আড়ালে তার সূর্য হাসে ।। মামুন রশীদ
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমরা বড় হইনি। ফলে আমাদের ছেলেবেলায় মাঠে-ময়দানে দৌড়ঝাঁপ আর খেলাধুলার পাশাপাশি তখন আমাদের আরেকটি বিনোদন ছিল নানা বিষয়ের বই পড়া। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি আউট বই ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতা আর নিত্যনতুন স্মার্ট ডিভাইসের প্রতি অতিমাত্রায় অনুরক্ত হওয়ায় বর্তমান প্রজন্ম ধীরে ধীরে বই পাঠ থেকে যেন দূরে সরে যাচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে ‘বইবিমুখ জাতি’। আর তাই আবারও তরুণ প্রজন্মকে বইমুখী করে গড়ে তোলার প্রয়াসে এক ব্যতিক্রমী আন্দোলনে যুক্ত হতে গত সপ্তাহে আমি নাটোর গিয়েছিলাম।
এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল কবিবন্ধু লতিফ জোয়ার্দারের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ। লতিফ একটি উদ্যোগ নিয়েছে, একটি আন্দোলন শুরু করেছে, সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগেই। নিজে নিজে একটি ব্যানার তৈরি করেছে, সেখানে লেখা, ‘আমিই লেখক, আমিই বই ফেরিওয়ালা’। তার পরিকল্পনা এই ব্যানার নিয়ে দেশের ৬৪টি জেলা ঘুরে বেড়াবে। আর এ বেড়ানো ভ্রমণার্থে নয়। এর পেছনে রয়েছে একটি মহৎ উদ্দেশ্য। সে মানুষকে বইমুখী করতে চায়। সে চায় জেলায় জেলায় গড়ে উঠুক বই পড়া আন্দোলন। মানুষ মুঠোফোনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে, অবসরে বইমুখী হোক। বই পড়ুক, বই কিনুক। সে উদ্দেশ্য থেকেই তার এ ভ্রমণ। ইতোমধ্যে সে দুটি জেলা ঘুরেছে। এই কর্মসূচি নিয়ে প্রথম গিয়েছে সিরাজগঞ্জ। সময়ের হিসেবে সেটি ছিল গত বছরের অক্টোবর মাস। এরপর দ্বিতীয় জেলা গত বছরেরই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সে গিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। দুটি জেলাতেই স্থানীয় লেখক-সাহিত্যিক, কবিরা তাকে স্বাগত জানিয়েছে। তার কথা শুনেছে। তাকে বলতে দিয়েছে। এবারে নতুন বছরের প্রথমার্ধ পেরিয়ে জুলাইয়ে বনলতা সেনের শহর নাটোরে, এটি তার তৃতীয় সফর। নতুন সফরসূচি ঠিক করার পরেই, আমার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে, লতিফ জানায় নাটোর আসছি, আপনিও আসুন। দেখা হোক, আড্ডা হোক, আসুন মানুষকে বইয়ের দিকে ফিরতে ডাক দিই।
শুরুতেই, যখন সিরাজগঞ্জ যাওয়ার পরিকল্পনা করে, তখনও আমাকে জানিয়েছিল নিজের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যস্ততায়, সেবারে যাওয়া হয়নি। দ্বিতীয়দফা চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাত্রাকালেও সঙ্গী হতে আহ্বান জানিয়েছে। এই আহ্বান আত্মিক টান থেকে, কারণ তার এই উদ্যোগের প্রতি আমার সমর্থন শুরু থেকেই। কিন্তু এবারও আমি পিছিয়ে পড়ি। হঠাৎ করেই সময়টিতে করোনা আবার মাথাচাড়া দিতে থাকে। তাই আমি পিছিয়ে এলেও লতিফ নিজের সিদ্ধান্তে থাকে অনড়। সে যাবেই, কারণ পরিস্থিতি দুই হাজার কুড়ির মতো ভয়াবহ নয়। ফলে নির্ধারিত দিনে লতিফ ঠিকই পৌঁছে যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সেখানে পৌঁছে স্থানীয় লেখকদের সঙ্গে আড্ডা এবং মানুষকে বইপড়া এবং বইমুখী করার প্রচার চালায়।
প্রথম দুবার সঙ্গী হতে না পারার বেদনা ছিল, এবারেও সে বেদনা যেন বইতে না হয়, তাই যথাসময়ে পৌঁছে যাই নাটোর। কানাইখালী বাজারে রাস্তার পাশে একটি খোলা জায়গায় ব্যানার লাগিয়ে লতিফ জোয়ার্দার অপেক্ষা করছে। তার সঙ্গী নাটোরের স্থানীয় কয়েকজন লেখক। জেলার পণ্ডিতগ্রামের চর্যাপদ পাবলিক লাইব্রেরি এই আয়োজনের সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আয়োজনে সাড়া দিয়ে এসেছেন অল্প কয়েকজন মানুষ। হাতের আঙুলে গুনে ফেলা যায় সংখ্যা। কিন্তু সংখ্যা সবসময়ই সঠিক পরিমাপক নয়। আমি জানি, লতিফ জোয়ার্দারের চোখের আগুনে দেখেছি, তার সংকল্প, এ আগুন সে ছড়িয়ে দেবে সবখানে, সবপ্রাণে।
২.
