দেশের সংবাদ ফিচার্ড

কারাগারে স্কুল শিক্ষক হৃদয় মন্ডল, নিরাপত্তাহীনতায় পরিবার

হৃদয়-মন্ডল

তাকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে: হৃদয় মন্ডলের স্ত্রী | কারাগারে স্কুল শিক্ষক হৃদয় মন্ডল

একতলা বাসার দরজা, জানালা চারদিক থেকে বন্ধ। বারবার দরজায় টোকা দিয়েও ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। বেশ কয়েকবার ‘কেউ আছেন, কেউ আছেন’ বলে উচ্চস্বরে ডাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। কিছুক্ষণ পর একটি ছেলে দরজার কাছে এসে পরিচয় জানার পর দরজা খুলে দেয়। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, বাসার ভেতরের দেয়াল ও জানালায় গণিতের সূত্র, বিভিন্ন সমীকরণ লেখা।

যে কক্ষটিতে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানেও বীজগণিতের বিভিন্ন সূত্র লেখা। কক্ষে শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য দুটি বেঞ্চ আর একটি বই পড়ার টেবিল আছে। এ টেবিলে বসেই শিক্ষার্থীদের পড়াতেন গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডল (৫৪)। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডল। গত ২০ মার্চ স্কুলে বিজ্ঞান বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন তিনি। ক্লাস শেষে কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। যেখানে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।

গত ২২ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় হৃদয় মন্ডলের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমানিত করা ও ধর্মীয় গ্রন্থের অবমাননার অভিযোগ এনে মামলা করেন একই স্কুলের অফিস সহকারী মো. আসাদ মিয়াঁ। এরপর শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে আটক করা হয়। মুন্সিগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গত ২৮ মার্চ ও ৪ এপ্রিল জামিন আবেদন করলে সেটি নামঞ্জুর করা হয়।

হৃদয় মন্ডল প্রায় ২১ বছর ধরে বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে গণিত ও বিজ্ঞান বিষয় পড়ান। স্কুলের পাশে একটি কোয়াটারে থাকেন তিনি।

হৃদয় মন্ডলের স্ত্রী ববিতা হাওলাদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বেশ কয়েকদিন ধরে আমার ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে পারছি না। ঐ স্কুলে ছাত্ররা আমার ছেলেকে “আসামির ছেলে” বলে ডাকে। তারপর থেকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছি। আমাদের বাসার ভেতর কেউ প্রবেশ করলে আশেপাশের লোকজন বিরূপ মন্তব্য করে। আমার স্বামী অপরাধ করেনি। সে ধর্ম নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য করতে পারেনা। আমরা আমাদের নিরাপত্তা নিয়েও ভয়ে আছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্কুলে মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশের নিয়ম নেই। কিন্তু ছাত্ররা ঐদিন ক্লাস চলাকালীন আমার স্বামীর পড়ানোর একটি বক্তব্য রেকর্ড করেছে। মামলার এজাহারে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়েছে। কিন্তু অডিও রেকর্ডের কোথাও এমন কিছুই নেই।’

‘দীর্ঘদিন ধরে নানা দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। আমার স্বামী যখন স্কুলে যেতেন তখন রাস্তায় ছাত্ররা তার নাম ধরে নানা কটূক্তি করতো। ক্লাসের মধ্যেও ছাত্ররা তার নাম নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করতো। বাসায় লোহার দরজায় জোরে জোরে লাথি মেরে চলে যেত, জানালায় শব্দ করতো। নাম ধরে বাসার সামনে চিৎকারও করতো। এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আমার স্বামী প্রায়ই আক্ষেপ করতেন। এ বিষয়ে তিনি ছাত্রদেরকে বুঝিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। সেজন্য তিনি এ বিষয়গুলো সহ্য করেই ক্লাস নিতেন। আমরাও এ বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই নিতে শুরু করছিলাম। আমার স্বামী কোনো ধর্মের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করেনি। তাকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে,’ বলেন তিনি।

হৃদয় মন্ডলের স্ত্রী ববিতা হাওলাদার আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমার স্বামী কারাগারে আছেন। তিনি ডায়াবেটিস রোগী। এখন ঔষধও খাচ্ছেন না। কয়েকদিন আগে কারাগারে গিয়েছিলাম। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তার চাকরির মেয়াদ আরও ৬ বছর আছে। দ্রুত জামিনে মুক্ত হয়ে যাতে ক্লাস ফিরতে পারেন সে বিষয়ে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।’

বর্তমানে এ মামলা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন হৃদয় মন্ডলের স্ত্রীর বড় ভাই বাদল হাওলাদার। তিনি বলেন, ‘হৃদয় মন্ডল একই স্কুলে প্রায় ২১ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। তিনি বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। ছাত্ররাও তার কাছে বাসায় এসে প্রাইভেট পড়তো। দুটি ব্যাচে প্রায় ৬০ জন ছাত্র পড়াতেন তিনি। বেশি ছাত্র তার কাছে পড়তে আসায় অনেকের মনে মনে ক্ষোভ ছিল। চাকরি জীবনে কখনো তার ব্যাপারে ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিযোগ আসেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা খুবই ভয়ে আছি। আমাদেরকে সমাজ অনেকটা একঘরে করে রেখেছে। বাসার বাইরে হৃদয় মন্ডলের পরিচয় দিতেও ভয় লাগে। দিনের বেলায়ও বাসার বাইরে যাচ্ছি না।’

জানতে চাইলে মামলার বাদি ও স্কুলের অফিস সহকারি মো. আসাদ মিয়াঁ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ঘটনার দিন দ্বিতীয় তলায় ক্লাস চলছিল। আমি ছিলাম নিচ তলায়। আমি নিজে শুনিনি তবে ছাত্রদের কাছ থেকে ঘটনা শুনেছি। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে মামলার বাদি হতে বলেছিল। আন্দোলনের দিন ছাত্ররা অনেক উত্তেজিত ছিল। ছাত্ররা শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে সবার কাছে মাফ চাইতে বলছিল।’

বিনোদপুর রামগোপাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত ২০ মার্চ বিকেল ৪টায় দশম শ্রেনীর বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী এসে একটি দরখাস্তে হৃদয় মন্ডলের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনে। বিষয়টি নিয়ে আমি স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করি। পরদিন সকাল ১০টায় অভিযুক্ত শিক্ষককে এ ব্যাপারে কারণ দর্শানোর একটি চিঠি দেওয়া হয়। যার জবাব ৩ দিনের মধ্যে দিতে বলা হয়েছিল। পরদিন ২২ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টায় বহিরাগত অনেক মানুষ স্কুলের ভেতর প্রবেশ করে। সেদিন বহিরাগতদের সঙ্গে মিলে শিক্ষার্থীরাও স্কুলের গেট ও হৃদয় মণ্ডল শিক্ষকের বাসার গেট ধাক্কাধাক্কি করে। এরপর শিক্ষার্থীদের স্কুলের কক্ষে এনে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। কারণ দর্শানোর জবাব না পেলে শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়। তারপরও তারা কক্ষ থেকে বের হয়ে বহিরাগতদের সঙ্গে মিলে হট্টগোল শুরু করে। এরপর পুলিশকে জানানো হলে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।’

ঐদিন ক্লাসে শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের পাঠদানের কথোপকথন অডিও রেকর্ড করেছিলেন দশম শ্রেণির ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের এক শিক্ষার্থী। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘ওইদিন বাংলা দ্বিতীয় পত্র বিষয় পড়ানোর কথা ছিল। অন্য ক্লাসের পরীক্ষা চলায় শিক্ষক সংকটের কারণে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডল এসেছিলেন ক্লাস নিতে। তিনি বিজ্ঞান পড়িয়েছেন। সেখানে কথায় কথায় এক পর্যায়ে ধর্ম ও বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ক্লাস ১ ঘন্টার বেশি চলছিল। শিক্ষক হৃদয় মন্ডল যখন ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলছিলেন তখন আমার এক বন্ধু অডিও রেকর্ড করতে বলে। ঐদিন টিফিনের পর মোবাইল নিয়ে গিয়েছিলাম। ২২ মার্চ আন্দোলনের দিন আমি ক্লাসে ছিলাম। এসময় বন্ধু ও বহিরাগত কিছু বড় ভাই আমাদেরকে নিয়ে যায়। বহিরাগত কাউকে চিনিনা কিন্তু তারা স্থানীয়।’

জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো শিক্ষক এ ব্যাপারে উস্কে দেয়নি কিংবা অডিও রেকর্ড করতেও বলেনি।’

হৃদয় মন্ডল পক্ষের আইনজীবী ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অজয় চক্রবর্তী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দুবার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করার পর জজ কোর্টে জামিন চেয়েছি। আগামী ১০ এপ্রিল জামিন শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। মামলার এজাহারে ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগের একটি ধারা আনা হয়েছে সেটি যথাযথ হয়নি।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ মুন্সিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি সমর ঘোষ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পুলিশ যখন তাকে ঘটনার দিন আটক করে থানায় এনেছিল তখন তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেছেন, তিনি কোনো ধরনের ধর্ম অবমাননাকর বক্তব্য দেননি। ২০ মার্চের ঘটনায় ছাত্ররা দুদিন পর ২২ মার্চ আন্দোলন করেছে। এ দুদিনে তাদেরকে কেউ উস্কে দিয়েছে। পরিকল্পনা করে তাকে হেনস্তা করা হয়েছে।’

স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন জানান, ‘ওই ঘটনার পর স্কুলে আর কোনো সমস্যা হয়নি। নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘হৃদয় মন্ডল একজন নিরীহ মানুষ। স্কুলের ভেতর মোবাইল নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু ঐদিন কীভাবে মোবাইল নিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করেছে তা জানা নেই। প্রায় ২১ বছর ধরে হৃদয় মন্ডল শিক্ষকতা করেন। এর আগে কখনোই তার বিরুদ্ধে এই ধরনের কোনো অভিযোগ শুনিনি।’

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মুন্সিগঞ্জ সদর থানার উপ-পরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ঐদিন ক্লাসে শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথোপকথন একজন ছাত্র মোবাইলে রেকর্ড করেছিল। কিন্তু ছাত্ররা তাদের আন্দোলন ও প্রধান শিক্ষকের কাছে যে অভিযোগ এনেছে তা রেকর্ডের মধ্যে পাওয়া যায়নি। কিছুদিনের মধ্যে এ ঘটনায় চার্জশিট দেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, জেলার সিরাজদিখান উপজেলার মৃত নন্দ লাল মন্ডলের ছেলে হৃদয় মন্ডল। তিনি ১৯৮২ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কুচিয়ামোড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। তারপর শ্রীনগর কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করেন তিনি। হৃদয় মন্ডল তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা জগন্নাথ কলেজ থেকে গণিত বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন।

-সূত্র ও ছবি: স্টার





সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন