আবহমান বাংলায় উন্নয়নের ছোঁয়া |||| নাজনীন বেগম
প্রযুক্তির আধুনিক ছোঁয়ায় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যিক সম্ভারের সঙ্গে নতুন সময়ের আবেদন সত্যিই আজ নজরকাড়া। অবকাঠামোগত উন্নয়নশৈলী শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার অবারিত যাত্রাপথে গ্রাম-বাংলাকেও একীভূত করতে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। গ্রামীণ অতি সাধারণ মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের হিসাব বুঝে নেওয়া নতুন সময়ের পালাক্রম। সেখানে নারী-পুরুষ উভয়েরই সম্মিলিত সংযুক্ত হওয়া সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে অনেকখানি এগিয়ে যাচ্ছে- একথা বলাই যায়। বাংলাদেশ এখন সেভাবেই সমানতালে ধাবিত হচ্ছে উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান গতিতে মাঘ মাসের শুরুতেই প্রকৃতিতে জেঁকে বসেছে শীতের দাপট। দেশের উত্তরে তো বটেই, সারা বাংলাদেশে অনুভূত হচ্ছে ঠান্ডার তীব্রতা। আর এটাই আবহমান বাংলার প্রাকৃতিক বৈভব। ষড়ঋতুর হরেক আবহে চিরায়ত বাংলার নৈসর্গিক সম্ভার সেই পুরাকালের। প্রচ- শীতের হাওয়ায় আরও এক বৈশিষ্ট্য সারাদেশকে মাতিয়ে দেওয়ার মতোই। গ্রামগঞ্জের তেমন অনন্য ঐতিহ্যিক পিঠে-পুলির সমৃদ্ধ সম্ভার আজও পল্লিবালার অনন্য শৌর্য।
শুধু কি ঋতু বৈচিত্র্যের চিরায়ত সৌরভ? তার চেয়ে বেশি ধনধান্যে পুষ্পে ভরা শাশ্বত বাংলার বৈষয়িক সম্পদেরও এক অবারিত ঐশ্বর্য। যা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি আর মনন শৌর্যে বিভিন্নভাবে বিধৃত হয়ে আছে। কবির মতে, নদী¯œাত আবহমান বাংলার নরম পলিমাটি সাধারণ মানুষের জীবন মানকে যে উৎকর্ষে ভরে দেয়, তা এই বাংলারই অপরিমেয় শৌর্য-বীর্য। সঙ্গত কারণে নরম সোঁদা মাটিতে বীজ মাত্রই সরস-সজীব হয়ে ওঠে। যা শস্য ভান্ডারকে পূর্ণ থেকে পূর্ণতর করে দেয়।
কোনো শক্ত পাষাণভার বাংলার কোমল মাটিকে সেভাবে প্রভাব খাটাতে পারেনি। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলার তেমন উৎপাদন শক্তি সুদূর পুরাকাল থেকে আজ অবধি তার স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। স্বকীয়তার এমন শক্ত ভিত্তি আবহমান বাংলাকে করেছে অনিন্দ্যসুন্দর। রূপকথার দেশই নয়, বরং শস্যসম্ভারেও দিয়েছে এক অবধারিত নির্মাল্য। শুরুটা করি পিঠে পুলির আয়োজন নিয়ে। নবান্নের উৎসব আনন্দের সহযোগীর বার্তায় পিঠেপুলিও দেশীয় ঐতিহ্যিক সম্ভারের চিরায়ত রূপশৌর্য।
সত্যিই নিজস্ব পলিমাটিতে ফলন শক্তির অভাবনীয় উৎপাদনশীলতায় আমাদের এই ক্ষুদ্র বাংলাদেশও এক অনন্য নৈসর্গিক আবেদনে মাটি আর বাতাসকে যে মাত্রায় ভরিয়ে দেয়, তেমন সম্পদ আজও গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে। তবে পিঠেপুলির আয়োজনে এক সময় গ্রাম-বাংলাই ছিল এক ঐতিহ্যিক পিঠস্থান। গত শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নেও তা দৃশ্যমান হয়েছে। কৃষিভিত্তিক গ্রামনির্ভর বাংলাদেশ তার উৎপাদনশীলতায় সামনের দিকে ছুটে চলেছে। দেশের সিংহভাগ গ্রামীণ আঙিনায় চলছে পাকা ধান আর খেজুর রসের পিঠায় উৎসবের আমেজ।
সীমাবদ্ধ নগর-বন্দর আর শহরের নানা মাত্রিক দৃশ্যমান চাকচিক্যতে পিঠেপুলির ভরপুর আমেজ এক সময় খুঁজেই পাওয়া যেত না। শহরের যৎসামান্য জনগোষ্ঠীর নতুন ধানের মজাদার উপাদেয় পিঠার আয়োজন জীবনের সঙ্গে যোগ করতে গ্রামে যেতে হতো। এটাই ছিল কোনো এক সময়ের শহরবাসী মানুষের নাড়ির টানে গ্রামের দিকে দৃষ্টি ফেরানো। দুই ঈদের উৎসব-আয়োজন ছাড়াও শীতের আমেজে নতুন ধানের পিঠেপুলির উৎসবেও অনেকে গ্রামে বেড়াতে যেত। কিন্ত আজকাল শহরেই অনেক যায়গায় পিঠা উৎসব হয়ে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন যায়গায় শীতের পিঠার দোকান এখন প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বাংলাদেশের নিরন্তর এগিয়ে চলা সত্যিই এক অভাবনীয় উন্নয়ন যাত্রা। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে প্রথমেই নজর দিলেন বাংলাদেশকে তার যথার্থ রূপশৌর্যে অধিষ্ঠিত করার নানা মাত্রিক কর্ম প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করতে। সেখানে যেমন আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশের শক্ত কাঠামো নির্ণীত হয়েছে। পাশাপাশি সিংহভাগ গ্রামোন্নয়নের যথার্থ কর্মযোগের প্রস্তাবনাও হাজির করতে হয়েছে।
তবে দূরদর্শী ও আবহমান বঙ্গললনার চিরায়ত প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় শক্তি ও তীক্ষ্ম নজরে চলে আসে গ্রাম-বাংলার বহু ঐতিহ্যিক সম্ভার, যা আবহমান বাংলাকে করেছে অনন্য এক রূপশৌর্যের আধার। প্রধানমন্ত্রীর ২০০৯ সালের নির্বাচনী ঈশতেহারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারে সাজানো-গোছানো ছিল ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ মহা প্রকল্পটি। শুধু শব্দমালায় সজ্জিত ছিল না গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়টি। বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে যে অসম লড়াইয়ে প্রধানমন্ত্রীকে এগিয়ে যেতে হয়েছিল, তা শুধু ঐতিহাসিক কর্মযোগই নয়, অনিন্দ্যসুন্দর বাংলাদেশের ব্যাপক কর্ম সাধনা বললে বেশি বলা হয় না।
আজও অবাক বিস্ময়ে ভাবতে থাকি কি এক অদম্য দুঃসাহসে এমন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বাক্যকে বাস্তবের মাটি ছোঁয়ালেন। অত সহজসাধ্য নয় কিন্তু। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পটি মহা সাড়ম্বরের ব্যাপক আয়োজন। শিউরে ওঠার মতো দুঃসাহসিক কর্ম প্রকল্প। মূল জায়গাজুড়ে চমৎকারভাবে সাজানো-গোছানো হলো শহর-গ্রামের অবিচ্ছেদ্যতা, নিরবচ্ছিন্ন এক অনন্য কাজের আয়োজন। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যিক আবেদন-আমেজ ব্যস্ততম নগর-শহর জীবনে সম্প্রসারিত করতে হবে। অন্যদিকে গ্রামকে নিয়ে যেতে হবে প্রযুক্তির মহাসমারোহে উন্নত ও আধুনিক বাংলাদেশের সীমানায়। সময় লেগেছে প্রচুর।
তারপরেও তেমন বাংলাদেশ আজ আমাদের হাতের নাগালে। আজ আর পিঠেপুলি খেতে গ্রামে যেতে হচ্ছে না। দেশের বৃহত্তর নগর-শহরে তার চমৎকার নিদর্শন সত্যিই গল্প কথাকেও হার মানাচ্ছে। কেমন করে যেন সারাবাংলার পরিবেশ পরিস্থিতি সমানে সমান না হলেও কাছাকাছি তো চলে আসল। সমাপনী পরীক্ষা শেষে শীতকালীন ছুটিতে গ্রাম-বাংলায় কিছু আনন্দ আয়োজনের টানে ছুটে চলা দেশ ও মানুষের অনবদ্য এক যাত্রাপথ তো বটেই। আজ কিন্তু শহরে বসেই আমরা পিঠেপুলির আয়োজন উপভোগ করি।
বিশেষ করে খোদ রাজধানীতেই বৃহদাকার সব প্রতিষ্ঠানে পিঠে উৎসব এক খুশির আমেজে মাতিয়ে দেওয়ার মতো। তেমন কার্যক্রম সত্যিই উপভোগ্য এক অনুষ্ঠানের পসরা সাজানো তো বটেই। এখন শহর-নগরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পিঠেপুলির সম্ভারে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার দৃশ্য চমকপ্রদ এবং স্বস্তিদায়ক। বিশেষ করে সমসংখ্যক নারীরা আজ উদ্যোক্তার কাতারে দাঁড়িয়ে শুধু খাদ্যপণ্য নয়, কাপড়ের ব্যবসা ছাড়াও বুটিক শিল্পে নিমগ্ন হয়ে তাদের নিত্য জীবনকে সাফল্য গাথায় ভরিয়ে তুলতে পেছনের দিকে তাকাচ্ছে না। এমন চিত্র এখন গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে।
শহর-পল্লির তারতম্য একেবারে বিলীন হওয়ার মতো নয়। কিন্তু কিছুটা কাছাকাছি নিয়ে আসাও সময়ের দাবিÑ পরিস্থিতির ন্যায্যতাও বটে। শুধু কি ব্যবসা বাণিজ্য? প্রযুক্তির আধুনিক ছোঁয়ায় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যিক সম্ভারের সঙ্গে নতুন সময়ের আবেদন সত্যিই আজ নজরকাড়া। অবকাঠামোগত উন্নয়নশৈলী শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার অবারিত যাত্রাপথে গ্রাম-বাংলাকেও একীভূত করতে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। গ্রামীণ অতি সাধারণ মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের হিসাব বুঝে নেওয়া নতুন সময়ের পালাক্রম।
সেখানে নারী-পুরুষ উভয়েরই সম্মিলিত সংযুক্ত হওয়া সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে অনেকখানি এগিয়ে যাচ্ছে- একথা বলাই যায়। বাংলাদেশ এখন সেভাবেই সমানতালে ধাবিত হচ্ছে উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান গতিতে। নতুন সময়ের আবেদন প্রযুক্তির সর্বশেষ অর্জনকে কাজে লাগিয়ে গ্রাম-শহরের ফারাক ক্রমান্বয়ে কমে আসা এক অবধারিত কর্ম প্রকল্পেরই অবারিত যাত্রা। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন নির্বাচনী অঙ্গীকারের দৃঢ় প্রত্যয়। টানা চতুর্থবারের আসন অলঙ্কৃত করা শেখ হাসিনা তাঁর অনন্য দেশাত্মবোধ আর জনগণের প্রতি সচেতন দায়বদ্ধতায় সব ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়ে শেষ অবধি বাস্তবের দ্বারে পৌঁছেও দিচ্ছেন।
সপরিবারে পিতৃহত্যার চরম কষ্ট আর বেদনা নিয়ে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের দায়িত্বভার নিলেন। চারপাশে শত্রু পরিবেষ্টিত এক অলঙ্ঘনীয় পথ। নিরাপদ আর নির্বিঘেœ সব সময় নিজেকে এগিয়ে নিতে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে। প্রাণ সংহারের মতো চরম কোপানল থেকে রেহাই পাননি। তারপরেও বীরদর্পে এগিয়ে যেতে সব বাধাবিপত্তিকে যে মাত্রায় মাড়িয়ে গেলেন, সেখানে তাঁর অনন্য বীরোচিত জীবন প্রবাহ নিজের অবারিত কর্মসাধনার অনুষঙ্গ হতে দেরি করেনি।
সদর্পে নিজের ওপর আস্থা আর বিশ্বাস রেখে জনগণের কল্যাণে হরেক কাজের ভাণ্ডার হাতে নেওয়াও তাঁকে অদম্য দুঃসাহসী করতে নিয়ামকের ভূমিকায় দাঁড় করায়। প্রতি মুহূর্তে লড়াই করতে হয়েছে ভেতরের অপশক্তির দাপটকে ডিঙিয়ে যেতে। কল্পনা করা যায় না নিজ দেশের অভ্যন্তরে নানা মাত্রিক বৈরিতায় থমকানো কিংবা বিচলিত হওয়ার অপদৃশ্য আড়ালেই থেকেছে। সামনে এগিয়ে গেছেন নিরুদ্বেগ আর নির্ভয়ে। প্রসঙ্গক্রমে এসেই গেল কবিগুরুর সেই গানটি ‘পথে পথে পাথর ছড়ানো’।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য পাথর নয়, পদে পদে কাঁটা বিছানো ছিল। দুর্গম, কঠিন তেমন যাত্রাপথকে পদদলিতই শুধু নয়, উন্নয়নের ধ্বজা উড়িয়ে জিতে যাওয়া অবিশ্বাস্য এক সংগ্রামী জীবনগাথা। শুধু কি নির্বাচন? সর্ববিধ বৈপরীত্যকে অবজ্ঞা, অবহেলায় পাশ কাটিয়ে জনগণের মঙ্গল কামনায় অবারিত ছুটে চলা প্রধানমন্ত্রী আবারও প্রমাণ করলেনÑ জনগণকে একাত্ম করে তিনি বহুদূর যেতে পারেন।
২০২৪ সালের নতুন বছরের অনন্য পরিক্রমা শুরুর প্রাক্কালে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর পুনরায় নির্বাচিত হওয়া দেশ ও জাতির সার্বিক মঙ্গল সাধনে অপরিহার্য ছিল। উন্নয়নের বহুমাত্রিক সমারোহ জনগণের জন্য অবারিত হলেও অনেক কিছু রয়েছে অর্ধেক পথে। সেখানে পূর্ণতার স্রোত বয়ে দিতে যথার্থ রূপকারকেই প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। তা না হলে নির্মাণাধীন উন্নয়ন যাত্রা ব্যবচ্ছেদের কবলে পড়তে খুব বেশি সময় নিত না। আরও এক বিপাক দেশকে নিয়ন্ত্রণহীনতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে।
ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অরাজক কর্মসূচি। নবান্নের এমন সুসময় আর শীতের শাক-সবজির অবারিত সমারোহের মধ্যেও দ্রব্যমূল্য কেন যে লাগামহীন হচ্ছে, তা বুঝতে এখন আর কোনো অসুবিধা হয়ই না। তবে বর্তমানে বাজার সিন্ডিকেটের ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তীক্ষ্ম নজরদারি শুরু হয়েছে বলে তথ্য উপাত্তে উঠে আসে। খোদ খাদ্যমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপের বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে এমনও বলেন, যেভাবে দাম বেড়েছে, ঠিক একই হারে তা কমিয়ে আনার জোর প্রচেষ্টা চলছে।
লেখক : সাংবাদিক