প্রতিটি ভালো কাজে বাধা আছে। অকারণেই বিরোধিতা করার জন্যই দাঁড়িয়ে যান কেউ কেউ। অযাচিতভাবে যেমন সহযোগিতার হাত বাড়ান অনেকে, তেমনি চলতে থাকে সমানতালে বিরোধিতাও। নাটোর যাওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করতেই, আমাকেও মুঠোফোনে কয়েকজন শুভার্থী (!) নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের উদ্যোগকে তারা পাগলামি হিসেবেই দেখছেন। স্বেচ্ছায় এ যুগে, একজন সচেতন মানুষ কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে বই ফেরি করার কথা ভাবতে পারে? এ তো পাগলকেও হার মানায়। অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি দেখে সেই শুভার্থীদেরই (!) কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন, কতটি বই বিক্রি করেছি? কত টাকা আয় হলো? এরকম নানামুখী বাক্যবাণে জর্জরিত হতে হতে ভেবেছি, আমাকেই এরকম শুনতে হচ্ছে, লতিফ জোয়ার্দারকে না জানি কতটা সহ্য করতে হচ্ছে?
৩.
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চেয়ে জনপ্রিয়তায় এ মুহূর্তে কেউ এগিয়ে নেই। বই তো সেখানে তুচ্ছ। সৈয়দ মুজতবা আলী তার বইকেনা প্রবন্ধে ড্রইংরুম-বিহারিণী মহিলার কথা বলেছিলেন। যিনি ‘গিয়েছেন বাজারে স্বামীর জন্মদিনের জন্য সওগাত কিনতে। দোকানদার এটা দেখায়, সেটা শোঁকায়, এটা নাড়ে, সেটা কাড়ে, কিন্তু গরবিনী ধনীর (উভয়ার্থে) কিছুই আর মনঃপূত হয় না। সবকিছুই তার স্বামীর ভান্ডারে রয়েছে। শেষটায় দোকানদার নিরাশ হয়ে বললে, তবে একখানা ভালো বই দিলে হয় না?’ গরবিনী নাসিকা কুঞ্চিত করে বললেন, ‘সেও তো ওঁর একখানা রয়েছে।’ একখানা বই-ই তাদের পক্ষে যথেষ্ট।
সৈয়দ মুজতবা আলী যখন এই প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তারপর আমরা কয়েক যুগ পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু অবস্থার কি পরিবর্তন হয়েছে? একটা সময় গেছে, যখন আমরা বই পড়িনি, বই (সিনেমা) দেখেছি। এখন সে যুগও হারিয়ে গেছে। বইয়েরও (সিনেমা) দুর্দিনে কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়েছে দেশে বই (সিনেমা) চলার প্রেক্ষাগ্রহ বা হল। একই অবস্থা পড়া বইয়ের ক্ষেত্রেও। এই কয়েক বছর আগেও প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে ছিল সৃজনশীল বই বিক্রির দোকান। সেখানে থরে থরে সাজানো থাকতো নানান লেখকের বই। তা থেকে পাঠক বেছে নিতেন পছন্দের বই। এখন সেই দোকানগুলো হারিয়ে গেছে। সেখানে স্থান করে নিয়েছে নিত্যপণ্যের দোকান। আমার নিজের শহর, বগুড়া, এখানেও থানা রোড নামের একটি সড়ক জুড়েই ছিল বইয়ের দোকান। যদিও তার সবই সৃজনশীল বইয়ের না, গাইড বই, নোটবইয়ের মাঝেও সেখানে সৃজনশীল বইও থাকতো। আজ সে সড়কে কোনো বইয়ের দোকান নেই। সেখানে এখন হার্ডওয়্যার পণ্য। ষাটের দশকে এ শহরে বেণীপুর বুক হাউস নামের একটি বইয়ের দোকানোর কথা সে সময়ের লেখকদের লেখায় নানাভাবে ঘুরে-ফিরে এসেছে। সে দোকানটি যে কবে হারিয়ে গেছে, তা হয়তো কেউ মনেও করতে পারবে না। শুধু আমার শহরেই না, এমনিভাবে প্রতিটি শহর থেকেই হারিয়ে গেছে অসংখ্য বইয়ের দোকান। হারিয়ে গেছে বই-পিপাসু মানুষের আগ্রহ জাগানিয়া দোকানগুলো, সেসব দোকানের প্রাজ্ঞ মানুষগুলো, যারা বই ভালোবাসতেন, খুঁজে খুঁজে পাঠকের পছন্দের বই এনে দিতেন। একইভাবে হারিয়ে যাচ্ছে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা পাঠাগারও। যদিও সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নানাভাবে চেষ্টা করছে পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তুলতে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পাঠাগারের জন্য অনুদান দিচ্ছে, তাদের বই সরবরাহ করছে। তারপরও অভিযোগ রয়েছে এক্ষেত্রে কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষের অনুপ্রবেশ উদ্যোগটির পালে হাওয়া বইতে দিচ্ছে না। কোথাও কোথাও গড়ে উঠেছে, নামসর্বস্ব পাঠাগার। তাদের আগ্রহ পাঠক তৈরির দিকে নয়, তাদের উদ্দেশ্য সরকারের শুভ উদ্যোগে সহায়তা করা নয়। তাদের লোভ অনুদানের দিকে।
এরকম বৈরী সময়ে আমাদেরকে আরও বেশি বইবিমুখ করে তুলছে প্রযুক্তি। আজ আমরা পারস্পরিক আড্ডা দিতেও ভুলে যাচ্ছি। আমরা একইসময়ে একইসঙ্গে পাশাপাশি বসে থেকেও পারস্পরিক আড্ডা দেই না। পাশাপাশি বসে থেকেও আমরা ভার্চুয়াল আড্ডার দিকে বেশি মনোযোগী। আমরা পাশের মানুষটির খোঁজ নেই না, আমরা অপার হয়ে বসে থাকি দূরের মানুষের কুশল জানার জন্য। এরকম সময়ে একজন লেখক, তার আত্মউপলব্ধি থেকে সমাজে প্রভাব ফেলতে উদ্যোগী হবেন, তাই স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিক কর্মেই ব্রতী হয়েছেন লতিফ জোয়ার্দার। আজ তার উদ্যমের সঙ্গে রয়েছে হাতের আঙুলে গোনা কয়েকজন। কিন্তু যেদিন সে দেশের ৬৪ জেলায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পারবে, সেদিন সেই সফলতায় তার পাশে অনেক মুখের দেখা মিলবে। যারা তার সঙ্গী হয়ে বই পড়া, বইমুখী করার আন্দোলন এগিয়ে নেবে। আজ যারা ব্যঙ্গ এবং বিদ্রূপে তাকে আহত করার চেষ্টা করছে, একদিন হয়তো তাদেরই অনেকে তার সঙ্গী হবে। প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ অম্লান দত্ত তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, ‘গৃহস্থের প্রতি ডাকাতের কোনো কর্তব্য নেই; প্রজার প্রতি রাজার কর্তব্য আছে।’ একজন লেখক, একজন সাংস্কৃতিক কর্মীর কাজ আলো জ্বালানো। মনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আলো জ্বালিয়ে তোলার কাজটিই নীরবে, নিভৃতে করেন শিল্পী-সাহিত্যিক। সেই নীরবতা ভেঙে কখনও কখনও কেউ কেউ আরেকটি সাহসী হয়ে প্রকাশ্যেও সরব হয়ে ওঠেন। লতিফ জোয়ার্দার তো সেই কাজটিই করছে। সে তো মেঘ দেখে ভয় করেনি, সে জানে মেঘের আড়ালেই সূর্য হাসছে। এই ভ্রমণে, আমি আশাবাদী।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
এসএস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান