দেশের সংবাদ

করোনাকালের দেবদূত ওরা

করোনাকালের দেবদূত ওরা

 

লুৎফর রহমান কাকন ও এমরান আলী সজিব,নারায়ণগঞ্জ থেকে ।। করোনাকালের দেবদূত ওরা ।। যে কোনো দুর্যোগেই নিজের পাশাপাশি পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে আপ্রাণ চেষ্টা থাকে প্রায় প্রতিটি মানুষের। সুযোগ থাকলে হাত বাড়িয়ে দেন আশপাশেও। বিপদ-আপদে সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়েও পড়েন। জন্ম হোক মৃত্যুÑ প্রতিবেশীরা পাশে থাকেন একে অপরের। কঠিন কাজকেও সহজ করে তুলে আনেন সবাই মিলে জোট বেঁধে। কিন্তু এবার বিশ্বে এমন এক দুর্যোগ এসেছে, যেখানে স্বজনরা পর্যন্ত অচেনা আচরণ করছেন। বাবার লাশ হাসপাতালে ফেলে গা ঢাকা দিচ্ছেন সন্তান। প্রিয়তম স্বামীকে রেখে বাড়ি ছাড়ছেন স্ত্রী। বলছি করোনা ভাইরাসের কথা, যার প্রভাবে সারাদুনিয়া এখন কাঁপছে। দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল। সংক্রমণের ভয়ে না স্পর্শ করেই লাশ দাফন করতে ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম

খাচ্ছে শক্তিধর দেশগুলো পর্যন্ত। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে ব্যতিক্রম আছেন কিছু মানুষ। মানবতা তাদের আজ বড্ড কাঁদায়। ঘরে বসে থাকতে পারেন না সেই আর্তনাদে। নিজের জীবন তুচ্ছ করে এগিয়ে আসছেন দেবদূতের মতো। ধর্মের ভেদ ভেঙে করে যাচ্ছেন স্বজনরা ছেড়ে যাওয়া মৃতের দাফন কাজটিও। করোনার হটস্পট নারায়ণগঞ্জের বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী এরই মধ্যে আলোচনায় উঠে এসেছেন।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় গত ১০ এপ্রিল মোকলেছ নামে ৫৫ বছর বয়সী এক শ্রমিক নিজ ঘরেই মৃত্যুবরণ করেন। এর পরই শুরু হয় স্ত্রী ও তিন শিশু সন্তানের আহাজারি। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসেনি তখন। লাশ দাফনে যেতে রাজি নন স্বজনরা। দুপুর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত লাশ নিয়ে ঘরেই বসেছিলেন স্ত্রী। খবর পেয়ে এগিয়ে আসেন স্থানীয় এক সাংবাদিক। তার উদ্যোগে রাত ১১টায় লাশ দাফন করা হয়। ৭ এপ্রিল শহরের দেওভোগ এলাকায় গিটারিস্ট খাইরুল ইসলাম হিরো মারা যান করোনার উপসর্গ নিয়ে। মৃত্যুর পর সারারাত তার মৃতদেহ পড়ে থাকে রাস্তায়। ভয়ে পরিবারের লোকজনও কাছে আসেননি। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির তত্ত্বাবধানে লাশটি দাফন হয়।

করোনার এ সংকটময় মুহূর্তে মৃতের দাফনের জন্য সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গঠন হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল। নগরীতেই এমন বেশ কয়েকটি দল রয়েছে। এর মধ্যে তবলিগ জমাতের ২০ সদস্য মিলে গঠন করেছেন ‘এহসান পরিবার’। ওই দলে দুই নারী সদস্যও রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের যেখান থেকেই মৃত্যুর খবর আসছে সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন তারা। এমনকি শহরের বাইরে গিয়েও মৃতের দাফন করছেন। স্বেচ্ছাসেবক দলটি এখন পর্যন্ত ১৯ লাশ দাফন করেছে বলে জানা যায়। মুসলিমদের পাশাপাশি তারা অন্য ধর্মের লোকজনের সৎকারেও হাত বাড়িয়েছেন। নিঃস্বার্থ এ কাজ করতে গিয়ে নানা বাধার সামনেও পড়ছেন নিবেদিত প্রাণ এসব স্বেচ্ছাসেবী।

‘এহসান পরিবারের’ সদস্য সাংবাদিক নোমান চৌধুরী সুমন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা স্বেচ্ছায় মৃতদেহের দাফন কাফনের কাজগুলো করছি। তবে কাজগুলো করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মৃতকে গোসল করানোর জন্য কোনো কোনো মসজিদ থেকে খাটিয়া দিচ্ছেন না কমিটির লোকজন। এলাকায় মৃতকে গোসল করাতেও দেওয়া হয় বাধা। এর মধ্যে ফতুল্লা পুলিশ লাইনসংলগ্ন আফাজনগর হাউজিং এলাকার এক মৃতের দাফন কাফনের জন্য আমরা যাই। কিন্তু সেই কাজে বাধা দেন হাউজিং কমিটির সভাপতি টিটু। পরে নিরুপায় হয়ে সেই মৃত ব্যক্তিকে মাসদাইর কবরস্থানে নিয়ে গোসল শেষে জানাজা পড়িয়ে দাফন করি।’

প্রাণঘাতী করোনায় মৃতদের লাশ দাফন করে দেশে-বিদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহাগর যুবদলের সভাপতি মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। মানুষকে সচেতন করা থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন তিনি। দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই যেন খোরশেদ নিবেদিত প্রাণ। এ জন্য তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করেছেন। তবে দল গঠন করে দিয়েই বসে থাকেননি, সামনে থেকে নিজেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মুসলিমদের দাফন কাফনের পাশাপাশি অন্য ধর্মাবলম্বীদের মৃতদেহও সৎকার করে যাচ্ছেন সমানতালে। পরিবারের সদস্যরা ভয়ে দূরে সরে যাওয়ায় নিজের হাতেই করছেন মৃতের মুখাগ্নি। নিজের জীবনের ঝুঁকি জেনেও থেমে নেই এ করোনাযোদ্ধা। খবর পেলেই দল নিয়ে ছুটে যান মৃতের বাড়ি। সাহসী ও মানবিক এ কর্মকা-ের জন্য কাউন্সিলর খোরশেদকে বীর বাহাদুর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ সেলিম ওসমান।

নাসিকের ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুহুল আমিন মোল্লাও করোনা আক্রান্তসহ যে কোনো মৃতের দাফন কাফনের জন্য গঠন করেছেন একটি স্বেচ্ছাসেবক দল। ২৪ সদস্যের তার এ কমিটিতে রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, মসজিদ কমিটির নেতা ও এলাকার স্বেচ্ছাসেবকরা। এ দলের একজন সদস্য মোফাজ্জল হোসেন আনোয়ার বলেন, ‘করোনার এ দুর্যোগে আপন লোকজনও স্বজনের লাশ ধরতে চান না। এটা সত্যিই বেদনার। তাই আমরা কাউন্সিলরের নেতৃত্বে যে কমিটি করেছি তারা যে কোনো মৃতের সৎকার করবে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নারায়ণগঞ্জ মহানগরের পক্ষ থেকেও ১০ সদস্যের একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। ইসলামী ফাউন্ডেশনের নিয়মানুযায়ী তারা করোনায় মৃত ব্যক্তির জানাজা ও দাফন-কাফন করেন। করোনায় আক্রান্তদের সেবা দেওয়ার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে শহরের পালপাড়ার ১৬ জনের একটি স্বেচ্ছাসবী দল। আক্রান্তদের যে কোনো বিপদে পাশে দাঁড়ানো ছাড়াও ধর্মীয় রীতি মেনে লাশ দাফন ও সৎকারেও কাজ করবেন তারা। সনাতনধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের নেতা রিপন ভাওয়াল এবং ব্যবসায়ী অনল পোদ্দার পুলকের উদ্যোগে গঠন করা হয়েছে দলটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা স্বেচ্ছাসেবীদের ফোন নম্বরও দিয়ে রেখেছেন, যাতে করে যে কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

এদিকে তরুণ আলেম সমাজের সমন্বয়কারী মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বেচ্ছাসেবক দলও মৃতদের গোসল, কাফন, জানাজা ও দাফন করে যাচ্ছে। গত ১৩ এপ্রিল রাতে করোনার উপসর্গ নিয়ে কলাগাছিয়া ইউনিয়নের বাগপাড়ার মিজানুর রহমান চুন্নু নামে এক প্রৌঢ় মারা যান। পরিবারে লোকজন এগিয়ে না আসায় স্বেচ্ছাসেবক এ দলটি গিয়ে লাশের গোসল, কাফন, জানাজা ও দাফন করে। এর আগে ১১ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জে করোনায় মৃত এক শ্রমিকলীগ নেতার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করেন নারায়ণগঞ্জের তরুণ আলেমরা।

-আমাদের সময়

 

সিবিএনএ/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

সংবাদটি শেয়ার করুন