছেলে তার আর থাকল না। স্বামী থেকেও স্বামী নেই।পাড়ার একটা মেয়ের সাথে ভাব করে তাকে বিয়ে করে আলাদা জায়গায় বাড়ি করে আছে। রূপসীর সাথে কোনও যোগাযোগ রাখেনা।অতএব রূপসীর মতো কপাল কোনও মেয়ের যেন না হয়, কোনও মেয়ের যেন…
————-
আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস, লেখক -গল্পকার। মুর্শিদাবাদ।পশ্চিম বঙ্গ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান